• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন

উৎপাদন তিন গুণ বেড়েছে ৮ বছরে


নিজস্ব প্রতিবেদক জানুয়ারি ২০, ২০১৯, ০১:২৫ পিএম
উৎপাদন তিন গুণ বেড়েছে ৮ বছরে

ঢাকা : দেশে ২০০৯ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা ছিল ৪ হাজার ৯০০ মেগাওয়াট। ২০১৭ সালে সক্ষমতা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৫ হাজার মেগাওয়াটে। আট বছরে উৎপাদন ক্ষমতা তিনগুণের বেশি বাড়লেও বিদ্যুৎ ব্যবহারে দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশের পেছনেই রয়েছে এখনো বাংলাদেশ।

সর্বশেষ হিসাবে বাংলাদেশের ৭৫ দশমিক ৯০ শতাংশ মানুষ বিদ্যুতের আওতায় এসেছেন। পল্লী অঞ্চলে এর হার ৬৮ দশমিক ৯০ শতাংশ। আর্থ-সামাজিক সব সূচকে পিছিয়ে থাকা আফগানিস্তানেও বিদ্যুতের আওতার বাইরে থাকা মানুষের হার বাংলাদেশের চাইতে অনেক কম। বহুজাতিক দাতা সংস্থা বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

সম্প্রতি ‘অন্ধকারে : দক্ষিণ এশিয়ায় বিদ্যুতের অব্যবস্থাপনার সার্বিক ক্ষতি’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাংক। প্রতিবেদনে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের বিদ্যুৎ ব্যবস্থার সার্বিক চিত্র উঠে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সরবরাহ ও সঞ্চালন লাইন বাড়ছে না। আট বছরে বিদ্যুতের বিতরণ লাইন ৬০ শতাংশ ও সঞ্চালন লাইন ৩০ শতাংশ বেড়েছে। কমে এলেও এখনো বিদ্যুতের সিস্টেম লস রয়েছে ১৩ শতাংশ। বিদ্যুতে জ্বালানি ব্যবহারে অদক্ষতা, ভর্তুকিসহ বিভিন্ন ধরনের বিচ্যুতির কারণে ২০১৬ সালে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৫ শতাংশের বেশি ক্ষতি হয়েছে। আর্থিক বিচারে এর পরিমাণ ১ হাজার ১২০ কোটি ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় বিদ্যুতে অসঙ্গতির ক্ষতি প্রায় ৯২ হাজার কোটি টাকা।

প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, কয়েক দশকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় বিদ্যুতের পরিধি বেড়েছে ব্যাপক হারে। বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারতের সমন্বিত বিদ্যুৎ উৎপাদন ১০ বছরে ১ লাখ ৯৮ হাজার মেগাওয়াট থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৭৬ হাজার মেগাওয়াটে। একই সময়ে তিন দেশে বিদ্যুতের আওতায় থাকা জনসংখ্যার হার ৭০ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৬ শতাংশে। উৎপাদন বৃদ্ধি সত্ত্বেও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো গুণগত বিদ্যুৎ প্রাপ্তির বিচারে অনেকটাই পিছিয়ে আছে। উৎপাদন ক্ষমতার শতভাগ হিসেবে নিলেও মাথাপিছু বিদ্যুৎ প্রাপ্তি এ অঞ্চল বৈশ্বিক গড়ের নিচে অবস্থান করছে। দক্ষিণ এশিয়ায় বিশ্বের এক-চতুর্থাংশ মানুষ বাস করলেও এ অঞ্চলে বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে বিশ্বের মাত্র ৫ শতাংশ। জৈব জ্বালানিতে অতি নির্ভরতার কারণে এ অঞ্চলের বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা কঠিন ঝুঁকিতে পড়ছে বলেও উঠে এসেছে প্রতিবেদনে।

এতে আরো বলা হয়, দক্ষিণ এশিয়ার সাড়ে ২৫ কোটি মানুষ এখনো বিদ্যুৎ সংযোগের আওতার বাইরে আছে। মোট জনসংখ্যার হিসাবে এ অঞ্চলে বিদ্যুতের আওতার বাইরে আছের ১৪ ভাগ মানুষ। সাব-সাহারান আফ্রিকার পর বিদ্যুৎবিহীন মানুষের হার এ অঞ্চলে বেশি। আর ২০১৬ সালের হিসাবে দক্ষিণ এশিয়ায় বিদ্যুতের আওতার বাইরে থাকা মানুষের হার বাংলাদেশে সর্বোচ্চ ২৪ দশমিক ১ শতাংশ। দেশটির পল্লী অঞ্চলের ৩১ দশমিক ১ শতাংশ মানুষ এখনো বিদ্যুৎ পাচ্ছেন না।

দক্ষিণ এশিয়ায় বিদ্যুৎ সংযোগে সবার পেছনে থাকা বাংলাদেশের আগেই রয়েছে আফগানিস্তান। দেশটির ৮৪ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ পেয়েছে। পল্লী অঞ্চলে বিদ্যুতের আওতায় এসেছে ৭৯ শতাংশ পরিবার। ২০১৮ সালে ভারতের শতভাগ এলাকা বিদ্যুৎ লাইনের আওতায় এসেছে বলে দাবি করেছে দেশটি। তবে বিশ্বব্যাংকের হিসেবে ভারতের পল্লী অঞ্চলে ২০১৭ সাল পর্যন্ত দেশটির ৮৬ দশমিক ১ শতাংশ পরিবার বিদ্যুতের আওতায় এসেছে। দেশটির পল্লী অঞ্চলে বিদ্যুতের আওতায় আসা পরিবারের হার ৮১ শতাংশ।

নেপালের ৯০ দশমিক ৭ শতাংশ পরিবার বিদ্যুতের আওতায় এসেছে বলে প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে। দেশটির পল্লী অঞ্চলে বিদ্যুতের আওতায় আছে ৮৫ দশমিক ২ শতাংশ পরিবার। শ্রী-লঙ্কায় জাতীয়ভাবে ৯৫ দশমিক ৬ শতাংশ ও পল্লী অঞ্চলের ৯৪ দশমিক ৬ শতাংশ পরিবার বিদ্যুতের আওতায় আছে। পাকিস্তানের সরকার ৯৯ শতাংশ পরিবার বিদ্যুৎ পেয়েছে মর্মে দাবি করলেও বিভিন্ন পরিসংখ্যানে এর হার সর্বোচ্চ ৭৪ শতাংশ হতে পারে বলে মনে করে বিশ্বব্যাংক। এর বাইরে দক্ষিণ এশিয়ায় শতভাগ বিদ্যুতায়নের লক্ষ্য পূরণ হয়েছে মালদ্বীপ ও ভুটানে।

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বিদ্যুতের অদক্ষতার কারণে ক্ষতির পরিমাণ জিডিপির পাঁচ দশমিক ০১ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। এ খাতে ২০১৬ সালে ক্ষতি হয়েছে ১ হাজার ১২০ কোটি ডলার। এর মধ্যে বিদ্যুতের দামে ভোক্তাদের ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে ৩৩ কোটি ডলার। বিদ্যুৎ খাতে কম দামে গ্যাস সরবরাহের কারণে এক বছরে ক্ষতির পরিমাণ ৪৫০ কোটি ডলার। নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎ সরবরাহ না থাকায় শিল্পপ্রতিষ্ঠানে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৩৩০ কোটি ডলার ক্ষতি হয়েছে বলেও জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক। আর সরবরাহে অদক্ষতার কারণে ক্ষতি হয়েছে ১৬৫ কোটি ডলার।

প্রতিবেদনটিতে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ব্যবস্থার সাম্প্রতিক কিছু সফলতার কথাও উঠে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, সরকারের বিশেষ অগ্রাধিকারের কারণে বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়ছে। ২০০৯ সালে ৪ হাজার ৯০০ মেগাওয়াট থেকে বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা ২০১৭ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৫ হাজার মেগাওয়াটে। আট বছরে দেশটিতে উৎপাদন ক্ষমতা বেড়েছে তিনগুণের বেশি। একই সময়ে বিদ্যুতের বিতরণ লাইন ৬০ শতাংশ ও সঞ্চালন লাইন ৩০ শতাংশ বেড়েছে। একই সময়ে দেশটিতে বিদ্যুতের আওতায় আসা মানুষের হার ৪৭ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৬ শতাংশে। এ সময়ে মাথাপিছু বিদ্যুৎ ব্যবহারের পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে উন্নীত হয়েছে ৪৩৩ কিলোওয়াট ঘণ্টায়। ২০০১ সালের সাড়ে ২৪ শতাংশ সিস্টেম লস ২০০৯ সালে ১৭ শতাংশে ও ২০১৬ সালে ১৩ শতাংশে নেমে এসেছে।

একই সময়ে পারিবারিক পর্যায়ে সৌরশক্তির ব্যবহার, সৌর শক্তির মিনি গ্রিড ও সেচ পাম্প স্থাপনের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাপক উন্নতি করেছে। সৌর শক্তি স্থাপনে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে চতুর্থ অবস্থানে আছে বাংলাদেশ। সরকার, বেসরকারি উদ্যোক্তা ও উন্নয়ন সংস্থার অর্থায়নে ২০১৬ সাল পর্যন্ত দেশটিতে সৌরশক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন দেড়শ মেগাওয়াটে দাঁড়িয়েছে। এর সুফল পেয়েছে প্রায় ৩৫ লাখ মানুষ। ২০০৯ সাল থেকে প্রতি মাসে গড়ে ৫০ হাজার সৌর প্যানেল স্থাপন হয়েছে বাংলাদেশে।

এত কিছুর পরেও বাংলাদেশে এখনো ৩ কোটি ৮০ লাখ মানুষ বিদ্যুৎ সংযোগের আওতার বাইরে আছেন। বাংলাদেশে মাথাপিছু বিদ্যুৎ ব্যবহারের পরিমাণ ভারতের এক তৃতীয়াংশ। আর বৈশ্বিক গড়ের মাত্র এক দশমাংশ বিদ্যুৎ ব্যবহার হয় বাংলাদেশে। ২০১৮ সালের বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা সক্ষমতার সূচকে বিদ্যুৎ ব্যবহারে ১৩৮ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০১তম।

দক্ষতা নিশ্চিত করতে বিদ্যুৎ খাতে ব্যাপক সংস্কারের সুপারিশ করেছে বিশ্বব্যাংক। কম খরচে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারলে পরিবারের পাশাপাশি শিল্পখাত উপকৃত হবে বলে মনে করে সংস্থাটি। এতে বলা হয়েছে, বিদ্যুতের ব্যয় কমলে শিল্পে উৎপাদন বাড়বে। তা ছাড়া ভর্তুকির পরিমাণ কমে এলে বিদ্যুতে অপচয় কমে আসার পাশাপাশি সরকারের রাজস্ব আদায় বাড়বে। ফলে স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় বিনিয়োগের পরিমাণও বাড়বে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!