• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

এ বছর বিদেশে সোয়া ৩ লাখ শ্রমিক কম গেছেন


বিশেষ প্রতিনিধি ডিসেম্বর ৩১, ২০১৮, ০১:৪০ পিএম
এ বছর বিদেশে সোয়া ৩ লাখ শ্রমিক কম গেছেন

ঢাকা : ২০১৭ সালে বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ১০ লাখেরও বেশি শ্রমিক পাঠিয়ে অনেকটা রেকর্ড সৃষ্টি করেছিল প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। এ বছর টার্গেট ছিল ১২ লাখ কর্মী পাঠানোর। কিন্তু বাড়ানোর পরিবর্তে এক বছর না যেতেই সেই শ্রমবাজারে হঠাৎ করেই নেমে আসে ধস।

জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী, গত বছরের চেয়ে চলতি বছর সোয়া তিন লাখ শ্রমিক কম গেছেন। এর মধ্যে শুধু সৌদি আরবেই আড়াই লাখের মতো কর্মী কম রফতানি হয়েছে। তবে অভিবাসন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সৌদি আরবে হঠাৎ করেই বিদেশী কর্মীদের আকামা ফি বাড়িয়ে দেয়ার কারণে জনশক্তি রফতানি কমার অন্যতম প্রধান কারণ।

অভিযোগ রয়েছে, আকামা জটিলতার কারণে টিকতে না পেরে সৌদি আরবে স্থায়ীভাবে বসবাসরত বাংলাদেশীরা তাদের পরিবার ও কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্য যাওয়া শ্রমিকরা দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন। আবার অবৈধভাবে পালিয়ে কাজ করার অপরাধে বহু শ্রমিক বর্তমানে পুলিশের অভিযানে ধরা পড়ে সৌদি আরবের জেদ্দাসহ বিভিন্ন কারাগারে বন্দী আছেন।

এ ছাড়াও বিভিন্ন দেশে থাকা বাংলাদেশ দূতাবাসের শ্রম উইংয়ের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীর গাফিলতির কারণে যথাসময়ে ভিসার সত্যায়ন না হওয়ায় বৈধ ভিসাধারীদের অনেকেই এজেন্সির মালিক ও প্রতিনিধিরা বিমানবন্দর ‘কন্ট্রাক্ট’ করে বিদেশে পাঠিয়েছেন। যার ফলে ওই সব শ্রমিকের নামে বিদেশ যাওয়ার কোনো রেকর্ডই জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোতে নেই বলে অভিযোগ রয়েছে। যদিও এসব দেখার জন্য প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের একটি টাস্কফোর্স রয়েছে। এসব কারণেই মূলত চলতি বছর জনশক্তি প্রেরণে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে বলে মনে করছেন এ পেশার সাথে সংশ্লিষ্ট রিক্রুটিং এজেন্সি ও অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা।

তবে কেউ কেউ বলছেন, জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর বহির্গমন শাখায় গড়ে ওঠা একটি চক্রের যোগসাজশে দুতাবাসের সত্যায়ন না থাকার পরও বর্হিগমন ছাড়পত্র দেয়া হয়েছে গণহারে। ওই সব কর্মীই এখন বিদেশে গিয়ে বেতনভাতার সমস্যার পাশাপাশি মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে সৌদি আরব, কাতার, ব্রুনাই, মালয়েশিয়া ও মালদ্বীপগামী শ্রমিকের সংখ্যাই বেশি।

জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর পরিসংখ্যান অনুযায়ী চলতি বছর বাংলাদেশ থেকে গতকাল শনিবার পর্যন্ত ছয় লাখ ৮৪ হাজার ৯৬২ জন কর্মী (নারী-পুরুষ) পাড়ি জমিয়েছেন। এর মধ্যে সৌদি আরবে গেছেন দুই লাখ ৩২ হাজার ৬১৮ জন। কিন্তু ব্যুরোর (বিএমইটি) পরিসংখ্যান মোতাবেক গত বছর (২০১৭) বাংলাদেশ থেকে ১০ লাখ আট হাজার ৫২৫ জন শ্রমিক পাড়ি জমিয়েছিল, যা শ্রমবাজারের ইতিহাসে সর্বোচ্চ শ্রমিক প্রেরণ। তার মধ্যে সৌদি আরবেই গিয়েছিল পাঁচ লাখ ৫১ হাজার ৩০৮৭ জন। তুলনামূলক হিসাব করলে দেখা যায়, গত বছরের চেয়ে চলতি বছর তিন লাখ ২৩ হাজার ৫৬৩ জন শ্রমিক কম গেছেন।

এ ছাড়া পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহৎ শ্রমবাজার সংযুক্ত আরব আমিরাতে চলতি বছর শ্রমিক গেছে মাত্র দুই হাজার ৯১১ জন। অথচ গত বছরও দেশটিতে গিয়েছিল চার হাজার ১৩৫ জন। এভাবে কাতার, কুয়েত, বাহরাইন, জর্দান, ওমানসহ অন্যান্য দেশে শ্রমিক রফতানি দিন দিন কমতে থাকে। তবে একমাত্র গত বছরের চেয়ে চলতি বছর মালয়েশিয়াতেই জনশক্তি রফতানি বেড়েছে। গত বছর দেশটিতে ৯৯ হাজার ৭৮৭ জন শ্রমিক গেলেও এ বছর সেটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৭৪ হাজার ৮৫১ জনে।

গত ৯ জুলাই জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর মহাপরিচালক সেলিম রেজার কাছে সৌদি আরবের জেদ্দা জেলখানায় আটক জহির উদ্দিনকে দ্রুত দেশে ফেরাতে চট্টগ্রাম জেলার বোয়ালখালী থানার বাসিন্দা জহিরের বড় ছেলে মো: বদরুদ্দোজা আবেদন করেন। কিন্তু এ ঘটনার পাঁচ মাস অতিবাহিত হওয়ার পরও জহিরকে দেশে ফেরত আনতে পারেনি জনশক্তি ব্যুরো। ওই আবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, জহির আহমেদ বর্তমানে জেদ্দা জেলখানায় (টোকেন নং ৯০০৬৬৩৯৯১২) দুই মাস ধরে আটক আছেন। তার অবস্থা খুবই খারাপ। তার শারীরিক দুরবস্থার কথা বিবেচনা করে তাকে দ্রুত দেশে ফিরিয়ে আনার আকুতি জানান।

এ প্রসঙ্গে গত সপ্তাহে কারাবন্দী জহিরের ছেলে বদরুদ্দোজা বলেন, এখন পর্যন্ত তার বাবা জেদ্দা জেলেই বন্দী আছেন। তিনি বলেন, তার বাবা সৌদি আরবে যাওয়ার পর আকামা করতে পারেনি। পরে তিনি কোম্পানি থেকে পালিয়ে জেদ্দার একটি মুদি দোকানে কাজ করছিলেন। সেখান থেকেই পুলিশ তার বাবাকে গ্রেফতার করে।

কারাগার থেকে তার বাবা তাকে ফোনে জানিয়েছেন, আবেদন করার পর দূতাবাস থেকে কর্মকর্তারা এসে দেখা করেছেন। কিন্তু এরপর আর কি হয়েছে তা তিনি জানেন না বলে জানান। শুধু জহির নন, তার মতো শত শত বাংলাদেশী আকামা জটিলতায় পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। অনেকে আবার ধরা পড়ে দেশটির বিভিন্ন কারাগারে বন্দী হয়ে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন। অনেকে আবার আকামার টাকা জোগাড় করতে না পেরে পরিবার নিয়ে দেশে ফিরে আসছেন।

গতকাল জনশক্তি রফতানিকারকদের সংগঠন বায়রার সাবেক নেতা আবুল বাশার বলেন, সৌদি আরবে এখন দুই লাখ টাকায় লোক যেতে চাচ্ছে না। কারণ সেখানে বেতনভাতার সমস্যার পাশাপাশি আকামা জটিলতা রয়ে গেছে। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, শুনছি আকামার টাকা সৌদি সরকার কমানোর চিন্তাভাবনা করছেন। তবে সেটি ইমপ্লিমেন্ট কবে হবে তা তিনি জানাতে পারেননি।

গতকাল জনশক্তি রফতানির সাথে সম্পৃক্ত বোরহান উদ্দিন এ প্রতিবেদককে বলেন, আগে সৌদি আরবে আকামা করাতে সাড়ে পাঁচ হাজার থেকে সাড়ে ছয় হাজার রিয়াল লাগত। কিন্তু এখন সেটি করতে লাগছে সাড়ে আট হাজার থেকে ৯ হাজার রিয়াল, যা বাংলাদেশী টাকায় এক লাখ ৯০ হাজার টাকার মতো। টাকা বেশি লাগার কারণে অনেক কোম্পানি এখন কর্মীদের আকামা লাগাতে টালবাহানা করছে। কোনো কোনো কোম্পানি ৯ মাস থেকে এক বছরও সময় পার করে দিচ্ছে। এবার শুনছি তারা আকামার ফি চার হাজার ৮০০ রিয়াল করতে যাচ্ছে। তার মতে, সৌদি সরকার আকামার (দেশটিতে থাকার অনুমতিপত্র) ফি না কমালে আরো শ্রমিক ওই দেশ থেকে ফিরে আসবে।

এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, বিদেশের শ্রমবাজার চাঙ্গা রাখতে হলে দ্রুত সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতা আরো বাড়াতে হবে। নতুবা সম্ভাবনাময় শ্রমবাজারগুলো হাতছাড়া হওয়ার আশঙ্কা করছেন তিনি।

অপর এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, শুধু সৌদি আরব নয়, মালয়েশিয়া, কাতার কুয়েতসহ অন্যান্য দেশের পরিস্থিতিও বর্তমানে একই রকম। ওই সব দেশেও অবৈধভাবে থাকার অভিযোগে পুলিশি অভিযানে ধরা পড়ে ডিটেনশন ক্যাম্প ও কারাগারে আটক আছেন অনেক বাংলাদেশী।

এসব প্রসঙ্গে গতকাল প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব রৌনক জাহানের সাথে যোগাযোগ করা হলেও তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!