• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
সালিশের নামে হেনস্তা, বাড়ছে মামলা

কমছে সামাজিক সমঝোতা


নিজস্ব প্রতিবেদক অক্টোবর ১৫, ২০২০, ০১:৪০ পিএম
কমছে সামাজিক সমঝোতা

কেস স্টাডি-১ : মানিকগঞ্জের পিঁয়াজচর গ্রামে গ্রাম্য সালিশে এক স্কুলছাত্রীকে ‘চরিত্রহীন’ অপবাদ দিয়ে প্রকাশ্যে লোহার রড ও বাঁশের লাঠি দিয়ে মারপিট করা হয়, সাথে জরিমানাও করা হয় লাখ টাকা। গত ২১ আগস্ট এ ঘটনা ঘটে। সালিশ বৈঠকে ওই ছাত্রীর সঙ্গে তার তিন সহপাঠী বন্ধুকেও মারপিট এবং জরিমানা করা হয়। মারধরের পর মামলা করতে গেলে এসিড দিয়ে ঝলসে দেওয়ার হুমকিও দেওয়া হয় ওই ছাত্রীকে।

পরে থানায় মামলা হয়। গ্রেপ্তার করা হয় ঘটনার সঙ্গে জড়িত তিনজনকে। ৯ আসামির মধ্যে ৬ আসামি পলাতক রয়েছে।

হরিরামপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি তদন্ত) মোশারফ হোসেন জানান, স্কুলছাত্রীকে মারপিটের ঘটনায় ৯ জনকে আসামি করে মেয়েটির বাবা মামলা করেছেন। তিন আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।

কেস স্টাডি-২ : গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার গাছবাড়ি এলাকায় সম্প্রতি এক নারীকে ফোনকল রেকর্ড দিয়ে জিম্মি করে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে গ্রাম্য পশু চিকিৎসকের বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় ধর্ষণের শিকার নারীকে গ্রাম্য সালিশে মারধর ও অভিযুক্ত গ্রাম্য পশু চিকিৎসক আনোয়ার হোসেনকে দুই লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।

এলাকাবাসী ও ভিকটিমের পরিবার জানায়, কালিয়াকৈর উপজেলার গাছবাড়ি এলাকার এক নারীর সঙ্গে একই এলাকার মোস্তফা নামের এক যুবকের প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। মোস্তফার সঙ্গে ওই নারীর মোবাইল ফোনে কথা বলার বিষয়টি ওই এলাকার পশু চিকিৎসক আনোয়ার হোসেন জানতে পারেন। এরপর তিনি কৌশলে ওই নারীর মোবাইলে রেকর্ড অপশন অন করে রেখে পরে তার কাছ থেকে মোবাইল ফোনের রেকর্ড নিয়ে নেন। পরে আনোয়ার বিভিন্ন সময় ওই নারীকে ফোনে কুপ্রস্তাব দিয়ে এলেও তিনি রাজি হচ্ছিলেন না। এক পর্যায়ে ওই রেকর্ড ইন্টারনেটে ছেড়ে দেওয়ার হুমকি দেন আনোয়ার। সামাজিকভাবে নিগৃহীত হওয়ার ভয়ে ওই নারী গত শুক্রবার রাতে আনোয়ার হোসেনকে বাড়িতে ডেকে গোপনে মিলিত হন। বিষয়টি এলাকার লোকজন টের পেয়ে ওই নারীর ঘরের দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে দেন।

ওই নারীর পরিবারের অভিযোগ, বিষয়টি নিয়ে এলাকার মুরুব্বি আজমত আলী মোস্তফা, আজাহার, সাখাওয়াত হোসেন ও স্থানীয় ইউপি সদস্য গফুর সালিশে অভিযুক্ত আনোয়ার হোসেনকে দুই লাখ টাকা জরিমানা করেন এবং কানে ধরে উঠবস করান। এ সময় ওই নারীকে মারধর করা হয়। পরে জরিমানার টাকা ওই নারীকে দেওয়ার কথা থাকলেও তিনি আর টাকা পাননি। পরবর্তীতে এটি মামলায় গড়ায়।

কেস স্টাডি-৩ : সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজারে সালিশের রায় না মানায় একটি পরিবারকে চার মাস ধরে একঘরে করে রাখা হয়। সালিশে মাথা ন্যাড়া করার রায় দেয় মাতবর। ওই রায় না মানায় একঘরে করে রাখা হয় তাদের। ঘটনাটি গণমাধ্যমে প্রকাশ হলে টনক নড়ে প্রশাসনের। পরে ওই মাতবরদের বিরুদ্ধে মামলা হয়। শুধু এগুলোই নয়, প্রতিনিয়িত সালিশের নামে বিচারপ্রার্থীদের সামাজিক হেনস্তার খবর আসছে। ওই সালিশি বিচার না পেয়ে ভুক্তভোগীরা আদালতের শরণাপন্ন হচ্ছেন।

এসব কারণে একদিকে যেমন বাড়ছে মামলার চাপ অন্যদিকে সালিশি ব্যবস্থাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ছে।   

জানা যায়, যুগে যুগে সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় সালিশ পদ্ধতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। সমাজের নানা অসঙ্গতি অন্যায়-অবিচার দূর করতে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার পাশাপাশি সামাজিক বিচার ব্যবস্থা মানুষকে অনেক শান্তি, স্বস্তি ও নিরাপদ করেছে। কিন্তু এখন সালিশ বৈঠকে বসার আগে কিছু সংখ্যক ব্যক্তি কোনো না কোনোভাবে প্রভাবিত হয়ে পড়েন। ন্যায় নীতিকে অবজ্ঞা করে পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে পড়েন। এতে ব্যক্তি সাময়িক উপকৃত হলেও বিচারের বাণী যেন নিভৃতে কাঁদে। আর এ কারণে একদিকে যেমন মাতবরদের প্রতি অনাস্থা বেড়েছে তেমনি বেড়েছে মামলার চাপ। মূলত সমাজের ওইসব লোকের কারণে গ্রাম্য সালিশের সেই ঐতিহ্য আর নেই। মাতবরদের মানুষ এখন অনেকটাই ভয়ের চোখে দেখে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, সালিশি ব্যবস্থা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়েছে সমাজহিতৈষী কিছু ব্যক্তির জন্য। স্বেচ্ছাসেবামূলক এসব কাজে নিজের দায়িত্ববোধ ও নৈতিকতার প্রকাশ ঘটিয়ে সালিশিরা নিজেদের গৌরবান্বিত মনে করতেন। কিন্তু সময়ের সাথে মানুষের মানসিকতারও অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। মানুষ সব সময়ই আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।

তাই তাদের জন্য যেমন আইন আদালতের দরজা খোলা রয়েছে, ঠিক সেভাবে সালিশ বিচার ব্যবস্থাও পাশে রয়েছে। সামাজিক বিচার পদ্ধতির একটি ঐতিহ্যও রয়েছে। এই পদ্ধতি যুগে যুগে বাঁচিয়ে দিয়েছে দিশেহারা অনেক মানুষের প্রাণ। রুখে দিয়েছে হিংসা-বিদ্বেষ-সংঘাত ও অরাজকতাকে। কিন্তু বর্তমানে সালিশি এ ব্যবস্থাকে অনেকটাই প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলেছে মানুষে মানুষে আস্থা ও অবিশ্বাসের ঘটনা।

ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. কুদরাত-ই খুদা বাবু বলেন, সমাজে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অসামঞ্জস্যতা, ভুল বোঝাবুঝি, ব্যক্তির দ্বন্দ্ব, স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির বিরোধ হতেই পারে। আর এসব বিরোধীয় বিষয়গুলো সর্বক্ষেত্রে সরকারি কোর্ট কাচারি পর্যন্ত গড়াতে হয় না আমাদের সমাজের কিছু হিতৈষী ব্যক্তির কারণে।

এই হিতৈষী গুণিজন তাদের স্বার্থকে অনেকাংশে জলাঞ্জলি দিয়ে জনমুখী ও কল্যাণকর ভূমিকা পালনের মাধ্যমে এসব বিষয় নিষ্পত্তিতে বেশিরভাগ সফলতার কারণেই সমাজ একটি বিধিবদ্ধ নিয়মের গণ্ডির ভেতর আবর্তিত হয়। এই ক্ষেত্রে ফরিয়াদি বনাম বিবাদীর অধিকার সুরক্ষায় সমাজহিতৈষী সালিশানগণকে অত্যধিক সচেতন থাকতে হয়।

কিন্তু অপরাধের ধরন যদি হয় সমাজবিরোধী, যে অপরাধের কারণে পুরো সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে সেই ক্ষেত্রে আসামিদের অনেক অধিকার খর্ব করেই আইনানুগ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়।

তিনি বলেন, বর্তমান সমাজে আগের সেই দৃষ্টিভঙ্গি নেই। নানা সময়ে সমাজের এই লোকদের কিছু ভুলে আজ সালিশের মতো ঐতিহ্যকে আমরা নষ্ট করে ফেলেছি। আর এ কারণে মামলার চাপ বেড়েছে। মামলার চাপের কারণে একটি মামলা নিষ্পত্তি হতে বছরের পর বছর সময় লেগে যাচ্ছে। আদালতে যেতে যেতে বিচারপ্রার্থী যেমন নিঃস্ব হয়ে যায়, তেমনি নিঃস্ব হয় আসামিরাও।

রয়েল ভিশন ফাউন্ডেশনের পরিচালক ও মানবাধিকার কর্মী সাবরিনা আক্তার রিতা বলেন, একটি প্রাথমিক ধারণার ওপর ভিত্তি করে বিচার কাঠামো তৈরি করা একটি সুনির্দিষ্ট কর্মপন্থা অনুসরণ করে পক্ষগণের ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিগণের বক্তব্য আত্মস্থ করা, আলামত যাচাই ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক কাজ সম্পন্ন করা, বিচারিক বিষয়গুলো চিহ্নিত করা, এর বিচার সব দিক বিশ্লেষণে এটার মূল উৎপাটনের জন্য একটি স্বনির্ভর বাস্তবভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা।

কিন্তু দুঃখ ও পরিতাপের বিষয়, কিছুসংখ্যক স্বার্থভোগী সালিশ বিচারী নামধারী ভাড়ায় খাটা ব্যক্তির তুচ্ছ ও হীন স্বার্থের প্রাধান্যের কারণে এই সহজ সরল পন্থাগুলোকে অনেক ক্ষেত্রে জটিল করে ফেলা হয়। বিচারপ্রার্থী মানুষগুলোকে চরম ভোগান্তির শিকার হতে হয়। চরম হতাশায় মানুষ দিকভ্রান্ত হয়ে যায়। সমাজে কলহ ও অশান্তির বিস্তার ঘটে। সমাজ অশুভ পরিণতির দিকে ধাবিত হয়।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (ক্রাইম) কৃষ্ণপদ রায় বলেন, গ্রাম্য সালিশ বা সামাজিক বিচার ব্যবস্থা প্রচলিত আইনের বাইরে নয় বরং আইনের দ্বারা এটা একটি স্বীকৃত বিচার ব্যবস্থা। প্রাচীনকাল থেকেই এটার রেওয়াজ চলে আসছে। গ্রাম্য সালিশ বা সামাজিক বিচার ব্যবস্থায় মানুষের আস্থা অর্জন একটি অন্যতম প্রধান শর্ত এবং পক্ষগণকে সালিশের আওতায় নিয়ে আসার জন্য এটা একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।

কিন্তু অনেক সময় সালিশের নামে কিছু ঘটনা আমরা দেখতে পাই যা অনাকাঙ্ক্ষিত। তখন আমরা যারা ওই সালিশে জড়িত তাদের বিরুদ্ধেই আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়।

তিনি বলেন, সালিশ অবশ্যই বিরোধ মীমাংসার জন্য ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত একটি পদ্ধতি। তবে যারা সালিশ করবেন তাদের অবশ্যই প্রচলিত মেনেই কাজ করতে হবে। এছাড়া কিছু কিছু বিষয় সালিশের আওতায় পড়ে না, সে বিষয়গুলোও মাথায় রাখতে হবে। এক্ষেত্রে গ্রামগঞ্জে ধর্ষণের ঘটনা সালিশ করতে যাওয়া। ধর্ষণের মতো অপরাধ কোনোভাবেই সালিশে সমাধানযোগ্য নয়। বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে গ্রাম্য মাতবরদের।

আদালতে মামলার পাহাড় : গত ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে মামলা সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৬ লাখ ৮৪ হাজার ৭২৮টি। গত ১৫ জুলাইয়ে সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র মোহাম্মদ সাইফুর রহমানের পাঠানো তথ্য বিবরণী থেকে এ তথ্য জানা যায়।

মামলার পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত আপিল বিভাগে বিচারাধীন আছে ২৩ হাজার ৬১৭টি মামলা। আর হাইকোর্ট বিভাগে ৪ লাখ ৮৯ হাজার ৬৮টি মামলা। সব মিলিয়ে সারা দেশে মোট বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৩৬ লাখ ৮৪ হাজার ৭২৮টি।

এদিকে ২০১৯ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত আপিল বিভাগে নিষ্পত্তি হয়েছে ৬ হাজার ৩০৩টি মামলা। হাইকোর্ট বিভাগে ১ লাখ ৩৫ হাজার ২৭৫টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। আর সারা দেশের অধস্তন আদালতগুলোকে নিষ্পত্তি হয়েছে ১০ লাখ ২৪ হাজার ৩৫৭টি মামলা।

এর আগে ২০১৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ছিল ৩৩ লাখ ৯ হাজার ৭৮৯টি।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!