• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ, ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০
জাল অনুমতিপত্রে দেওয়া হচ্ছে জমি লিজ

কমিটি আর পরিকল্পনায় থমকে আছে রেল


বিশেষ প্রতিনিধি নভেম্বর ১৪, ২০১৯, ১২:৫০ পিএম
কমিটি আর পরিকল্পনায় থমকে আছে রেল

ফাইল ছবি

ঢাকা : বদনাম আর অনিয়ম যেন পিছু ছাড়ছে না বাংলাদেশ রেলওয়ের। রেল নিয়ে নানা পরিকল্পনা হয়, সরকারের ঘোষণা হয় ডাকঢোল পিটিয়ে কিন্তু বাস্তবায়ন শূন্য। যেন কাজির গরু হিসাবে আছে, গোয়ালে নেই। সেবার মান নিয়ে সাধারণ মানুষের অসন্তুষ্টিরও শেষ নেই। এমনকি জাল অনুমতিপত্রে রেলের জমি লিজ দেওয়ারও তথ্য পাওয়া গেছে।

ব্যবস্থাপনা ঘাটতি আর দুর্নীতির বড় উদাহরণ হিসেবে মুখ থুবড়ে রয়েছে রেল। সর্বশেষ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় সংঘটিত দুর্ঘটনায় আবারো বাংলাদেশ রেলেওয়ের ব্যবস্থাপনা প্রশ্নের মুখে পড়েছে। গত ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে টানা তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করে ক্ষমতাসীন হয় আওয়ামী লীগ। মন্ত্রণালয়ে নতুন মন্ত্রী দেন প্রধানমন্ত্রী। মুজিবুল হককে সরিয়ে দায়িত্ব দেওয়া হয় মো. নূরুল ইসলাম সুজনকে। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারেও রেলপথ মন্ত্রণালয়কে নিয়ে বেশকিছু প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।

মন্ত্রণালয়ের কাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে গঠন করা হয় নতুন সংসদীয় কমিটি। কমিটির সভাপতি এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী।

কমিটির সদস্য আসাদুজ্জামান নূর, শফিকুল ইসলাম শিমুল, মো. শফিকুল আজম খান, মো. সাইফুজ্জামান, এইচ এম ইব্রাহিম, নাছিমুল আলম চৌধুরী, গাজী মোহাম্মদ শাহ নওয়াজ এবং নাদিরা ইয়াসমিন জলি।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, কালোবাজারে টিকিট বিক্রি, মাদক পরিবহনের মাধ্যম হিসেবেও রেলকে সংঘবদ্ধ চক্র ব্যবহার করে থাকে। অবৈধ মালামাল পরিবহনে যেন নিরাপদ রেল। ট্রেনে অবৈধ মালামাল পরিবহন প্রতিরোধ ও যাত্রীর নিরাপত্তার স্বার্থে ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টেশনে বডি স্ক্যানার এবং ল্যাগেজ স্ক্যানার দ্রুত স্থাপনের পরামর্শ থাকলেও তার বাস্তবায়ন নেই।

এছাড়া ঢাকা ও চট্টগ্রামের পাশাপাশি পর্যায়ক্রমে দেশের সব জেলা ও উপজেলা স্টেশনেও বডি স্ক্যানার এবং ল্যাগেজ স্ক্যানার স্থাপনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। সেটিও অদ্যাবধি আলোর মুখ দেখেনি।

বাংলাদেশ রেলওয়ের পুনর্গঠন একটি চলমান প্রকল্প। সেটিও কেবল অর্থব্যয়ের জন্য নামে চলছে। প্রকল্পটির আওতায় যথাযথ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে প্রয়োজনে আউটসোর্সিং করে এন্টারপ্রাইজ রিসোর্স প্ল্যানিং সিস্টেমটি (ইআরপি) বাস্তবায়ন করার কথা ছিল, যা আজো করা হয়নি।

সবচেয়ে বড় অনিয়ম রেলের সম্পদ বেদখল। হুঁশিয়ারি আর কমিটির পর কমিটি গঠন করা হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। বর্তমানে মন্ত্রণালয় ও সংসদীয় কমিটির আলাদা ব্যক্তিদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি ও একটি সাব-কমিটি গঠন করা হয়েছে কেবল রেলের বেদখল জমি উদ্ধারে।

রেলওয়ে সূত্র বলছে, বাংলাদেশ রেলওয়ের ৪ হাজার ৩৯১ একর জমি এখন বেদখলে। প্রভাবশালী অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এসব জমি দখল করে আছে। দখলদাররা কোথাও মার্কেট, কোথাও বাজার আবার কোথাও বস্তি করে কোটি কোটি টাকা আয় করছে। অনেক জায়গায় আবার রাজনৈতিক কার্যালয়ও আছে। বছরের পর বছর চলে গেলেও এসব জমি উদ্ধার করতে পারছে না রেলওয়ে।

রেলওয়ে সূত্র বলেছে, সারা দেশে বর্তমানে রেলওয়ের মোট জমি ৩১ হাজার ৮৬০ একর। এর মধ্যে পূর্বাঞ্চলে ১ হাজার ৪ একর এবং পশ্চিমাঞ্চলে ৩ হাজার ৩৮৭ একর জমি বেদখল হয়ে আছে। পূর্বাঞ্চলের দখল হওয়া জমির মধ্যে ৭৮০ একর জমি ঢাকা বিভাগে এবং ২২৩ একর জমি চট্টগ্রামে বিভাগে। পশ্চিমাঞ্চলের মধ্যে ৯১৭ একর জমি লালমনিরহাট অঞ্চলে এবং ২ হাজার ৪৭০ একর জমি পাকশী অঞ্চলে। অর্থাৎ সবচেয়ে বেশি জমি বেদখল হয়েছে পাকশী অঞ্চলে।

গত ১০ বছরে সরকার সাড়ে তিনশ কিলোমিটার নতুন রেললাইন নির্মাণ করেছে। করা হয়েছে ৯১টি স্টেশন বিল্ডিং। এছাড়া আড়াই কিলোমিটার মিটারগেজ থেকে ডুয়েলগেজে রূপান্তর, নতুন ৭৯টি রেলস্টেশন নির্মাণ এবং ২৯৫টি রেলসেতু নির্মাণ করা হয়েছে। রেলওয়ের পরিকল্পিত উন্নয়নের জন্য ৩০ বছর মেয়াদি একটি মাস্টার প্ল্যান অনুমোদিত হয়েছে। প্রায় ৫০০ যাত্রীবাহী কোচ পুনর্বাসন শেষে রেলওয়ের বহরে সংযুক্ত করা হয়েছে। তবে রেলকে লোকসান থেকে ফেরানো যায়নি। উদ্ধার হয়নি রেলের বেদখল জমিও।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রেলের বেহাত জমি উদ্ধারে আগে দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা। এটি ছাড়া যত কমিটিই গঠন আর উদ্যোগ নেওয়া হোক না কেন, কাজে আসবে না। সরকারের সদিচ্ছা থাকলে জমি উদ্ধার সময়ের ব্যাপার মাত্র। তারপরও হয়তো রেলপথ মন্ত্রণালয়কে মামলা মোকাবিলা করতে হবে। দখলকারীদের বেশিরভাগের সঙ্গেই রাজনৈতিক দলের সম্পর্ক আছে। এ কারণেই অধিকাংশ সময় দখলমুক্ত করা যায় না। তবে রেলওয়ের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশেও জমি দখলের অভিযোগ আছে। একইভাবে ভাবমূর্তি আর লোকসান কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াবে রেল।

জানা গেছে, দলখদাররা কেউ কেউ জমিতে অবৈধভাবে দ্বিতল ভবন নির্মাণ করেছেন। কেউ কেউ একতলা ভবন নির্মাণের পর দোতলার কাজ শুরুর অপেক্ষায়। রেলওয়ের ভূ-সম্পত্তি বিভাগের অনুমোদন ছাড়া রেলের কোনো জায়গা লিজ দেওয়ার কোনো নিয়ম নেই। কোনো জায়গা বরাদ্দের ক্ষেত্রে আবেদনপত্র পাওয়ার পর সার্বিক যাচাই-বাছাই করে তা এক বছরের জন্য লিজ দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে রেল কর্তৃপক্ষ প্রতিবার এক বছর করে লিজের মেয়াদ বাড়াতে পারে। তবে সম্পত্তি বিভাগের মতামত ছাড়া রেলের অন্য কোনো বিভাগের জমি লিজের অনুমোদন দেওয়ার এখতিয়ার নেই।

কিন্তু রেলেরই কিছু অসাধু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে টাকার বিনিময়ে জাল অনুমতিপত্র বিক্রি করার অভিযোগ রয়েছে। এ কারণেই হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে রেলওয়ের বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি।

এ ব্যাপারে রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলামকে ফোন করলেও তিনি ব্যস্ত আছেন বলে জানান। পরে সচিব মো. মোজাম্মেল হোসেনকে ফোন করলে তিনিও ফোন ধরেননি।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!