• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

করোনাকালে বেকারত্ব ও দরিদ্রতর বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ


অলোক আচার্য অক্টোবর ২০, ২০২০, ০২:৩৪ পিএম
করোনাকালে বেকারত্ব ও দরিদ্রতর বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ

ঢাকা : করোনার প্রথম ধাক্কা সামলে বিশ্ব এখন দ্বিতীয় ঢেউয়ের মুখোমুখি হচ্ছে। চীনের উহান প্রদেশ থেকে শুরু হয়ে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। তারপর সংখ্যার গণনায় প্রতিদিন বাড়তে থাকে মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা, যা এখনো চলছে। এই সংখ্যা প্রতিদিন দীর্ঘ হচ্ছে। প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে এই তালিকায় যোগ হচ্ছে নতুন নতুন সংখ্যা। কোথায় গিয়ে এর তাণ্ডব থামবে তা হয়তো কারোরই জানা নেই। বলা যায়, ভ্যাকসিন আবিষ্কারের পর এর প্রকোপ কমে আসবে। তবে এত বিপুলসংখ্যক মানুষকে ভ্যাকসিনের আওতায় আনতে বেশ সময় লাগবে। যেসব দেশে প্রথম দিকে এই ভাইরাসের প্রকোপ বেশি ছিল, সেসব দেশে এর প্রকোপ কিছুটা কমেছে। প্রথমে করোনার ধাক্কা সামলাতে দেশগুলো লকডাউনের পথে হাঁটে। এ সময় বন্ধ হয়ে যায় নিত্য বাণিজ্যসহ যাবতীয় কার্যক্রম। প্রাণের মতোই স্তব্ধ করে দিচ্ছে বিশ্বের অর্থনীতি, রাজনীতি, খেলাধুলা, শিল্পচর্চা সবকিছু। তারপর একসময় নিউ নর্মালকে মানুষ স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করে নেয়। এছাড়া মানুষের কাছে বিকল্প নেই। সোজা কথায় পেটের তাগিদে মানুষ কাজে নেমে পড়ে। স্বাভাবিক হওয়ার আগে করোনা ভাইরাসের জন্য প্রাণের পরেই ক্ষতি হয় অর্থনীতির। আর অর্থনৈতিক কার্যক্রম বন্ধ থাকলে তা দেশের উন্নয়নের গতি স্তব্ধ করে দেয়। মানুষ বেকার হয়। সেই ধাক্কা সামলানো বেশ কঠিন। এটা শুধু আমাদের দেশের অবস্থা নয়। সারা বিশ্বেরই কম-বেশি একই পরিস্থিতি। করোনা ভাইরাস মহামারীতে বিপর্যস্ত যুক্তরাজ্যে বেকারত্বের হার তিন বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পৌঁছেছে এবং তা অর্থনীতিবিদদের পূর্বাভাসকেও ছাড়িয়ে গেছে। এ বছরের জুন থেকে আগস্টের মধ্যে তিন মাসেই বেকারত্বের হার এক দশমিক চার শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে চার দশমিক পাঁচ শতাংশ। যুক্তরাজ্যের জাতীয় পরিসংখ্যান কার্যালয়ের (ওএনএস) হিসাব মতে, এই সময়ে ১৫ লাখ মানুষ বেকার হয়েছে। এই সংখ্যা এক বছর আগের তুলনায় দুই লাখ নয় হাজার বেশি।

করোনা ভাইরাসের প্রভাবে সারা বিশ্বেই দরিদ্রতা গ্রাস করছে। ভয়াবহভাবে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেটা সামাল দেয়া প্রত্যেক দেশের জন্যই চ্যালেঞ্জের। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য। কারণ বেকারত্ব ঘিরে ধরছে এবং সেই সঙ্গে বহু মানুষ চাকরি হারিয়েছে। চাকরি হারানোর এই প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে, যা দারিদ্র্যকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলছে। শিশুদের ওপরও এই প্রভাব পড়বে। গত এপ্রিলে জাতিসংঘ জানিয়েছিল, করোনাভাইরাসের প্রভাবে বিশ্বজুড়ে ৪ কোটি ২০ লাখ থেকে ৬ কোটি ৬০ লাখ শিশু চরম দারিদ্র্যের মুখে পড়তে পারে। ২০১৯ সাল থেকেই চরম দারিদ্র্য অবস্থায় ছিল প্রায় সাড়ে ৩৮ কোটি শিশু। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত সূত্রে জানা যায়, দুই দশকেরও বেশি সময়ের মধ্যে প্রথমবারের মতো বিশ্বে চরম দারিদ্র্য বাড়ছে। বিশ্বব্যাংক সতর্ক করে বলেছে, করোনাভাইরাসের কারণে চলতি বছর চরম দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ১১ কোটি ৫০ লাখে পৌঁছাবে। ২০২১ সালে এ সংখ্যা ১৫ কোটি ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করছে ব্যাংকটি। এদিকে করোনা বিশ্বের অনেক মানুষকে দারিদ্র্যের দিকে টেনে অতি ধনীদের পৌঁছে দিচ্ছে অনন্য উচ্চতায়। সুইস ব্যাংকের ইউবিএসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ বছরের এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত বিশ্বের ধনী ব্যক্তিদের সম্পদ রেকর্ড সাড়ে ২৭ শতাংশ বেড়েছে। করোনাভাইরাস পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষের জীবিকায় প্রভাব ফেলছে। ফলে মানুষ জীবনযাপন প্রক্রিয়া বদলাতে বাধ্য হচ্ছে। বিশেষ করে বেসরকারি চাকরিজীবীদের ক্ষেত্রে চাকরিচ্যুতি, কম বেতনে জীবনযাপন করার মতো ঘটনাও ঘটেছে। যদিও সে পরিস্থিতির ক্রমোন্নতি ঘটছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-এর প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি বছরের শেষ নাগাদ বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি না হয়ে বরং ৪ দশমিক ৪ শতাংশ সংকুচিত হয়ে যাবে। তবে উদীয়মান দেশগুলোর মধ্যে খুব কম দেশই প্রবৃদ্ধির মুখ দেখবে।

গত দুই দশকে বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্য বিমোচন এবং বৈষম্য রোধে যে অগ্রগতি হয়েছে করোনার প্রভাবে সেটি উল্টোপথে যাচ্ছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনার প্রভাবে সারা বিশ্বের অর্থনীতিই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিশেষ করে স্বল্প আয়ের খেটে খাওয়া মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মানুষের আয় কমে যাওয়া এক দশমিক নয় ডলার দৈনিক আয় করেন এমন দারিদ্র্যরেখার নিচে চলে আসবে নতুন করে নয় কোটি মানুষ। করোনার কারণে অর্থনীতিতে যে পরিবর্তন আসতে চলেছে তা খুব দ্রুতই শেষ হবে না। পরবর্তী দশকে অর্থনীতির এই ধারা বিশ্বকে ভোগাবে। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। অর্থনীতিকে করোনার প্রভাব নিয়ে চিন্তা করতে হবে কয়েকটি দিক থেকে। এক. যখন করোনা ভাইরাস তার তাণ্ডব চালাচ্ছে তখন অর্থনীতিকে কীভাবে সামাল দেয়া যায়। দুই. করোনা ভাইরাসের প্রভাব যখন কমে আসবে তখন অর্থনীতি পুনর্গঠনে মনোযোগ দেওয়া এবং সর্বশেষ দীর্ঘমেয়াদি অর্থনীতিতে যে ক্ষত থাকবে তা সারাতে দীর্ঘমেয়াদে ব্যবস্থা গ্রহণ। দরিদ্রতা মানুষের এমন এক অবস্থা যে তা থেকে মুক্তি পেতে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন দরকার হয় এবং সেই সঙ্গে পর্যাপ্ত সুযোগের। প্রয়োজনীয় কর্মসংস্থান সৃষ্টি করাটাও সময়সাধ্য। কারণ এরই মধ্যে নতুন করে চাকরির বাজারে প্রবেশের অপেক্ষায় থাকবে অনেকে। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে নতুন করে যে দরিদ্র মানুষের হার বাড়বে, সেই তালিকায় উদীয়মান দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ, ব্রাজিল, নাইজেরিয়ার নাম রয়েছে। এর বিপরীত চিত্রও রয়েছে। একদিকে যেমন দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, অন্যদিকে অতি ধনীরা আরো ধনী হচ্ছে। সুইস ব্যাংক ইউবিএসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ বছরের এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত বিশ্বের ধনী ব্যক্তিদের সম্পদ রেকর্ড সাড়ে ২৭ শতাংশ বেড়েছে। শতকোটির সংখ্যাও ২০১৭ সালের তুলনায় বেড়েছে।

আমাদের অর্থনীতির একটি বড় শক্তি হলো গার্মেন্ট খাত। পোশাক শিল্পের ওপর নির্ভর কর্মসংস্থানের একটি বিশাল অংশ। সম্ভাবনাময় এবং অর্থনীতিকে শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে যাওয়া এই খাতের রপ্তানি আয় আমাদের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করছে। কারণ বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের মধ্যে বেশিরভাগই পোশাক। সেই পোশাক খাতও জেগে উঠছে। প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রাও ছাড়াচ্ছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যে জানা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছরের সেপ্টেম্বর শেষে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে রপ্তানি বেড়েছে দুই দশমিক ৪৫ শতাংশ এবং গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় আয় বেড়েছে দুই দশমিক ৫৮ শতাংশ। এ সময় দেশের রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২ দশমিক ৯ শতাংশ বেশি হয়েছে। এছাড়া প্রবৃদ্ধি হয়েছে শূন্য দশমিক ৮৫ শতাংশ। তথ্য অনুযায়ী, নতুন অর্থবছরের (জুলাই-সেপ্টেম্বর) প্রথম তিন মাসে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৯৬৬ কোটি মার্কিন ডলার। এর বিপরীতে আয় হয়েছে ৯৮৯ কোটি ৬৮ লাখ বা (৯.৮৯ বিলিয়ন ডলার)। কেবল পোশাক শিল্পই নয়, অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে হলে আরো কয়েকটি বিষয়কে ঘুরে দাঁড়াতে হবে। এর মধ্যে গ্রামীণ অর্থনীতি রয়েছে। প্রবাসীদের দেশে আসা এবং শহর থেকে বেকার হয়ে গ্রামে চলে যাওয়ায় গ্রামীণ অর্থনীতিতে চাপ পড়েছে। যদিও এখন ক্রমেই তা স্বাভাবিক হওয়ার পথে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ঘুরে দাঁড়াতে প্রণোদনার অর্থ দিয়ে তাদের ব্যবসার স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে সাহায্য করতে হবে। কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি তরুণদের ভেতর আত্মকর্মসংস্থানের মনোভাব গড়ে তুলতে হবে। উদ্যোক্তা সৃষ্টি করতে হবে। একজন উদ্যোক্তা অনেকের চাকরির নিশ্চয়তা দিতে পারে।

লেখক : শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক
[email protected]

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!