• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

করোনাভাইরাসের শতভাগ ঝুঁকিতে ঢাকা


উম্মুল ওয়ারা সুইটি ও প্রতীক ইজাজ ফেব্রুয়ারি ৮, ২০২০, ০৯:৩২ এএম
করোনাভাইরাসের শতভাগ ঝুঁকিতে ঢাকা

নভেল করোনাভাইরাসের শতভাগ ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ। রোগটির সংক্রমণের সব পরিবেশই এখানে বিদ্যমান। বিশেষ করে চীনের সঙ্গে যোগাযোগ নিবিড় হওয়ায় যেকোনো সময় রোগটির সংক্রমণ হতে পারে।

জনসংখ্যার ঘনত্ব, বাস-ট্রেন-লঞ্চে একসঙ্গে গাদাগাদি করে মানুষের যাতায়াত, হাঁচি-কাশির ব্যাপারে অসচেতনতা ও হাত ধোয়ার প্রবণতা কম হওয়ায় সংক্রমণের ঝুঁকি রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকি ঢাকায়।

অন্যদিকে আক্রান্তের চিকিৎসার ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনায় এখনো দুর্বলতা রয়েছে দেশে। রোগী বেড়ে গেলে হাসপাতালে আইসোলেশন করে কীভাবে রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হবে, সেটা নিয়েও উদ্বেগ রয়েছে। সংক্রমণ প্রতিরোধে হাসপাতালগুলোয় যথোপযুক্ত পরিবেশ নেই। স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যেও এ ব্যাপারে অসচেতনতা রয়েছে।

বিশেষ করে করোনাভাইরাস রোগী শনাক্ত করা ও চিকিৎসা দেওয়ার ব্যাপারে যেসব সতর্কতা ও ব্যবস্থাপনা দরকার, সেটা এখানে কতটুকু সম্ভব সে নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন রোগতত্ত্ববিদ ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। তাদের মতে, হাসপাতাল থেকেই আক্রান্ত ব্যক্তির মাধ্যমে করোনাভাইরাস ছড়ানোর আশঙ্কা বেশি।

এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর,বি) পরামর্শক ও সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. মাহমুদুর রহমান বলেন, বিশ্বব্যাপী ঝুঁকির কথা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বলে দিয়েছে। সে ঝুঁকি আমাদের জন্যও। মূলত দুই কারণে এখানে ঝুঁকি বেশি এক. রোগী শনাক্ত করতে আর্লি ডায়াগনসিস ও দুই. আক্রান্তদের চিকিৎসায় হাসপাতাল তৈরি করা। এই দুই ক্ষেত্রেই আমাদের দুর্বলতা রয়েছে। এ দুটি ঠিকমতো করতে পারলে, করোনাভাইরাস মোকাবিলা সম্ভব।

আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, শুধু বাংলাদেশই নয়, যেকোনো সময় যেকোনো দেশ সংক্রমণ হতে পারে। এ ঝুঁকি আমাদের জন্য শতভাগ। সংক্রমণের সব উপাদানই এখানে রয়েছে। কারণ চীনের সঙ্গে যোগাযোগ নিবিড়। এখনো চীন থেকে লোকজন আসছে।

ঝুঁকির মূল কারণ দুটি উল্লেখ করে এ বিশেষজ্ঞ বলেন, রোগটি শনাক্ত করা ও আক্রান্ত ব্যক্তির চিকিৎসায় প্রয়োজনীয় লজিস্টিক সাপোর্ট এবং হাসপাতালকে সংক্রমণমুক্ত রাখাই আমাদের মূল ঝুঁকি। আমাদের হাসপাতালগুলোর ইনফেকশন ব্যবস্থা শক্তিশালী নয়। তাই এখান থেকেই ছড়ানোর আশঙ্কা বেশি।

এদিকে চীনে ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়া নভেল করোনাভাইরাস যেন কিছুতেই দেশে ছড়িয়ে পড়তে না পারে সেজন্য সর্বোচ্চ সতর্ক ব্যবস্থা নিয়েছে বাংলাদেশ সরকার।

স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভাইরাসটি যেন কোনোভাবেই বাংলাদেশে আসতে না পারে সে বিষয়ে সতর্ক থাকার নির্দেশনা দিয়েছেন। এরই অংশ হিসেবে রোগটির সংক্রমণ ঠেকাতে বিভিন্ন উদ্যোগের পাশাপাশি এই মুহূর্তে বাংলাদেশ থেকে চীনে ও চীন থেকে বাংলাদেশে সব ধরনের ভ্রমণ স্থগিত করা হয়েছে। ইতিমধ্যেই চীন থেকে ৩১২ জন বাংলাদেশিকে দেশে এনে আশকোনা হজক্যাম্পে কোয়ারেন্টাইন করে রাখা হয়েছে। কারও ব্যাপারে কোনো সন্দেহ দেখা দিলে তাকে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে আইসোলেশন করে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। আক্রান্ত রোগীর সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে আগাম প্রস্তুতি হিসেবে সারা দেশের সরকারি হাসপাতালে আইসোলেশন ইউনিট খোলার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। গতকালও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পৃথক ইউনিট খোলা হয়েছে।

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ দেশের তিন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে চীনসহ ইতিমধ্যেই যেসব দেশে রোগটি দেখা দিয়েছে, সেখান থেকে আসা সবাইকে স্ক্রিনিং করা হচ্ছে। দেশের সব স্থল ও নৌবন্দরে বিভিন্ন দেশ থেকে আসা যাত্রীদের স্বাস্থ্যপরীক্ষা করা হচ্ছে। প্রতিদিন রোগটির সর্বশেষ তথ্য দিতে আইইডিসিআর সংবাদ সম্মেলন করছে।

ঝুঁকির কথা উল্লেখ করে অধ্যাপক ডা. মাহমুদুর রহমান বলেন, বাংলাদেশ ঝুঁকির মধ্যেই রয়েছে। কারণ আমাদের লোকজন চীন থেকে এখনো আসছে। এখন দরকার যারা আসছে তাদের আর্লি ডায়াগনসিস করা। টেস্ট করে সঙ্গে সঙ্গে আইসোলেট করতে হবে যাতে তার থেকে না ছড়ায়। অন্যান্য দেশে আসার সঙ্গে সঙ্গে নাগরিকদের আলাদা করে রাখা হচ্ছে।

এ বিশেষজ্ঞ বলেন, হাসপাতাল প্রস্তুত রাখতে হবে। আইসিইউ লাগবে। আইসোলেট করার ব্যবস্থা করতে হবে। কোয়ারেন্টাইন করে রাখা হয় সুস্থ ব্যক্তিদের। যারা আক্রান্ত তাদের আইসোলেট করে রাখতে হয়। আমাদের এখানে আইসোলেশন ব্যবস্থা কম। আশকোনায় সবাইকে আলাদা করে রাখা উচিত। আর যদি আক্রান্ত ব্যক্তি পাওয়া যায়, তাহলে কুর্মিটোলায় আইসোলেট রেখে চিকিৎসা দিতে হবে। তবে আক্রান্ত ব্যক্তিদের এক রুমে রাখা যেতে পারে। কারণ তাদের সবাই আক্রান্ত। আর যারা আক্রান্ত হয়নি, তারা সুপ্ত অবস্থাতেই অন্যদের আক্রান্ত করতে পারে। সেজন্য তাদের আলাদা করে রাখতে হবে।

‘তবে করোনাভাইরাস নিয়ে এত আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটা ইনফ্লুয়েঞ্জার চেয়ে কম ছড়ায়। আক্রান্ত ব্যক্তির সরাসরি সংস্পর্শে না এলে রোগটি ছড়াবে না। তাছাড়া আক্রান্ত ব্যক্তি কাশি বা থুতু হাতে লাগলে সে থেকে ছড়াতে পারে। এটা ছোঁয়াচে রোগ।

ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, চীন থেকে কেউ অগোচরে এসে যাতে রোগটি ছড়াতে না পারে, সেজন্য সার্ভিলেন্স ব্যবস্থা জোরালো করা হয়েছে। তবে আমাদের ভয়টা যদি একসঙ্গে বেশি আক্রান্ত হয়, তাহলে। কারণ আমাদের হাসপাতালে ল্যাবরেটরি সার্ভিস ও সংক্রমণ প্রতিরোধ ব্যবস্থা শক্তিশালী নয়। হাসপাতালকে নিয়েই বেশি ভয়। সেখান থেকেই ছড়ানোর আশঙ্কা বেশি। এ বিশেষজ্ঞ বলেন, মুরগিসহ প্রাণীর বাজার থেকেও ছড়াতে পারে। সেখানকার পরিবেশ খুবই উদ্বেগজনক। আমাদের শঙ্কার জায়গা হলো আমাদের ব্যবস্থাপনা।

আইইডিসিআর পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা ‘বাংলাদেশ ঝুঁকির মধ্যেই রয়েছে’ বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, এখন পৃথিবী অনেক কাছে চলে এসেছে। চীন থেকে এখনো লোকজন আসছে। তাই ঝুঁকিও রয়েছে। আর সেজন্যই এত প্রস্তুতি।

এ বিশেষজ্ঞ ঝুঁকির জায়গাগুলো চিহ্নিত করে বলেন, করোনাভাইরাস আসবে কি আসবে না, সেটাই ঝুঁকি। মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায়। এখানে ঘনবসতি। মানুষের জীবানাচরণ ঝুঁকিপূর্ণ। যেমন হাত ধোয়ার প্রবণতা কম। সর্দি-কাশির ক্ষেত্রে আমরা সতর্ক নই। বিশেষ করে ঢাকা শহরে ঝুঁকি বেশি। একসঙ্গে অনেক লোক বাসে-লঞ্চে-ট্রেনে গাদাগাদি করে যাতায়াত করে। এগুলো ঝুঁকির জায়গা। সবচেয়ে ভয় বেশি যদি একসঙ্গে অনেকজন আক্রান্ত হয়, তাহলে কীভাবে আইসোলেশন করা হবে, সেটা চিন্তার বিষয়।

এ বিশেষজ্ঞ আরও জানান, আমরা কুর্মিটোলায় আইসোলেট করে রাখছি। সেজন্য সেখানে এখন অন্য রোগী ভর্তি করা হচ্ছে না। তবে আমাদের প্রস্তুতি রয়েছে। এখন সচেতন থাকতে হবে। সতর্কতা দরকার। উহানফেরত পাইলট-ক্রুরাও পর্যবেক্ষণে : চীনের উহান থেকে ফিরিয়ে আনা ৩১২ জন বাংলাদেশির কারও মধ্যে সংক্রমণের লক্ষণ দেখা না গেলেও সতর্কতা হিসেবে ওই ফ্লাইটের পাইলট ও ক্রুদেরও যার যার বাড়িতে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে।

আইইডিসিআর পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের এ কথা জানান। তিনি বলেন, চীন থেকে ঘুরে আসা ডাক্তার ও বিমানকর্মীরা হোম কোয়ারোন্টিনে আছেন। তাদের এখন বাইরে যাতায়াত না করার পরামর্শ দিয়েছি আমরা।

এ ভাইরাস অন্যান্য দেশে ছড়াতে থাকায় ডব্লিউএইচও বৈশ্বিক সতর্কতা জারি করেছে। আরও কয়েকটি দেশের মতো বাংলাদেশও গত ১ ফেব্রুয়ারি উহানের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৩১২ জন বাংলাদেশি শিক্ষার্থী ও গবেষককে ফিরিয়ে এনেছে। তাদের কারও মধ্যে ভাইরাস সংক্রমণের তথ্য পাওয়া না গেলেও সাবধানতার অংশ হিসেবে রাখা হয়েছে ১৪ দিনের পর্যবেক্ষণে। তাদের আনতে চারজন চিকিৎসক, চারজন ককপিট ক্রু ও ১১ জন কেবিন ক্রুকে পাঠানো হয়েছিল বিমানের একটি উড়োজাহাজে করে। সংক্রমণ এড়াতে মাস্ক, স্যানিটাইজার, ডিসপোজেবল গাউনসহ বিভিন্ন সরঞ্জামও তাদের সঙ্গে দেওয়া হয়েছিল।

কিন্তু উহান ঘুরে এসেছেন বলে ওই ফ্লাইটের পাইলটরা আপাতত কয়েকটি দেশে প্রবেশের অনুমতি পাচ্ছেন না বলে গত ৩ ফেব্রুয়ারি জানিয়েছিলেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম।

এ পরিস্থিতিতে অন্য কোনো পাইলটকেও আর চীনে পাঠানোর ঝুঁকি নিতে পারছে না বাংলাদেশ। ফলে দেশে ফিরতে আগ্রহী ১৭১ বাংলাদেশিকে উহানেই অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে। সংবাদ সম্মেলনে অধ্যাপক ফ্লোরা বলেন, উহানফেরত কারও মধ্যে করোনাভাইরাস সংক্রমণের কোনো লক্ষণ এখনো পাওয়া যায়নি।দেশ রূপান্তর

সোনালীনিউজ/এইচএন

Wordbridge School
Link copied!