• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

করোনার আঘাতে লণ্ডভণ্ড হতে চলেছে অর্থনীতি


সোনালীনিউজ ডেস্ক এপ্রিল ৫, ২০২০, ০৮:৫৭ এএম
করোনার আঘাতে লণ্ডভণ্ড হতে চলেছে অর্থনীতি

করোনার আঘাতে লণ্ডভণ্ড হতে চলেছে অর্থনীতি। সব রকমের ব্যবসা—বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রায় স্থবির। পণ্য ও সেবার উৎপাদন, বিপণন, আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম অনিশ্চিত ও অচলাবস্থায়। সরকার যখন রাজস্ব আয়ের দুর্বলতায় ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ধার-কর্জ করে বাজেট বাস্তবায়নের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল, তখনই এলো করোনার আঘাত। এতে লাখো মানুষ অচলাবস্থায়। হাত থেকে একে একে ফসকে যাচ্ছে রপ্তানি আদেশ। প্রাতিষ্ঠানিক থেকে ব্যক্তি পর্যায় পর্যন্ত অর্থনৈতিক দুরবস্থার ক্ষেত্র ক্রমেই বাড়ছে।

সরকারের সামনে তীব্রতর হচ্ছে অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার চ্যালেঞ্জ। এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রপ্তানি খাতের কর্মীদের বেতন-ভাতার জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকার বিশেষ তহবিলসহ বেশ কিছু প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন। 

পরের ধাপে দিয়েছেন ৩১ দফা নির্দেশনা—যেখানে তিনি সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনী, দিনমজুর-কৃষকদের খাবার দেওয়া, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড গতিশীল রাখা, খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থা এবং দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে বলেছেন। আজ তিনি আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনও করবেন। সেখানে দিতে পারেন আরো নতুন কোনো অর্থনৈতিক প্রণোদনার ঘোষণা।

সরকারের সামনে এখন হাজারো খাতের, লাখো শিল্প-সেবা খাতের মন্দা মোকাবেলায় সহায়তার দাবি। সীমিত সম্পদ কাজে লাগিয়ে সরকার কাকে কিভাবে সান্ত্বনা দেবে, আয়-ব্যয়ের মধ্যে ভারসাম্য আনবে কিভাবে—এই প্রশ্ন সর্বত্র।

পরিস্থিতির বিবেচনায় দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো পুনর্গঠনের দাবি উঠেছে বিভিন্ন মহলে। সরকারের ব্যয় ব্যবস্থাপনায় কৃচ্ছ্র সাধনসহ অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প কাটছাঁট করা, উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে সহজ শর্তে ঋণ ও আর্থিক সহায়তা নেওয়ারও সুপারিশ করা হয়েছে। প্রয়োজনে টাকা ছাপিয়ে ব্যয় মেটানোর সুপারিশ করেছেন অর্থনীতিবিদরা।

সরকারের অন্যতম নীতিনির্ধারক, পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ও সিনিয়র সচিব অধ্যাপক ড. শামসুল আলম বলেন, ‘আমরা অনিবার্য একটি মন্দার দিকে যাচ্ছি। সব খাতেই কমবেশি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এ থেকে উত্তরণে আমাদের দুই থেকে তিন বছর লাগতে পারে। একটি সুষ্ঠু পরিকল্পনা গ্রহণ করে, অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস করে তা বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নিতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘সামনে আসছে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা। এটা এখন এমনভাবে তৈরি করতে হবে, যা হবে পুরো অর্থনীতিকে সুরক্ষা দেওয়ার দলিল। টেকসই উন্নয়ন পূরণ, মধ্যম আয়ের দেশ হওয়া, উন্নত দেশ হওয়া—এসবই মাথায় রেখে এগোতে হবে। আমাদের বাজেট কী হবে সেটাও ঠিক করতে হবে। বাজেট প্রণয়ন এখন শুধু অর্থ মন্ত্রণালয়ের বিষয় থাকবে না। কিভাবে অর্থের সংস্থান হবে, উন্নয়ন সহযোগীদের থেকে কত নেওয়া হবে, কিভাবে নেওয়া হবে ইত্যাদি ভাবতে হবে।’

জানা যায়, সরকার রাজস্ব আয়ের দিক থেকে বড় ধরনের ঘাটতির মধ্যে রয়েছে। চলতি অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আট মাসে গেল বছরের চেয়ে রাজস্ব আয়ে ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলেও লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ঘাটতি বেড়ে ৪৫ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। এই সময়ে এক লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে রাজস্ব আদায় হয়েছে মাত্র এক লাখ ৪৪ হাজার ৯২৫ কোটি টাকা।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডি বলেছে, করোনাভাইরাসের প্রভাবে রাজস্ব ঘাটতি হতে পারে প্রায় এক লাখ কোটি টাকা। বাজেট ঘাটতি মেটাতে সরকার এরই মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বাড়তি ঋণ নিয়েছে। অর্থবছরে নেওয়ার কথা ৪৭ হাজার কোটি টাকা। অথচ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়েই নেয় ৫২ হাজার ১৩৫ কোটি টাকা। করোনার কারণে আশঙ্কা করা হচ্ছে, এ ঋণের অঙ্ক এক লাখ কোটি পর্যন্ত উঠতে পারে।

করোনা পরিস্থিতিতে সরকারের রাজস্ব আয় তো হবেই না; বরং যাদের কাছ থেকে শুল্ক-কর আদায় করার কথা, উল্টো তাদের এখন ছাড় দিতে হচ্ছে। রেমিট্যান্সে এরই মধ্যে নেতিবাচক ধারা শুরু হয়েছে। রপ্তানি খাতেও নেতিবাচক ধারা। এরই মধ্যে প্রায় তিন বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি আদেশ স্থগিত হয়েছে বলে জানিয়েছে বিজিএমইএ। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় সব খাত। এ জন্য রপ্তানি খাতের পাশাপাশি দাবি উঠেছে কৃষি, আইসিটিসহ প্রায় সব খাতেই প্রণোদনা দেওয়ার।

রিকশা, ভ্যান, অটোরিকশাচালক, ফুটপাতের হকার, নির্মাণ শ্রমিকসহ শ্রমজীবী মানুষের আয় বন্ধ হয়ে গেছে। হোটেল, রেস্তোরাঁ, দুগ্ধশিল্প, পোল্ট্রি শিল্প, পর্যটন খাত বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছে। ৭৩ লাখ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ক্ষতির মুখে পড়েছে। এর সঙ্গে যোগ হচ্ছে সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনী বা সোশ্যাল সেফটি নেটের দাবি। যার মাধ্যমে দরিদ্র ও অসহায়দের সহায়তা করা হবে। এসব খাতের জন্য এখন এ বিপুল অঙ্কের অর্থ কোথা থেকে আসবে—এটিই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে আসছে সরকারের সামনে।

সরকার অর্থের জন্য এরই মধ্যে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে স্বল্প সুদে ঋণ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক-এডিবি, ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক-আইডিবি, চীনের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত এআইআই ব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফের কাছে ঋণ সহযোগিতা চেয়েছে। স্বল্প আয়ের মানুষদের সহায়তা দেওয়ার জন্য বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে ছয় হাজার ৩৭৫ কোটি টাকা চেয়েছে সরকার। এডিবির কাছে চেয়েছে চার হাজার ২৫০ কোটি টাকা।

অন্যদিকে চীনের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত নতুন এশীয় অবকাঠামো উন্নয়ন ব্যাংকের কাছে চাওয়া হয়েছে দুই হাজার ১২৫ কোটি টাকা। বিনিময় ভারসাম্য বা ব্যালান্স অব পেমেন্ট ঠিক রাখতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের কাছে চাওয়া হয়েছে ছয় হাজার ৩৭৫ কোটি টাকা। এ ছাড়া আইডিবি থেকে চাওয়া হয়েছে ৮৫০ কোটি টাকা।

আইডিবির আরেক সহযোগী সংস্থা আইটিএফসির কাছে চাওয়া হয়েছে ৪২৫ কোটি টাকা। এ ছাড়া বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি-এডিপির থোক বাবদ যে এক হাজার ৬৩০ কোটি টাকা রাখা হয়েছে, সেই টাকাও স্বল্প ও শ্রমজীবী মানুষের জন্য খরচ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। সব মিলিয়ে করোনাভাইরাসের অর্থনৈতিক প্রভাব মোকাবেলায় ২২ হাজার কোটি টাকা পাওয়ার আশা করছে সরকার। তবে বাস্তবে তার কতটুকু পাওয়া যাবে, তা এখনই বলা যাচ্ছে না।

কারণ, করোনা মহামারিতে আক্রান্ত বিশ্বের প্রায় সব দেশ। এরই মধ্যে আইএমএফের কাছে ৮৮টি দেশ ঋণ চেয়ে আবেদন করেছে। ফলে সবার চাহিদা মেটাতে হিমশিম খেতে হবে দাতা সংস্থাগুলোকে।

অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আবুল বারকাতের মতে, করোনার ক্ষতি মোকাবেলায় সরকারের প্রায় এক লাখ কোটি টাকার প্রয়োজন হবে। বৈশ্বিক তহবিল থেকে ১৩ হাজার কোটি টাকার মতো পাওয়া যেতে পারে। এর পরও ঘাটতি থাকবে ৮৭ হাজার ২৫০ কোটি টাকা। ঘাটতির অর্থ পূরণের উৎস হতে পারে জরুরি অবস্থায় সম্পদশালীদের ওপর সম্পদ কর বা ওয়েলথ ট্যাক্স আরোপ। এখান থেকে আসতে পারে ৩০ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া পাচারকৃত অর্থ ও কালো টাকা উদ্ধার থেকে আসতে পারে ৬০ হাজার কোটি টাকা।

সরকার করোনার আঘাত মোকাবেলায় এরই মধ্যে পোশাক খাতের কর্মীদের বেতন-ভাতার জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকার তহবিল ঘোষণা করেছে। এ থেকে উদ্যোক্তারা ২ শতাংশ সুদে তহবিল নিতে পারবেন। এ ছাড়া জুন পর্যন্ত ঋণ পরিশোধে বিশেষ ছাড় দেওয়া হয়েছে। এ সময়ে ঋণ শোধ না করলেও খেলাপি হবে না। রপ্তানি আয় দেশে আনার ক্ষেত্রে চার মাসের পরিবর্তে ছয় মাস সময় দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ইডিএফ তহবিল থেকে ছয় মাসের ঋণ নেওয়ার সময়সীমা বাড়িয়ে ৯ মাস করা হয়েছে। রপ্তানি আয়ের ৯০ শতাংশ অর্থ দেশে আনতে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি নেওয়ার বিধান সহজ করা হয়েছে। ঋণপত্র খোলার পর শিল্পের কাঁচামাল আমদানির সর্বোচ্চ সীমা দ্বিগুণ করা হয়েছে। 

ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম আমদানিতে গ্যারান্টি ছাড়াই পাঁচ লাখ ডলার পর্যন্ত অগ্রিম পরিশোধ করা যাবে। ক্রেডিট কার্ডের গ্রাহকদের ৩১ মে পর্যন্ত সব ধরনের জরিমানা মওকুফ করা হয়েছে। এ ছাড়া সব ধরনের গ্রাহকদের বিদ্যুৎ ও গ্যাস বিল জুন পর্যন্ত জরিমানা ছাড়া পরিশোধের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। ঘরে ফেরা কর্মসূচির আওতায় কর্মহীনদের নিজ নিজ গ্রামে সহায়তা, গৃহহীন ও ভূমিহীনদের বিনা মূল্যে ঘর, ছয় মাসের খাদ্য ও নগদ সহায়তা ঘোষণা করা হয়েছে। এর বাইরে বিনা মূল্যে ভিজিডি, ভিজিএফ এবং ১০ টাকা কেজিতে চাল দেওয়ার কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। এনজিওর গ্রাহকদের কিস্তি প্রদান স্থগিত করা হয়েছে।

গেল এক দশকে দেশের বেসরকারি খাত যখন দ্রুততার সঙ্গে বেড়ে উঠছিল, করোনা তার ভিত্তিমূলে শক্ত আঘাত করেছে বলে মনে করা হচ্ছে। পহেলা বৈশাখের উৎসবও বন্ধ হয়েছে করোনার কারণে। এ উৎসব ঘিরে অন্তত ২০ থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য হওয়ার কথা। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা এ লক্ষ্যে যা বিনিয়োগ করেছিলেন তা রীতিমতো শেষ। তাই প্রণোদনার দাবি উঠেছে এই মহল থেকেও। দেশের পোল্ট্রি শিল্পও হুমকির মুখে।

এ খাতে এরই মধ্যে আড়াই হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন উদ্যোক্তারা। ব্রয়লার মুরগির কেজি নেমে এসেছে ৬০ টাকায়। হিমায়িত মত্স্য, চিংড়ি, কাঁকড়া-কুঁচিয়া রপ্তানি বন্ধ। এতে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় হাজার কোটি টাকা। বড় বড় প্রক্রিয়াজাতকারী শিল্পের কাছে বিক্রি করতে না পারায় গ্রামে দুধ বিক্রি হচ্ছে ১৫-২০ টাকা কেজিতে।

পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপ বলছে, দেশের মোট শ্রমশক্তি ছয় কোটি আট লাখ। এর মধ্যে ১৪ দশমিক ৯ শতাংশ প্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করে। আর বাকিরা অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে। ফলে করোনার প্রভাবে প্রায় পাঁচ কোটি শ্রমজীবী কর্মহীন হওয়ার ঝুঁকিতে।

পর্যটন খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, এ খাতে ক্ষতি হতে পারে ৯৭০৫ কোটি টাকার ব্যবসা। পাশাপাশি প্রায় তিন লাখ ৯ হাজার ৫০০ লোকের চাকরি হারানোরও ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।

সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, করোনার আঘাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাত। শ্রমজীবী মানুষ, দিনমজুরকে সবার আগে সহায়তা দিতে হবে। বড়দের পরে। যাঁদের ছোট ছোট ব্যবসা, পুঁজি কম, তাঁদের সহায়তা না করলে বেশি বিপর্যয় হবে। তাঁরা হিসাবে প্রায় ৮৫ শতাংশ।কালের কণ্ঠ

সোনালীনিউজ/এইচএন

Wordbridge School
Link copied!