• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির আশঙ্কা

করোনার কবলে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার স্বপ্ন


বিশেষ প্রতিনিধি এপ্রিল ৪, ২০২০, ০১:০৯ পিএম
করোনার কবলে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার স্বপ্ন

ঢাকা : করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিও দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির মুখে পড়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। এতে ২০৩০ সালের মধ্যে উচ্চমধ্যম আয়ের দেশে উন্নীতের স্বপ্ন ধাক্কা খেতে পারে।

এ ছাড়া টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাসমূহ (এসডিজি) অর্জন এবং উচ্চমধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার বিষয়টি করোনার প্রভাবে আরো দীর্ঘায়িত হওয়ারও আশঙ্কা রয়েছে বলে অর্থ মন্ত্রণালয়সহ একাধিক সূত্রে জানা গেছে।

করোনা ভাইরাসের প্রভাবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও চলমান উন্নয়ন কার্যক্রম হোঁচট খেতে পারে এবং চলতি ও আগামী অর্থবছরের বাজেটের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

করোনার বিস্তৃতির কারণে ইতোমধ্যে ইউরোপ ও আমেরিকায় শাটডাউনের ফলে বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাকের বড় ধরনের ক্রয়াদেশ বাতিল হয়েছে।

শুক্রবার (৩ এপ্রিল) পর্যন্ত তিনশ কোটি মার্কিন ডলারের ক্রয়াদেশ বাতিল হয়েছে এ খাতে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের প্রধান এ শিল্প খাত।

এ ছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের পাঠানো রেমিট্যান্স দেশের অর্থনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু করোনা ভাইরাসের কারণে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে ইতোমধ্যে প্রায় ৭ লাখ বাংলাদেশি দেশে ফিরে এসেছেন। এটা দেশের রেমিট্যান্স আয়ের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।

এদিকে করোনা ভাইরাস আতঙ্কে একের পর এক বড় পতনের ফলে মার্চ মাসে দেশের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীরা ৩০ হাজার কোটি টাকার ওপরে হারিয়েছেন বলে পুঁজিবাজার সূত্রে জানা গেছে। করোনার প্রকোপে মার্চ মাসে লেনদেন হওয়া ১৮ কার্যদিবসে বিনিয়োগকারীরা এ অর্থ হারিয়েছেন । মূলত তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ার ও ইউনিটের দাম কমায় বিনিয়োগকারীরা এ ক্ষতির মুখে পড়েন।

উল্লেখ্য, বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া করোনা ভাইরাসের প্রকোপে গত  ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই বিশ্ব  পুঁজিবাজারে মন্দাভাব দেখা  দিয়েছে।

এ ব্যাপারে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেন, বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার বিরূপ প্রভাবের মুখে রয়েছে বাংলাদেশ। করোনার অর্থনৈতিক ক্ষতির প্রভাব বাংলাদশের একার পক্ষে মোকাবিলা করা সম্ভব নয়।

করোনা ভাইরাসের কারণে অর্থনীতিতে বহুমাত্রিক আঘাতের আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, এই বিরূপ অবস্থা ও প্রতিকূলতা মোকাবিলায় বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সহযোগিতা প্রয়োজন।

অবশ্য, সরকারের পক্ষ থেকে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ও বিস্তাররোধ এবং এ রোগের ভয়াবহতা থেকে দেশের মানুষকে রক্ষার বিষয়টিকে এখন সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। করোনা ভাইরাসের বিস্তার ও সংক্রমনরোধে প্রতিরোধমূলক কার্যক্রমের ওপর গুরুত্ব দেওয়ার পাশাপাশি দেশের অর্থনৈতিক গতিপ্রবাহ ঠিক রাখতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছেন।

ইতোমধ্যে করোনা ভাইরাসের  বিরূপ প্রভাব ও ক্ষতি মোকাবিলায় দেশের রপ্তানিমুখী পোশাক খাতের শ্রমিকদের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশে রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮৫ শতাংশই আসে তৈরি পোশাক থেকে। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংক আগামী জুন মাস পর্যন্ত কোনো গ্রাহককে ঋণ খেলাপি না করার ঘোষণাও দিয়েছে। এ ছাড়া রপ্তানি আয় আদায়ের সময়সীমা ২ মাস থেকে বৃদ্ধি করে ৬ মাস করা হয়েছে। একইভাবে আমদানি ব্যয় মেটানোর সময়সীমাও ৪ মাস থেকে বৃদ্ধি করে ৬ মাস করা হয়েছে।

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় বিশ্বব্যাংক ১ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের বৈশ্বিক তহবিল গঠন করেছে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত দেশগুলোর সহায়তার জন্য পাঁচ হাজার কোটি ডলারের তহবিল ঘোষণা করেছে। আইএমএফ ঘোষিত এ অর্থ থেকে স্বল্প আয়ের দেশগুলো এক হাজার কোটি ডলার সহায়তা পাবে।

এ অবস্থায় করোনার প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি হলে ভবিষ্যতের অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের কাছ থেকে বড় ধরনের অর্থনৈতিক সহযোগিতা প্রত্যাশা করছে। জানা গেছে, করোনার প্রভাবে দেশের অবকাঠামো খাতের প্রকল্পগুলোতে বিদেশি অর্থায়নসহ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও দীর্ঘসূত্রতার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে।

বিশেষ করে পায়রা বন্দর, মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ, কর্ণফুলী টানেল প্রকল্পসহ বড় প্রকল্পগুলোতে বিরূপ প্রভাবের আশঙ্কা  রয়েছে। কারণ, বিদেশি টেকনিশিয়ান ও বিশেষজ্ঞরা এ প্রকল্পেগুলোর কাজের সঙ্গে যুক্ত।

এ ব্যাপারে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন,  করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের প্রভাবে বাংলাদেশ উচ্চ অর্থনৈতিক ঝুঁকির মুখে পড়েছে। এর প্রভাবে ২০৩০ সালের মধ্যে উচ্চমধ্যম আয়ের দেশে উন্নীতের বিষয়টি বড় চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়তে পারে। এতে নির্ধারিত অভীষ্ট লক্ষ্য আরো চ্যালেঞ্জিং হলো এবং আমাদের খাতভিত্তিক ও সামষ্টিক অর্থনীতিতে সমস্যা বাড়বে। পাশাপাশি চাহিদার ওপরও চাপ বাড়বে।

তিনি বলেন, এসব চাপ মোকাবিলায় সামষ্টিক অর্থনৈতিক ও খাতওয়ারি ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন প্রয়োজন।

এ ছাড়া করোনার প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি হলে চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের এবং আগামী ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটের অগ্র-আধিকার পুনর্নির্ধারণের প্রয়োজন হতে পারে বলে উল্লেখ করেন এ বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ।     

সূত্র জানায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে ৮ দশমিক ২০ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। মূলত এই উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনের প্রধান চালিকাশক্তি হচ্ছে— সহায়ক রাজস্ব ও মুদ্রানীতি এবং শক্তিশালী অভ্যন্তরীণ চাহিদা।

কিন্তু বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে রপ্তানি আয় ক্ষতিগ্রস্ত এবং রেমিট্যান্স আয়ের গতি কমে গেলে বাংলাদেশে জিডিপির বড় ধরনের ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে।

এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) আশঙ্কা, ক্ষতির পরিমাণ হবে জিডিপির ১ দশমিক ১ শতাংশ। এ অবস্থায় ২০৩০ সালের মধ্যে উচ্চমধ্যম আয়ের দেশ বিনির্মাণের স্বপ্নে করোনা ভাইরাস বড় ক্ষতির কারণ হয় দাঁড়াতে পারে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!