• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

করোনায় কোন পরিণতি


বিশেষ প্রতিনিধি মার্চ ২৩, ২০২০, ০৩:৪৩ পিএম
করোনায় কোন পরিণতি

ঢাকা : করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) প্রায় সারা পৃথিবীতে দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়ার মধ্য দিয়ে বৈশ্বিক মহামারীতে রূপ নিয়েছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মাপকাঠিতে রোগটির সংক্রমণের যে চারটি স্তরের কথা বলা হয়েছে, বাংলাদেশ এর ‘তৃতীয় স্তরে প্রবেশ করেছে’ বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

অর্থাৎ দেশে এ রোগ কমিউনিটি সংক্রমণের পর্যায়ে ঢুকে পড়েছে বলে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের, যদিও এমন আশঙ্কার কথা উড়িয়ে দিচ্ছে সরকার। দেশে মোট ২৭ জন করোনায় আক্রান্ত ও এর সংক্রমণে দুজনের মৃত্যু হলেও ‘কমিউনিটিতে এখনো পর্যন্ত ছড়ায়নি’ বলে সরকার দাবি করলেও কীসের ভিত্তিতে এ দাবি করা হচ্ছে, এমন প্রশ্ন তুলছেন বিশেষজ্ঞরা।

একাধিক মন্ত্রণালয় ও কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে ‘যথাযথ প্রস্তুতি’ আছে বলে আশ্বাস দেওয়া হলেও করোনার পরীক্ষা-নিরীক্ষায় খুবই অপ্রতুল ব্যবস্থার বিষয়টি দিনে দিনে আরো স্পষ্ট হয়ে সামনে আসছে।

পর্যাপ্ত পরীক্ষার কিট, পরীক্ষার স্থান ও সব রোগীর পরীক্ষার ব্যবস্থা না থাকায় বিশেষজ্ঞরা সামনে পরিস্থিতি ‘আরো জটিল’ হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন। জনঘনত্ব ও মানুষের জীবনযাপনের ধরন বিবেচনায় নিয়ে তারা করোনায় বাংলাদেশকে ‘উচ্চ ঝুঁকির দেশ’ হিসেবে বিবেচনা করছেন। ভাইরাসটি কোন পরিণতিতে নেবে দেশকে— এমন প্রশ্নও উঠেছে।

তাদের মতে, করোনার মতো মহাবিপদ মোকাবিলায় সরকারের যেমন প্রস্তুতি নেই, তেমনই নেই মন্ত্রণালয় ও সরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কাজের সমন্বয়। আক্রান্ত রোগী শনাক্তকরণের পর্যাপ্ত উপকরণ ও ব্যবস্থাপনাও দেশে নেই।

এমনকি যারা রক্ষা করবেন রোগীদের,  সেই চিকিৎসকদের রক্ষার ব্যবস্থাসহ নেই যথেষ্ট মাস্ক, স্যানিটাইজার ও ভেন্টিলেটার। রোগটির বিস্তার আসলে দেশে কতটা হয়েছে, তা বোঝার জন্য দেশেই ব্যাপকভিত্তিতে পরীক্ষার প্রস্তুতি ও ব্যবস্থা নেই।

জনগণের মধ্যে ভাইরাসটি ছড়িয়েছে কি না, তা নির্ণয় করার যথাযথ কোনো ব্যবস্থাপনা নেই। আক্রান্তদের শনাক্ত করতে যে কয়েকটা দেশ যথেষ্ট পরীক্ষা করছে না বলে অভিযোগ উঠেছে, বাংলাদেশ এখনো সেই তালিকায়। ডব্লিউএইচও সর্বশেষ উদ্বেগও এটাই।

সংস্থাটির মহাপরিচালক বলেছেন, ‘সব দেশের প্রতি আমাদের বলার বিষয় হচ্ছে—  পরীক্ষা, পরীক্ষা, পরীক্ষা।’ অবশ্য সংস্থাটি কোনো দেশের নাম উল্লেখ করেনি। পরীক্ষার ব্যবস্থা ছাড়া করোনায় আক্রান্তের সংখ্যার তথ্য দিচ্ছে সরকার, তাই সেটা ‘বিশ্বাসযোগ্যতা’ পাচ্ছে না বলেও অভিযোগ কোনো কোনো বিশেষজ্ঞের।

তারা বলেন, গত বছরের শেষ দিকে চীনের হুবেই প্রদেশের উহানে করোনা ছড়িয়ে পড়লে তা ঠেকানোর ক্ষেত্রে বিশ্বের অনেক দেশ যেভাবে শুরু থেকেই প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, এর থেকে সরকারের সংশ্লিষ্টরা যেন অনেকটাই দূরে ছিলেন।

করোনার মতো অতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়া জীবাণু ঠেকাতে শুরু থেকে তারা কতটা প্রস্তুত ছিলেন, এমন প্রশ্নও আছে। চীনে করোনার  প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়ার পর প্রায় দুই মাস সময় পাওয়ায় নিজেকে প্রস্তুত করে নেওয়ার সুযোগ পেলেও তা পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারেননি সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্তরা। সরকার বিষয়টিকে প্রথমে খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি বলেও অভিযোগ আছে।

অবশ্য করোনার সংক্রমণ রোধে গত এক সপ্তাহে সরকার জোরদার কিছু পদক্ষেপ নেয়। রোগটির বিস্তার ঠেকাতে আজ সোমবারের নিয়মিত মন্ত্রিপরিষদ বৈঠক স্থগিত করা হয়েছে।

সরকারি তথ্য বিবরণীতে গতকাল রোববার বলা হয়, করোনার প্রাদুর্ভাবের কারণে যেকোনো জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় দেশের সব বিভাগ-জেলা-উপজেলায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কর্মস্থলে সার্বক্ষণিক উপস্থিত থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রাণঘাতী ভাইরাসটির বিস্তার ঠেকাতে আনুষঙ্গিক প্রয়োজনীয় উপকরণ অর্থাৎ আইসোপ্রোপাইল এলকোহল, করোনা টেস্ট কিট, মাস্ক— এরকম মোট ১০ ধরনের পণ্য আমদানিতে সব ধরনের শুল্কও মওকুফ করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।

তবে করোনা রোধে নেওয়া কিছু পদক্ষেপের মধ্যে তেমন পরিকল্পনার ছাপ নেই বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। মহামারী আকারে ভাইরাসটি দেশে ছড়িয়ে পড়লে এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য কোনো কৌশল খুঁজে বের করার কথা ভেবেছে বলেও নীতিনির্ধারক ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি।

এমন পরিস্থিতিতে করোনা মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী ও জাতির জনকের কন্যা শেখ হাসিনার কাছে ১০ দফা দাবি জানিয়ে গতকাল খোলা চিঠি লিখেছেন দেশের ৬৩ সচেতন নাগরিক। দেশের হাসপাতাল ও জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় বিরাজমান দুর্বলতা ও প্রস্তুতিহীনতা অনুধাবন করে ‘গভীরভাবে উদ্বিগ্ন’ বলে তারা চিঠিতে উল্লেখ করেন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, করোনা মোকাবেলার মূল পথ হচ্ছে সংক্রমণ শনাক্ত করা, তাদের বিচ্ছিন্ন করা এবং সংক্রমিতরা কাদের সংস্পর্শে এসেছে, তাদের খুঁজে বের করে ‘কোয়ারেন্টাইনে’ রাখা।

দেশে ভাইরাসটির পরীক্ষার একক ও একমাত্র কর্তৃত্ব রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর)। আর কাউকে এ পরীক্ষার সুযোগ দেওয়া হয়নি। ১৭ কোটি লোকের দেশে কারো মধ্যে করোনা ভাইরাসের লক্ষণ দেখা গেলে এ প্রতিষ্ঠানের দেওয়া কিছু ফোন নম্বরে ফোন করতে হবে। তারপর তারা কিছু প্রশ্ন করে সন্তুষ্ট হলে তাকে পরীক্ষা করা হয়। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এমন ব্যবস্থাপনা নিয়েও প্রশ্ন আছে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বিভিন্ন দেশ যখন বিদেশ থেকে আসা যাত্রীদের আগমনের ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ করেছে, তখনো বিষয়টি নিয়ে সরকার ‘দৃশ্যমান’ পদক্ষেপ নেয়নি। একের পর এক দেশ সীমান্ত বন্ধ করে দিলেও শুরু থেকে সরকার বিষয়টিতে তেমন নজর দেয়নি। বিদেশ থেকে আসা যাত্রীদের বিমানবন্দরে পর্যবেক্ষণ ও স্ক্রিনিং করার বিষয়টিও শুরু থেকে যথাযথ হয়নি।

বিমানবন্দরে যাত্রীদের স্বাস্থ্যের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা হয় থার্মাল স্ক্যানারের মাধ্যমে, অর্থাৎ দেখা হয় যে একজন যাত্রীর জ্বর আছে কি না। এসব থার্মাল স্ক্যানারের বেশির ভাগই ছিল প্রথম দিকে অকার্যকর।

বিদেশ থেকে আসা ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে ১৪ দিন ‘হোম কোয়ারেন্টাইনের’ কথা বলে দায়িত্ব সেরেছে কর্তৃপক্ষ। এসব মানুষ আসলেই বাড়িতে থাকছে কি না, সেটিও ঠিকমতো শুরুতে পর্যবেক্ষণ করা হয়নি। অবশ্য করোনা ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে দেশের সব স্থলবন্দর দিয়ে বিদেশিদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, গত মধ্যরাত থেকে এ আদেশ কার্যকর হবে।

সংক্রামক রোগনিয়ন্ত্রণ বিশেষজ্ঞ ডা. মাহমুদুর রহমান এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে দেশের সমন্বিত কোনো পরিকল্পনা শুরুতে ছিল না। জীবাণুটির পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য যেসব উপাদান দরকার, দেশে সেগুলো পর্যাপ্ত নেই। এগুলোর আগাম অর্ডার দিতে হয় এবং বিভিন্ন চ্যানেল থেকে আনতে হয়। ভাইরাসটির বিস্তার বোঝার জন্য অনেক দেশেই ব্যাপক ভিত্তিতে পরীক্ষা করা হলেও দেশে সে ব্যবস্থাই নেই।’

শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের ভাইরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. জাহিদুর রহমান খান বলেন, ‘দেশে করোনার  টেস্টিং ল্যাব মাত্র একটি। কিন্তু কাজ হচ্ছে মাত্র আইইডিসিআরের ল্যাবে। এটা মোটেই যথেষ্ট নয়। এখন ধরা পড়ছে না বলে বোঝা যাচ্ছে  না। আর পরীক্ষার সুযোগ না থাকলে ধরা পড়বে কীভাবে? আমরা পরীক্ষা করছি না বলে ধরা পড়ছে না।’

তার মতে, ‘টেস্টিং ল্যাবরেটরির প্রস্তুতি আমাদের আগেই করা উচিত ছিল। সরকার বিভাগীয় শহরে টেস্টের যে কথা বলছে সেটা আসলে নমুনা সংগ্রহ করে আইইডিসিআরে এনেই পরীক্ষা করা হবে। কোরিয়ায় ৯৬টি ল্যাব। আমাদের যে সেটআপ আছে, তাতে ৪-৫টি ল্যাব করা সম্ভব। কিন্তু আইইডিসিআর সেটা করছে না। কেন করছেন না, তারাই জানেন।’

ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ বলেন, ‘যথেষ্ট প্রমাণ না থাকলেও মনে হচ্ছে করোনা দেশের কমিউনিটিতে সংক্রমিত হচ্ছে।’ তবে আইডিসিআরের পরিচালক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা জানান, ‘করোনা কমিউনিটির মধ্যে ছড়িয়েছে, তা এখনই নিশ্চিতভাবে বলা যাবে না।’

অন্যদিকে করোনা নিয়ে নানা ধরনের গুজব ঘুরে বেড়াচ্ছে। ভাইরাসটির প্রাদুর্ভাবকে কেন্দ্র করে অস্থিরতা সৃষ্টির জন্য পরিকল্পিতভাবে গুজব ছড়ানোর অভিযোগও উঠেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গত কয়েকদিন ধরে এ নিয়ে বেশ কিছু অডিও বা ভিডিওর মাধ্যমে গুজব ছড়ানো হয়েছে, যার কোনো ভিত্তি পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

‘সরকার করোনা ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা গোপন করছে’ বলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেসব ‘কথা’ ছড়িয়েছে, এসবের কোনো ভিত্তি নেই। গুজবে বিভ্রান্তি বাড়তে থাকলেও বিষয়টির দিকে শুরুতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের জোরালো নজর ছিল না। ইতোমধ্যে গুজব সৃষ্টির অভিযোগে সারা দেশে তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী।

সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের সমাজে এমন বাজে, সুবিধাভোগী ও ভ্রষ্ট চরিত্রের লোক আছেন, তারা স্পর্শকাতর বিষয়কে সুযোগ হিসেবে কাজে লাগাতে চান। তাদের আইনের আওতায় আনা উচিত।’

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!