• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ, ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০
সহপাঠীদের বিক্ষোভ

কললিস্টের সূত্র ধরেই এগোচ্ছে রুম্পা ‘হত্যা’র তদন্ত


নিজস্ব প্রতিবেদক ডিসেম্বর ৯, ২০১৯, ১১:৩৮ এএম
কললিস্টের সূত্র ধরেই এগোচ্ছে রুম্পা ‘হত্যা’র তদন্ত

ঢাকা : তদন্তে ঘুরপাক খাচ্ছে স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রুবাইয়াত শারমিন রুম্পার মৃত্যুরহস্য। তাকে হত্যা করা হয়েছে নাকি সে নিজে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছে তা এখনো নিশ্চিত হতে পারেনি পুলিশ। তবে পুলিশ মৃত্যুকে হত্যা ধরেই তদন্ত শুরু করেছে। রহস্য উদ্ঘাটনে রুম্পার মোবাইল ফোনের কললিস্টের তালিকা নিয়ে এগোচ্ছে তদন্তকাজ। থানা পুলিশের পাশাপাশি গোয়েন্দারাও রহস্য উদ্ঘাটনে মাঠে নেমেছে। ঘটনার পর থেকে রুম্পার কথিত প্রেমিককে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তাকে পেলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানা যাবে বলে জানিয়েছেন তদন্তসংশ্লিষ্টরা।

তদন্তের সঙ্গে যুক্ত পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, রুম্পা খুন হয়েছেন, সেটি ধরেই তদন্ত হচ্ছে। তার মুঠোফোনের কললিস্ট যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। কিন্তু কে বা কারা, কীভাবে এবং কোন কারণে তাকে হত্যা করেছে বা করে থাকতে পারে, সে বিষয়ে এখন পর্যন্ত কিছু জানা যায়নি।

এদিকে স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রুম্পা হত্যার প্রতিবাদে ও দোষীদের শাস্তির দাবিতে গতকাল শনিবারও মানববন্ধন ও প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেছেন। বর্জন করেছেন পূর্বনির্ধারিত পরীক্ষা। শিক্ষার্থীদের কর্মসূচিতে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন শিক্ষক ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও। দোষীদের গ্রেপ্তার না করা পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাবেন বলে জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা।

তারা বলেন, আমাদের একটাই দাবি। আমরা রুম্পা হত্যার বিচার চাই। এদিকে রুম্পার পরিবারকে সার্বিক সহযোগিতার ঘোষণা দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি আবদুল নকী বলেন, এই ঘটনায় দোষীদের চরম শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। তদন্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে। রোববার (আজ) ফাইনাল পরীক্ষায় অংশ নেবেন শিক্ষার্থীরা। পরীক্ষা শেষে আবারো কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন তারা।

মানববন্ধনে দাঁড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষক শাকির পারভিন বলেন, ‘আমরা রুম্পা হত্যার বিচার চাই। আমার মেয়ে রাস্তায় কেন মরল, সেই জবাব আমি চাই। আমি চাই না আমার আরেক মেয়ে এভাবে হত্যার শিকার হোক। আইন ও বিচারব্যবস্থা যদি ভালো থাকত, তাহলে কিন্তু একের পর এক এভাবে হত্যা-ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটত না।’

সহপাঠী শাহরিয়া তাসনিম বলেন, এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া উচিত এবং শারমিনকে হত্যা করা হয়ে থাকলে জড়িত ব্যক্তিদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

রুম্পার বন্ধু আবদুল্লাহ শাকিল বলেন, আমি যতটুকু জানি, প্রায় এক বছর ধরে বিবিএ ডিপার্টমেন্টের  সৈকত নামের এক ছেলের সঙ্গে রুম্পার সম্পর্ক ছিল। কিন্তু গত তিন মাস ধরে তাদের সম্পর্কটা আর ভালো যাচ্ছিল না। রুম্পা সব সময় মন খারাপ করে থাকত। আমরা ধারণা করছি, এ ঘটনার সঙ্গে ওই সম্পর্কের বিষয় জড়িত থাকতে পারে, আবার নাও পারে।

শাকিল আরো বলেন, রুম্পার লাশ যেখানে পাওয়া গেছে, সেখানে দুটি হোস্টেল আছে। ওই হোস্টেলে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলে-মেয়েরা থাকে। একটি ছেলেদের হোস্টেল, আরেকটি মেয়েদের। এখন ওই হোস্টেল থেকে যদি রুম্পার লাশ ফেলে দেওয়া হয়ে থাকে, তাহলে ওই ভবনে ওঠার সময় কারো সঙ্গে সে গেছে, এটা নিশ্চিত। কারণ, ওই হোস্টেলে কার্ড ছাড়া ঢোকা যায় না। সুতরাং এ ঘটনা স্বাভাবিক না। এখানে অনেকের হাত আছে বলে আমি মনে করছি।

ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক সাদিয়া আফরোজ বলেন, রুম্পা খুবই ভদ্র মেয়ে। আমরা এখনো বুঝতে পারছি না, এ ঘটনা কেন ঘটল। তবে আমরা ধারণা করছি, তাকে ধর্ষণ করে হত্যা করা হয়েছে। আমরা আন্দোলনে নেমেছি। আমার মেয়ের হত্যার বিচার না পাওয়া পর্যন্ত আমরা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালিয়ে যাব।

গত বুধবার রাতে রাজধানীর ইনার সার্কুলার রোড থেকে রুম্পার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ওই স্থানের আয়েশা শপিং কমপ্লেক্সের পেছনের একটি বাড়ির ছাদ থেকে তাকে ফেলে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনায় রমনা থানায় একটি হত্যা মামলা করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার রুম্পার মা ও স্বজনরা রমনা থানায় গিয়ে লাশের ছবি দেখে তাকে শনাক্ত করেন। এরপর ময়নাতদন্ত শেষে শুক্রবার ভোর ৫টায় রুম্পার লাশ গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের চরনিলক্ষীয়া ইউনিয়নের বিজয়নগরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে সকাল ১০টায় জানাজা শেষে পরিবারিক গোরস্তানে দাদি রুবিলা খাতুনের কবরের পাশে তাকে দাফন করা হয়।

রুম্পা ২০১৪ সালে রাজধানীর রাজারবাগ পুলিশ লাইনস স্কুল থেকে এসএসসিতে জিপিএ-৫ এবং ২০১৬ সালে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির সিদ্ধেশরী ক্যাম্পাসে ইংরেজি বিভাগে পড়াশোনা শুরু করেন।

গত বুধবার রাতে সিদ্ধেশ্বরী এলাকার রাস্তা থেকে অজ্ঞাতপরিচয় এক তরুণীর মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। পরদিন রাতে স্বজনরা রমনা থানায় লাশের ছবি দেখে রুবাইয়াত শারমিন রুম্পার পরিচয় শনাক্ত করেন। এক ভাই, এক বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন বড়। তার বাবা রোকনউদ্দিন হবিগঞ্জের একটি পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক।

রমনা মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘ঘটনাস্থলে তিনটি ভবন আছে। আমরা ধারণা করছি, যে কোনো একটি ভবন থেকে তাকে ফেলে দেওয়া হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত আমরা কোনো আসামিকে গ্রেপ্তার করতে পারিনি। হত্যা মামলাও হয়েছে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিকে আসামি করে। ঘটনাস্থলের পাশের যে ভবনগুলো আছে, এই ভবনের দায়িত্বে থাকা লোকদের আমরা জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছি। দ্রুতই একটি ফল পাব বলে মনে হয়।

ডিএমপির রমনা অঞ্চলের সিনিয়র সহকারী কমিশনার এস এম শামীম বলেন, শান্তিবাগে ভাড়া বাসায় মায়ের সঙ্গে থাকতেন শারমিন। এই বাসায় তার চাচার পরিবারের সদস্যরাও থাকতেন। তিনি মারা গেলেন প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে সিদ্ধেশ্বরীতে। সেখানে তার কোনো আত্মীয়স্বজনের বাসাও নেই। বিষয়টি সন্দেহজনক মনে হওয়াতেই তারা হত্যা মামলা নিয়েছেন।

পুলিশের এই সহকারী কমিশনার বলেন, শারমিনের লাশ পাওয়া গেছে তিনটি ভবনের মাঝখানে। বুধবার রাত সোয়া ১০টার দিকে ওপর থেকে কিছু একটা পড়ার শব্দ শুনে আশপাশের ভবনের লোকজন প্রথমে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ ফোন করেন। পরে সেখান থেকে থানায় বিষয়টি জানানো হয়।

তিনি বলেন, লাশটি তিনটি ভবনের মাঝখানে পড়ে ছিল। যে এলাকায় ঘটনাটি ঘটেছে, সেখানে পাশাপাশি তিনটি ভবনের একটি ১২ তলা (আয়েশা শপিং কমপ্লেক্স)। এর চারতলা পর্যন্ত বাণিজ্যিক (দোকান, বিভিন্ন অফিস) কার্যক্রম চলে। পঞ্চম তলা থেকে আবাসিক ফ্ল্যাট। আর বাকি দুটি আবাসিক ভবনের একটি তিনতলা, অন্যটি পাঁচতলা। এর মধ্যে পাঁচতলা ভবনের ছাদে টিনের কাঠোমো। তিনটি ভবনের কোনোটিতেই সিসি ক্যামেরা নেই। তাই কোন ভবনটিতে শারমিন ঢুকেছিলেন, তা জানা যায়নি।

ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, যে স্থানে শারমিনের লাশ পড়েছিল, তা একটি গলির শেষ মাথা। এর ডানে তিনতলা আর বাঁয়ে পাঁচতলা ভবন। ১২ তলা ভবনের পেছনের দিকে পড়েছিল রুম্পার লাশ।

পুলিশ সূত্র জানায়, দুটি টিউশনি করে বুধবার সন্ধ্যায় শারমিন বাসার নিচে আসেন। ওপরে না উঠে তিনি মুঠোফোনে চাচাতো ভাইকে নিচে নামতে বলেন। তার কাছে আংটি, কানের দুল, মুঠোফোন, ব্যাগ দিয়ে দেন। এর পর পুরোনো এক জোড়া জুতা আনতে বলেন। চাচাতো ভাই জুতা নিয়ে আসার পরে সেই জুতা পরে তিনি চলে যান। রাতে আর বাসায় ফিরে আসেননি। স্বজনরা বিভিন্ন স্থানে খোঁজ করেও তার সন্ধান পাননি।

পুলিশের সুরতহাল প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, শারমিনের মেরুদণ্ড, বাঁ হাতের কনুই ও ডান পায়ের গোড়ালি ভাঙা ছিল। মাথা, নাক, মুখে জখম এবং বুকের ডান দিকে ক্ষতচিহ্ন ছিল।

রমনা থানার পুলিশের পাশাপাশি গোয়েন্দা বিভাগও (ডিবি) এ ঘটনার ছায়া তদন্ত করছে। ডিবির রমনা অঞ্চলের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার শামসুল আরেফিন বলেন, তিনটি ভবনের মধ্যে সবচেয়ে উঁচু আয়েশা কমপ্লেক্সের ১২ তলার ছাদে একটি জুতার ছাপ পাওয়া গেছে। ওই ছাদে কোনো রেলিং নেই। ছাদের এক পাশ একটু ঢালু। সেখানে জুতার ছাপটি পাওয়া গেছে। লাশের সঙ্গে পড়ে থাকা জুতার সঙ্গে ওই ছাপের মিল আছে কি না, তা পরীক্ষা করে দেখার জন্য পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগে কাজ করছে। এ ছাড়া তার মুঠোফোনটিতে পাসওয়ার্ড থাকায় সেখান থেকেও কোনো তথ্য বের করা সম্ভব হয়নি। মুঠোফোনটিও তাই ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য সিআইডিতে পাঠাতে তারা থানা-পুলিশকে পরামর্শ দিয়েছেন।

শারমিনের বাবা পুলিশ পরিদর্শক রোকন উদ্দিন বলেন, শারমিনের মৃত্যুর রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য তদন্তের সঙ্গে যুক্ত পুলিশের উচিত তার সহপাঠী এবং যাদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা ছিল, তাদের সঙ্গে কথা বলা। মুঠোফোন কললিস্ট ধরে পুলিশ তদন্ত করতে পারে। তিনি মেয়ে হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত ও দ্রুত বিচার চেয়েছেন।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!