• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
লঞ্চের ধাক্কায় নৌকা ডুবি

কান্না থামছে না শিশু তানহার, নতুন জামা দেয়া হলো না বাবা-মার


বাউফল প্রতিনিধি জুন ২০, ২০২০, ০৪:১৫ পিএম
কান্না থামছে না শিশু তানহার, নতুন জামা দেয়া হলো না বাবা-মার

বাউফল : শিশু তানহাকে নতুন জামা-মোজা পড়ানো হলো না আসলাম-জান্নাত দম্পত্তির। একদিন পর শুক্রবার (১৯ জুন) বিকালে ঘটনাস্থলে লাশ ভেসে ওঠে আসলামের।

জান্নাতের লাশের সন্ধান পাওয়া যায় ঘটনাস্থল থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে আলগী-তেঁতুলিয়া নদীর মিলনস্থল তালতলী পয়েন্ট এলাকায়। ফিডার ফিডিংয়েও এখন উদর-পূর্তির স্বাচ্ছন্দ নেই বাড়িতে স্বজনদের কাছে রেখে যাওয়া তাদের অবুঝ সন্তান তানহার।

আট মাস বয়সী শিশুর ভাব প্রকাশের সক্ষমতা না থাকলেও দৃষ্টিতে যেন বাবা-মা হারানোর এক অবর্ণণীয় অসহায়ত্ব প্রকাশ আর স্বজনদের আহাজারিতে কেবলই মুখে লেগে আছে তার অহরহ কান্নার শব্দ।

বৃহস্পতিবার (১৮ জুন) সকালে মেয়ে তানহাকে নতুন জামা-মোজা পড়ানোর স্বপ্ন ভেসে যায় পটুয়াখালীর বাউফলের আলগী নদীতে লঞ্চের ধাক্কায় নৌকা ডুবিতে নিখোঁজ দম্পত্তি আসলাম-জান্নাতের।

নিখোঁজদের স্বজন ও স্থানীয়রা জানায়, আসলাম-জান্নাত দম্পত্তি কেশবপুর ইউপির ভরিপাশা গ্রামে বাড়ি থেকে লকডাউনে ফেলে আসা বকেয়া বেতন তুলতে চার দিন আগে রওনা হয়ে যান নারায়ণঞ্জের সিদ্দিকগঞ্জ ইপিজেড এলাকায় জানাতের কর্মস্থল একটি গার্মেন্টের উদ্দেশে।

কর্তৃপক্ষের লোকজনের আশ্বাসে সেখানে ছুটে গিয়েও বেতন তুলতে ব্যর্থ হয়ে দেরি না করে ফের উঠে বসেন এমভি ঈগল-৪ লঞ্চের ডেকে। বাড়ি ফেরার উদ্দেশে দাদি আলোমতির কাছে (আসলামের মা) রেখে যাওয়া তাদের একমাত্র শিশু সন্তান তানহার টানে। সঙ্গে হাতে পাওয়া একই এলাকায় আসলামের দিনমজুরীর কিছু বকেয়া আর লঞ্চের ভাড়া বাদে দু’জনার হাতে থাকা অবশিষ্ট সামন্য টাকায় কিনে নেন তারা আটমাস বয়সী প্রিয় শিশু সন্তান তানহার জন্য নতুন জামা-মোজা।

কিন্তু নিজ স্টেশন নুরাইনপুর ঘাটে নেমে আরো ১০-১২ জনের সঙ্গে খেয়ার নৌকায় উঠে আলগী নদী পাড় হতে গিয়ে ফিরে আসা ওই লঞ্চের ধাক্কাতেই লন্ডভন্ড হয়ে যায় শিশু তানহাকে নতুন জামা-মোজা পড়ানো স্বপ্ন। খেয়ার নৌকা উল্টে নিখোঁজ হন ওই আসলাম জান্নাত দম্পত্তি। তাদের শিশু সন্তান তানহার জন্য কেনা নতুন জামা-মোজা ভর্তি ট্রাবেল ব্যাগটি পানিতে ভেসে যাওয়ার সময় উদ্ধার করা গেলেও উদ্ধার করা যায়নি আসলাম-জান্নাত দম্পতিকে। এ সময় আনোয়ার নামে অপর একজন মারা যায় উদ্ধার হওয়ার পরে।

লঞ্চের ইঞ্জিনের প্রপেলারের দাপটে পানিতে নিখোঁজ হয় আসলাম ও জান্নাত দুই জন। আজ শুক্রবার বিকালে ঘটনাস্থলে ঘাটের পন্টুনের সঙ্গে আসলামের লাশ ভাসতে পাওয়া যায়। জান্নাতের লাশ মেলে ঘটনাস্থল থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে আলগী-তেঁতুলিয়া নদীর মিলন পয়েন্টের কাছে তালতলী এলাকায়।

এ ঘটনায় লঞ্চের ধাক্কায় নৌকা ডুবিতে নিখোঁজ হওয়ায় দম্পত্তি আসলাম-জান্নাতের আত্মীয়-স্বজনসহ এলাকায় নামে শোকের ছায়া। নাতি তানহাকে কোলে নিয়ে আসলামের মা আলোমতি বিলাপ করছেন। পানিতে ভেসে যাওয়ার সময় উদ্ধার হওয়া ট্রাবেল ব্যাগে পাওয়া নাতি তানহার জন্য তার ছেলে ও ছেলের বৌয়ের কেনা নতুন জামা-মোজা দেখাচ্ছেন আর বলছেন ‘তোমরা আমার পোলা-বৌডারে আইন্যা দেও।’

আসলামের বাবা আলম শরিফ বাকরুদ্ধ হয়ে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে কেবল তাকাচ্ছেন এদিক-সেদিক। শান্তনার চেস্টায় তাদেরকে ঘিরে আশপাশের লোকজন। লঞ্চ স্টাফদের অসতর্কতার কারণে নৌকা ডুবির ওই ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিচার দাবী করেছেন আজ শুক্রবার দুপুরেও ঘটনাস্থলে নদীর পাড়ে কান্নায় ভেঙে পড়া জান্নাতের বাবা পৌর সদর এলাকার জালাল মোল্লা ও মা সাজেদা বেগমও।

কান্না জড়ানো সাজেদা বেগম জানান, বছর চারেক আগে বিয়ে হয় আসলাম ও জান্নাতের। টানাটানির সংসার গ্রামে থেকে কোনো মতে চলছিল না। তাই মেয়ের জামাই আসলাম নারায়ণগঞ্জে দিনমজুরী আর একই এলাকায় মেয়ে জান্নাত গার্মেন্টে কাজ করছিলেন। নাতি তানহা আসার পরে ভাড়ার বাসায় থেকে তাকে দেখভালের কাজ করলেও এখন এ অবস্থায় নাতিটাকে রাখা যাচ্ছে না। গার্মেন্টে কাজের সময় বিরতিতে বাসায় এসে মেয়ে তানহাকে দুধ খাইয়ে যেত জান্নাত। করোনার লকডাউনে বাড়ি এসে গার্মেন্ট মালিক পক্ষের কথা মতো তানহাকে তার দাদির কাছে রেখেইে বেতন তুলতে যায় ওরা দু’জন।

লঞ্চের ধাক্কায় নৌকা ডুবিতে আসলাম-জান্নাত দম্পতিসহ তিন জন নিহতের ঘটনায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যাক্ত করেছেন স্থানয়ীরাও। সেলিম, জালাল চৌকিদার, শাহ আলম হাওলাদার, আবুল কালাম, আলমগীর হোসেন, নান্নু নামে কয়েকজন প্রায় অভিন্ন বলেন, ‘লঞ্চের ড্রাইভার (মাষ্টার) হানিফ মিয়াসহ লঞ্চ স্টাফদের অসতর্কতার মতো কারণেই এমন দুর্ঘটনা ঘটেছে।’

অভিযোগ অস্বীকার করে এমভি ঈগল-৪ লঞ্চটির ড্রাইবার হানিফ মিয়া সাংবাদিকদের বলেন, ‘নদীর স্রোতে নৌকা এসে লঞ্চের সঙ্গে থাক্কা খায়।’ তার দাবি লঞ্চ ঘাটে নোঙর করা ছিল। এখানে তার অসাবধানতার কিছু ছিল না। লঞ্চের দায়িত্বপ্রাপ্ত ইন্সপেক্টর মো. আলমগীর হোসেন বলেন, ‘ঘটনায় লঞ্চ স্টাফদের কোন ভুল নেই। নৌকা লঞ্চে ধাক্কা লাগে নি।’

বাউফল থানার ওসি মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘লাশ উদ্ধারে পুলিশ পাঠানো হয়েছে। আগের দিন শোনার সঙ্গে সঙ্গেই ঘটনা স্থলে পুলিশ পাঠানো হয়।’

উল্লেখ, লঞ্চের থাক্কায় নৌকা ডুবিতে গতকাল বৃহস্পতিবার উপজেলার নুরাইনপুর লঞ্চঘাটের অদূরে খেয়াঘাট এলাকায় আলগী নদীতে আনোয়ার হোসেন (৩২) নামে এক যুবক নিহত হন। নিখোঁজ হন আসলাম-জান্নাত দম্পত্তি।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!