• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
আ.লীগের কেন্দ্রীয় সম্মেলন

কার্যক্রমে ছায়া ফেলছে কূটনৈতিক ইস্যু


বিশেষ প্রতিনিধি ডিসেম্বর ১৫, ২০১৯, ০৩:০৩ পিএম
কার্যক্রমে ছায়া ফেলছে কূটনৈতিক ইস্যু

ঢাকা : আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সম্মেলন আয়োজনের প্রাক বৈঠক, আলোচনা ও কার্যক্রমে ঘুরেফিরে আসছে কূটনৈতিক নানা ঘটনার প্রসঙ্গ।

হঠাৎ করে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দুই মন্ত্রীর পূর্বনির্ধারিত ভারত সফর বাতিল হওয়া, দেশটির বিতর্কিত নাগরিকত্ব বিল (সিএবি) পাস এবং আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গাম্বিয়ার করা গণহত্যা মামলার শুনানি ও অন্তর্বর্তী আদেশের অপেক্ষার কথা ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ নেতাদের ঘরোয়া আলোচনা ও বৈঠকে আসছে।

সম্মেলনকে সামনে রেখে কেন্দ্রীয় কমিটিতে পদপ্রত্যাশীদের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ ও তদবিরের সময়ও আসছে বিদেশি প্রসঙ্গগুলো।

বিশেষ করে ভারতের সঙ্গে সরকারের কূটনৈতিক সম্পর্কের টানাপোড়েন সৃষ্টি হতে পারে বলে যে শঙ্কার কথা দেশি ও বিদেশি সংবাদমাধ্যমে আলোচনা হচ্ছে, সেদিকে কৌতূহলী চোখ ও গভীর নজর রাখছেন সরকারি দলের কেন্দ্রীয় অনেক নেতা।

‘দেশের স্বার্থ ও উন্নয়নের ধারবাহিকতা রক্ষার’ সঙ্গে সরাসরি ও ওতপ্রোতভাবে জড়িত আন্তর্জাতিক ঘটনার কথা দলীয় সম্মেলনের প্রাক কার্যক্রম চলাকালে আলোচনায় এলেও সম্মেলন নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছে আওয়ামী লীগ। দলীয় কোনো কার্যক্রমে এর প্রভাব পড়েনি। সম্মেলন সামনে রেখে গঠিত উপকমিটিগুলো দফায় দফায় বৈঠক করছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা গুছিয়ে আনছেন যাবতীয় প্রস্তুতি।

আগামী ২০ ও ২১ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ২১তম ত্রিবার্ষিক সম্মেলন ঘিরে জাতীয় পর্যায় থেকে শুরু করে তৃণমূলের নেতাকর্মী পর্যন্ত উচ্ছ্বাস ও কৌতূলেরও যেন শেষ হয়।

কেন্দ্রীয় সম্মেলনের আগে সারা দেশের তৃণমূলের সম্মেলনের মধ্য দিয়ে নতুন নেতৃত্ব নির্বাচিত হয়েছে। দেশের বিভিন্ন সাংগঠনিক জেলায় সম্মেলন চলে গতকাল ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত।

সূত্রমতে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল গত বৃহস্পতিবার শেষ মুহূর্তে এসে তাদের ভারত সফর বাতিল করেন। সফর বাতিল করার বিষয়ে দুই মন্ত্রী এখনো কিছু বলেননি ও তাদের মন্ত্রণালয় থেকেও এ বিষয়ে কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। এ নিয়ে চলছে নানামুখী আলোচনা ও সমালোচনা।

ভারতের ‘নাগরিক তালিকা পঞ্জি’র পর দেশটির বিতকির্ত ‘নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল’ পাসে বাংলাদেশের এক ধরনের ‘অস্বস্তি’ কাজ করায় দুই মন্ত্রী সফর স্থগিত করেন বলে সম্ভাব্য কারণ হিসেবে আলোচনা ও পর্যালোচনা চলছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। এর আগে হঠাৎ করে পেঁয়াজ রপ্তানি না করা নিয়ে ভারতের অবস্থানকে ঘিরে দেশে এক ধরনের প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়।

নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল ভারতের সংসদে উত্থাপনের সময় দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ‘বাংলাদেশে এখনো সংখ্যালঘু নির্যাতন হচ্ছে’ বলে অভিযোগ করলে এ নিয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন।

এ প্রসঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের প্রভাবশালী দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভারত সফর আটকে বার্তা দিতে চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে দুই মন্ত্রীর ভারত সফর বাতিলের কারণ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে অনেকের স্পষ্ট জানা নেই।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস ও বিজয় দিবস সামনে রেখে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভারত সফরে যাননি। ভারতের নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল এ সফর স্থগিতের কোনো কারণ না। পরবর্তীতে যাবেন তারা, সফর চিরতরে বাতিল হয়নি। ভারতের সঙ্গে আমাদের গঠনমূলক বন্ধুত্ব রয়েছে।’

জানা গেছে, ‘দিল্লি ডায়ালগ’ ও ‘ইন্ডিয়ান ওশান ডায়ালগ’ উপলক্ষে তিন দিনের সফরে গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ভারতের উদ্দেশে রওনা হওয়ার কথা ছিল পররাষ্ট্রমন্ত্রীর। তার আগে দুপুরে হঠাৎ করেই এ সফর বাতিলের কথা জানায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

ভারতের মেঘালয় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী কনরাড সাংমার আমন্ত্রণে গত শুক্রবার বেলা ১১টায় সিলেটের তামাবিল হয়ে মেঘালয়ে যাওয়ার কথা ছিল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর। তার আগের দিন রাতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা এ সফর স্থগিতের কথা জানান।

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের মতে, ‘বিচ্ছিন্ন’ এসব ঘটনায় দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কে কোনো প্রভাব পড়বে না। দেশে বিদ্যমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সরকার ও আওয়ামী লীগ ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে কোনো টানাপোড়েন সৃষ্টি হোক, সেটা চাইবে না। ভারতেরও বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা প্রয়োজন। কোনো ‘অস্বস্তি’ থাকলেও দুই দেশই নিজ তাগিদ থেকে কূটনৈতিক সম্পর্ককে আরো এগিয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টা ও কার্যক্রম অব্যাহত রাখবে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, গত এক দশকে বাংলাদেশ ও ভারতের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক এমন এক উচ্চতায় পৌঁছেছে, যেখানে সুসম্পর্ক রাখার ব্যাপারে দুই দেশেই বড় পরিসরে মতৈক্য সৃষ্টি হয়েছে।

রাজনৈতিক দল হিসেবেও আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভারতের ঐতিহাসিক সম্পর্ক আছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সময় থেকেই। মুক্তিযুদ্ধের পর বিভিন্ন সময় অন্য সরকারের আমলে দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কে শিথিলতা এলেও ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে সম্পর্কে আমূল পরিবর্তন আসে।

গত প্রায় ১১ বছর ধরে দুই দেশের মধ্যকার কূটনৈতিক সম্পর্ক বিশেষ উষ্ণতায় অনন্য উচ্চতায় আসীন। কূটনীতিকরা মনে করেন, সম্পর্কের ধারাবাহিকতা রক্ষায় দুই দেশের ক্ষমতাসীন দলই এখন সচেষ্ট। পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাস দুই দেশের সম্পর্কের ভিত্তি।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ঐতিহাসিক কারণে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভারতীয় জাতীয় দল কংগ্রেসের সম্পর্ক সুবিদিত। ভারতে পালাবদলের পর বিজেপির সঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্পর্ক কেমন হবে, তা নিয়ে একটা সংশয় ছিল।

গত ছয় বছর সেই সংশয় শুধু ঘুচেই যায়নি, বিজেপির সঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্পর্ক ক্রমশ জমাট বেঁধেছে। পারস্পরিক নির্ভরতাও সৃষ্টি হয়েছে। বিজেপির সরকারও বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ককে আরো উষ্ণতার দিকে নিয়ে যায়।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির ভোটের ‘প্রশ্নবিদ্ধতাকে’ গুরুত্ব না দিয়ে বিজেপির নতুন সরকার শুরু থেকেই বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন দলের পাশে দাঁড়িয়ে সেই ভোটকে মান্যতা দেয়। ভারতের মান্যতার প্রয়োজনীয়তা বাংলাদেশের কাছে অনস্বীকার্য।

২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয়ের জন্য দলের শীর্ষ কয়েক নেতা ওই সময়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত সরকারকে দায়ী করেন। আর ওই সময় ভারতে বিজেপি ক্ষমতাসীন ছিল। সেই অবস্থা এখন আর নেই।

দলীয় সূত্র বলছে, আওয়ামী লীগের অতীতের কেন্দ্রীয় সম্মেলনগুলোতে ভারতসহ বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক দলের নেতাদের আমন্ত্রণ জানানো হলেও আসন্ন ২১তম সম্মেলনে কোনো বিদেশি অতিথি থাকছেন না।

দলের সম্মেলন প্রস্তুতির অভ্যর্থনা উপ-কমিটির আহ্বায়ক ও দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোহাম্মদ নাসিমও বিষয়টি নিশ্চিত করেন।

আগামী বছর বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের সময় বছরজুড়ে নানা আয়োজনে বিদেশি অতিথিদের আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে। তাই দলীয় সম্মেলনে আলাদা করে কোনো বিদেশি অতিথিকে এবার আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।

বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর মূল অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঢাকা সফর করার কথা রয়েছে। একই অনুষ্ঠানে যোগ দিতে দেশটির সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি ও কংগ্রেস দলের নেত্রী সোনিয়া গান্ধীও ঢাকায় আসবেন।

অন্যদিকে নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগে অবস্থিত আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গাম্বিয়ার করা গণহত্যা মামলার তিন দিনব্যাপী শুনানি শুরু হয় ১০ ডিসেম্বর। গাম্বিয়ার এ মামলা ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থার পক্ষ থেকে করা হয়েছে।

এ মামলার অন্তর্বর্তী আদেশের মধ্য দিয়ে চাপে পড়তে পারে মিয়ানমার। বাংলাদেশ যদি মামলার পক্ষ হতো, তাহলে মিয়ানমার একটি অজুহাত পেয়ে যেত দ্বিপক্ষীয় প্রয়াস থেকে বেরিয়ে যাওয়ার।

২০১৭ সালে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনে বিতাড়িত বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার পর থেকে বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমেও তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!