• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

কালানুক্রমিক বন্যা ও নেপথ্যের কারণ


মো: আরিফুল ইসলাম  আগস্ট ৫, ২০২০, ০৪:৫৭ পিএম
কালানুক্রমিক বন্যা ও নেপথ্যের কারণ

ফাইল ছবি

ঢাকা: একদিকে করোনা অন্যদিকে চলমান বন্যা উভয়ে মিলে বিষিয়ে তুলেছে জনজীবন। দুটি দূর্যোগই যুগপৎ ভাবে বিপাকে ফেলছে জনমানসকে। করোনা দূর্যোগ বৈশ্বিক হলেও বন্যা নিতান্তই বঙ্গদেশের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। একমাসের অধিক সময় ধরে তলিয়ে আছে দেশের প্রায় অর্ধভাগ। উত্তরাঞ্চল তলিয়ে মধ্যাঞ্চল। নিম্নাঞ্চলের অধিকাংশ মানুষ পানি বন্ধি। কুড়ে ঘড় থেকে বহুতল বাড়ি সবই চলে যাচ্ছে জলগর্ভে। এসব অঞ্চলের মানুষের দুঃখ-দুর্দশার অন্ত নেই। থাকার জায়গা নেই, খাবার নেই, বিশুদ্ধ পানীয়জল নেই। রাষ্ট্রীয় প্রস্তুতি ও সামর্থের কথা কর্তৃপক্ষ বারবার জাহির করতে চেষ্টা করলেও অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছে বানবাসী মানুষ। সহায় সম্বল হারিয়ে ঠাই মিলেছে আশ্রয়কেন্দ্রে। অনেক অঞ্চলে নেই পর্যাপ্ত অাশ্রয়কেন্দ্র। সলিল সমাধি হয়েছে শতাধিক প্রাণ। তবে এ ঘটনা নতুন নয় বাংলাদেশের মানুষের কাছে। এটি ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি মাত্র। প্রতিবছরই বন্যায় কমবেশি তলিয়ে যায় বাংলাদেশের  উপরিভাগ। প্রতিবছরই দুর্দশায় পরতে হয় দেশের মানুষকে। প্রতিবছরই সহায়-সম্বল হারান দেশের অনেক প্রান্তিক মানুষ। ভৌগলিক অবস্থান, ভুতাত্ত্বিক গঠন, অতিরিক্ত জনসংখ্যা, বাধ ও ড্রেজিং ব্যবস্থায় অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির অবাধ প্রবাহ নেপথ্যের কারণ। 

বাংলাদেশ একটি বদ্বীপ। হিমালয় থেকে নেমে আসা জলের সঙ্গে পলি জমে জমে তৈরি হয়েছে এ দেশের একটি বিশাল অংশ। এটি এখনো নিচু। এটাকে তাই বলা হয় প্লাবনভূমি। বর্ষায় প্রচুর বৃষ্টি হয়। ওই সময় হিমালয়ে গলে বরফ। দুইয়ে মিলে নদীতে জলের প্রবাহ বাড়ে। হঠাৎ করে বেশি জল এলে নদী তা ধরে রাখতে পারে না। দুকূল ছাপিয়ে পানি উপচে পড়ে। ডুবিয়ে দেয় প্লাবনভূমি। বদ্বীপ অঞ্চলে এটা অতি স্বাভাবিক। এটা প্রকৃতি থেকে পাওয়া। দেশ ছোট, মানুষ বেশী। প্লাবনভূমির যে অংশটি বরাদ্দ থাকার কথা শুধু জলের জন্য, সেখানে হানা দিয়েছে মানুষ। বসতি গড়েছে, চাষবাস করছে। হঠাৎ বেশি পানি এলে তারা পড়ে যায় বিপদে। এটাই বন্যা; মানুষ ভাবে, পানি, তুই এলি কেন? পানি ভাবে, মানুষ আমার জায়গায় তোর তো থাকার কথা নয়! পানিপ্রবাহের জন্য যা স্বাভাবিক, মানুষের কাছে তা-ই বন্যা। 

বাংলাদেশের দুই শতাধিক নদীর অধিকাংশই আন্তর্জাতিক। যার সীমানা ভারত, পাকিস্তান, চীন,বার্মা এবং হিমালয়ের দেশ নেপালের অভ্যন্তরেও রয়েছে। বৃষ্টিপাত কিংবা হিমালয়ের বরফগলা জল কোনো কারণে এসব দেশের অভ্যন্তরে পানিবৃদ্ধি হলে তার প্রভাব পরে বাংলাদেশেও। সেক্ষেত্রে নিকট প্রতিবেশী ভারতের প্রভাব এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। 
গঙ্গার পানিবন্টন বিষয়ক চুক্তি এবং নীতিমালা থাকলেও এসবের তোয়াক্কা করছেন না তারা। তাদের অংশে জল বৃদ্ধি পেলেই নিয়মনীতি বহির্ভূত ভাবে খুলে দেয়া হয় ফারাক্কা বাধের মূখ। তলিয়ে যায় বাংলাদেশের নিম্নাঞ্চল। বিপাকে পড়ে বানবাসি মানুষ।

অন্যদিকে, তিস্তা কখনো ধু ধু মরুভূমি কখনো মহাসমুদ্র। এ নিয়ে চলছে কানামাছি খেলা। বাংলাদেশের বন্যায় ভারতের স্বেচ্ছাচারিতার প্রভাব নিশ্চিতভাবে এড়িয়ে যাওয়ার নয়। তবে 'যতো দোষ নন্দ ঘোষ' এমনও নয়।

মার্চ থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে প্রতিবছর-ই কমবেশি বন্যার মুখোমুখি হয় নিম্নাঞ্চলের মানুষ। ১৯৬৬, ১৯৮৮, ১৯৯১, ১৯৯৮, ২০০৮ এবং ২০১৭ সালের পর এবছরও ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে বঙ্গদেশের নিয়মিত অতিথি বন্যা। ১৯৮৮ সালের বন্যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে মারাত্মক ও ক্ষয়ক্ষতিময় প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলোর মধ্যে অন্যতম। ওই বছর আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে হওয়া বন্যায় দেশের প্রায় ৬০ শতাংশ এলাকা প্লাবিত হয়েছিল। স্থানভেদে এ দুরবস্থা স্থায়ী ছিল ১৫ থেকে ২০ দিন। তখন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও গুরুত্বের সঙ্গে প্রচারিত হয়েছিল এ বন্যার খবর।

সম্প্রতি জাতিসংঘের অফিস ফর দ্য কো-অর্ডিনেশন অব হিউম্যানিটারিয়ান অ্যাফেয়ার্সের (ওসিএইচএ) জানিয়েছে, ১৯৮৮ সালের পর বাংলাদেশে এবারের বন্যা সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। দেশে বন্যার পানি এখনও বাড়ছে, পানি রাতারাতি কমে যাবে এমন সম্ভাবনাও কম।

এ অঞ্চলের বন্যরোধে পঞ্চাশের দশকে উদযোগ গ্রহন করেছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। ১৯৫৬ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী তখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। পূর্ব বাংলায় প্রতিবছর বন্যা হয়। মানুষের অনেক কষ্ট। তিনি ধরনা দিলেন জাতিসংঘের কাছে। অবস্থা সরেজমিনে দেখার জন্য জাতিসংঘ একটা টেকনিক্যাল মিশন পাঠাল। মিশনের নেতা জে এ ক্রুগ। তাঁরা ঘুরেফিরে দেখলেন। ১৯৫৭ সালে তাঁরা জমা দিলেন একটা প্রতিবেদন। সেখানে নানান সুপারিশ। 

সুপারিশগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল:
(ক) কাপ্তাই ড্যাম ও কুষ্টিয়ার গঙ্গা-কপোতাক্ষ বহুমুখী প্রকল্প তাড়াতাড়ি শেষ করা।
(খ) ওয়ার্কস প্রোগ্রামের অধীনে ছোট ছোট বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও পানিনিষ্কাশন প্রকল্প হাতে নেওয়া।
(গ) ভূতান্ত্রিক, আবহাওয়া ও পানিসম্পদ–সম্পর্কিত সব ধরনের জরিপ চালানো এবং এ ব্যাপারে ভারতের সঙ্গে তথ্যের লেনদেন।
(ঘ) ড্রেজিং ব্যবস্থাপনা ঢেলে সাজানো।
(ঙ) পরিকল্পিত বন্যা এলাকা ফ্লাড জোন রাখা, যেখানে কোনো বসতি বা স্থাপনা থাকবে না।
(চ) এসব কাজের জন্য মেধাবী লোকদের নিয়ে স্বাধীনভাবে কাজ করতে সক্ষম একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা।

ক্রুগ কমিশনের নির্দেশনার ভিত্তিতেই পরবর্তীকালে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। জন্ম নেয় ওয়াটার অ্যান্ড পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (ওয়াপদা) । একত্রিত থাকা পানি ও বিদ্যুৎ বিভাগ অালাদা করে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে একটি স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠানে রুপান্তর করা হয় সত্তরের দশকে। পরবর্তিতে বাংলাদেশ ডেল্টা প্লান ২১০০। যেখানে ২১০০ সাল পর্যন্ত পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনার একটি রূপকল্প উপস্থাপন করা হয়েছে।

তবে কিছুতেই রোধ করা যাচ্ছেনা বন্যা। শতভাগ রোধ করা সম্ভবও নয় কেননা বন্যা কবলিত স্থানগুলোর অধিকাংশই প্লাবনভূমি। জলের স্থানে বাস করছে মানুষ । সঠিক ড্রেজিং  ব্যবস্থা এবং মজবুত বাধ নির্মাণ কিছুটা হলেও স্বস্তি এনে দিতে পারে বানবাসী মানুষকে। ভুক্তভোগী জনগোষ্ঠীর কাছে বন্যা দুর্দশার কারণ হলেও কিছু ফায়দাবাজ মানুষের কাছে এটি ফায়দা লুটবার মাধ্যম মাত্র। এক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক একটি গল্প উল্লেখ করা যেতে পারে ;
 
দুই বন্ধু একসাথে প্রকৌশলী হিসেবে ডিগ্রি লাভ করেন। তাদের একজন সড়ক ও জনপথ বিভাগে অন্যজন পানি উন্নয়ন বোর্ডে চাকরি নেন। সড়ক ও জনপথ বিভাগের প্রকৌশলী বছর কয়েক পরে চাকরি ছেড়ে দিয়ে একই বিভাগে ঠিকাদার হন। পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলী তার বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে এসে দেখেন বন্ধু অনেক বড়লোক হয়ে গিয়েছে। তিনি তার বন্ধুর বড়লোক হওয়ার নেপথ্যের কারণ জানতে চান। বন্ধু তাকে একটি নদীর কাছে নিয়ে একটি সেতু দেখিয়ে বলেন যে, সেতুটির জন্য বরাদ্দের অর্ধেক অর্থ দিয়ে সেতু নির্মাণ করেছেন অর্ধেক দিয়ে তার বাড়ি তৈরি করেছেন। কয়েকবছর পরে পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলী বন্ধুও চাকুরি ছেড়ে একই প্রতিষ্ঠানে ঠিকাদারির কাজ শুরু করেন। কিছুদিন পরে সড়ক ও জনপথের ঠিকাদার বন্ধু তার বাড়ি এসে দেখেন বন্ধু তার চেয়েও অনেক বড় আলিশান বাড়ি করেছেন। তিনি এর রহস্য জানতে চান। বন্ধু তাকে নদীর ধারে নিয়ে বললেন যে, নদীর বাধের অর্থে তিনি বড়লোক হয়েছেন। বন্ধু বললেন, তিনি তো কোনো বাধ দেখছেন না ( প্রকৃতপক্ষে কোনো বাধ ছিল না)। বন্ধুটি বললেন বাধের একশোভাগ অর্থই তার বাড়িতে লেগেছে। তবে কাগজে-কলমে বলা হয়েছে বন্যায় বাধটি ভেসে গিয়েছে।

এভাবে বাধ ভেসে গেলে বন্যা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। দুর্নীতিবাজ আর ফায়দাবাজের লাগাম টেনে ধরতে হবে নাহয় অনির্মিত বাধ বারবার ভেসে যাবে।  কোথায় বাধ ভেসে গেল? নদীতে পলি আসলো না বালু আসলো!  ড্রেজিংয়ের জন্য কতকোটি টাকা বরাদ্দ হলো? বানবাসী মানুষের কাছে সেটি ধর্তব্য নয়। তারা মূল্যায়ন করে তাদের কতটুকু চাষের জমি তলিয়ে গেল, কত ফসল নষ্ট হলো,মাথা গোজার ঠাই একমাত্র কুড়েঘড়টিও নদীগর্ভে বিলিন হয়ে গেল কিনা। এই প্রান্তিক মানুষগুলোকে বাচাতে হলে শক্ত হস্তে দমন করতে হবে দুর্নীতিবাজ-ফায়দাবাজ লুটেরাদের। বাধ ও ড্রেজিং ব্যবস্থাপনায় মেধা-মননের সবটুকু দিয়ে কাজ করতে হবে, সঠিক ও দুর্নীতিমুক্ত ভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে এ সংক্রান্ত প্রকল্পগুলোকে।

লেখক: শিক্ষার্থী, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। 
[email protected]

সোনালীনিউজ/এমএএইচ

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!