• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
বাতাসে সালফার ও নাইট্রোজেন বৃদ্ধি

কালো মেঘে লুকানো বজ্রপাতের কারণ


বিশেষ প্রতিনিধি মে ১৪, ২০১৬, ১২:০১ এএম
কালো মেঘে লুকানো বজ্রপাতের কারণ

ঢাকা: সামান্য বৃষ্টিপাত কিংবা ঝড়ো বাতাসেও ঘটছে বজ্রপাতের ঘটনা। আর বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই ঘটছে এমনটা। ঝড়-বৃষ্টির দিনে বজ্রপাতের মতো প্রাকৃতিক ঘটনা স্বাভাবিক হলেও সম্প্রতি এর পরিমাণ বেড়েছে অস্বাভাবিকভাবে। আর এই অস্বাভাবিকতার কারণ হিসেবে কালো মেঘের পরিমাণ বেড়ে যাওয়াকেই দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা।

কালো মেঘ সৃষ্টির পেছনে বাতাসে নাইট্রোজেন ও সালফার জাতীয় গ্যাসের পরিমাণ বৃদ্ধিকেই দায়ী করছেন আবহাওয়াবিদেরা। তারা বলছেন, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই এসব গ্যাসের পরিমাণ বেড়ে চলেছে। আর এ থেকেই বেড়েছে বজ্রপাতের ঘটনা। একই সঙ্গে বিভিন্ন মোবাইল ফোন অপারেটর কোম্পানির টাওয়ারও বজ্রপাতের অস্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য দায়ী বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

বজ্রপাতের ঘটনার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল। আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় মৃত্যুর সংখ্যা অনেক বেশি। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার (১২ মে) দুপুর দেড়টা থেকে শুক্রবার (১৩ মে) রাত ১১টা পর্যন্ত ঢাকা, চট্টগ্রাম, পাবনা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, রাজশাহী, নওগাঁ, সিরাজগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ ও টাঙ্গাইলসহ বিভিন্ন জেলায় বজ্রপাতে শিশুসহ ৫৭ জন প্রাণ হারিয়েছে। প্রতি মুহুর্তেই মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। এতে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন বিশেষজ্ঞসহ দেশের সাধারণ মানুষ।

পরিবেশ অধিদফতরের দেয়া তথ্যানুযায়ী, স্বাভাবিক বায়ুতে ৭৮ দশমিক শূন্য ৯ ভাগ নাইট্রোজেন, ২০ দশমিক ৯৫ ভাগ অক্সিজেন, দশমিক ৯৩ ভাগ আর্গন ও দশমিক শূন্য ৩৯ ভাগ কার্বন ডাই অক্সাইড এবং সালফারসহ সামান্য পরিমাণ অন্যান্য গ্যাস থাকে। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সর্বশেষ গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, ঢাকার প্রতি ঘনমিটার বায়ুতে ৬৪-১৪৩ মাইক্রোগ্রাম সালফার ডাই অক্সাইড বিদ্যমান। আর প্রতি ঘন মিটার বায়ুতে নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড রয়েছে ২৫-৩২ মাইক্রোগ্রাম। যা স্বাভাবিকের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি।

এদিকে, মে-জুন মাস কালবৈশাখী ঝড়ের মৌসুম হলেও বড় কোনো ঝড় বা বৃষ্টিপাত ছাড়াই সামান্য ঝড়ো বাতাসের সঙ্গেই ঘটছে বজ্রপাতের ঘটনা। আর এতে করে মারা যাচ্ছে বহু মানুষ। কালো মেঘ সৃষ্টির পেছনে বাতাসে নাইট্রোজেন ও সালফার গোত্রের গ্যাসের পরিমাণ বৃদ্ধি দায়ী। ঝড়ো বাতাসের প্রভাবে দ্রুতগতির কালো মেঘের মধ্যে ঘর্ষণ ও সংঘর্ষের ফলে সৃষ্টি হওয়া ইলেকট্রনের প্রবাহ থেকেই বজ্রপাতের সৃষ্টি হয়। ইলেকট্রনের প্রবাহকেই বিজ্ঞানের ভাষায় বিদ্যুৎ বলা হয়।

বিশেষজ্ঞদের মতে, সাদা মেঘের উপাদানের অধিকাংশই জলীয়বাষ্প বা পানির কণা হয়। ফলে সাদা মেঘে ঘর্ষণের বা সংঘর্ষের ফলে যথেষ্ট ইলেকট্রন সৃষ্টি হয় না। কিন্তু কালো মেঘে নাইট্রোজেন ও সালফার গোত্রের গ্যাসের পরিমাণ বেশি থাকায় দ্রুত গতির কারণে এ সব যৌগিক গ্যাসের মধ্যে সংঘর্ষে প্রচুর পরিমাণ ইলেকট্রনের সৃষ্টি হয়। আর এ সব ইলেকট্রন বাতাসের জলীয়বাষ্পের মাধ্যমে ভূমিতে চলে আসে এবং সৃষ্টি হয় বজ্রপাতের। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি, শিল্পায়ন ও নগরায়নের ফলে অতিমাত্রায় নাইট্রোজেন, সালফার ও কার্বন গ্যাসের নিঃসরণের পরিমাণ বেড়ে গেছে। এ সব গ্যাস মেঘের জলীয় কণার সঙ্গে মিশে যায়। মে-জুন মাসে ঋতু পরিবর্তনের কারণে বাতাসে প্রচুর জলীয়বাষ্প সৃষ্টি হয়। ফলে স্বাভাবিক বায়ু প্রবাহের কারণে এ সব জলীয়বাষ্প উপরের দিকে উঠতে থাকে। এতে কালো মেঘের মধ্যকার ঘর্ষণে তৈরি হওয়া ইলেকট্রন বা বিদ্যুৎ এ সব জলীয় কণাকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে ভূমিতে চলে আসে। কালো মেঘে থাকা যৌগিক গ্যাসগুলো রোদের তাপে এবং বাতাসের দ্রুতগতির কারণে প্লাজমা (বিক্রিয়ার অনুকূল) অবস্থায় থাকে। এতে সামান্য ঘর্ষণ বা সংঘর্ষে এ সব যৌগ গ্যাস পরস্পরের মধ্যে বিক্রিয়া ঘটায়। ফলে সৃষ্টি হয় প্রচুর পরিমাণ ইলেক্ট্রনের। মেঘের জলীয় কণায় এসব গ্যাসের পরিমাণ যত বাড়বে ইলেকট্রন বা বিদ্যুৎ সৃষ্টির পরিমাণও ততটা বাড়বে।

দায়ী মোবাইল টাওয়ারও : বজ্রপাতের কারণ হিসেবে নওগাঁ সরকারি কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ শরিফুল ইসলাম খান বলেন, তাপমাত্রা ওঠানামার কারণ এবং নিয়ম না মেনে মোবাইলের টাওয়ার বসানোর কারণে বজ্রপাত হয়ে থাকে। বিশেষজ্ঞদের মতে, আকাশে যে মেঘ তৈরি হয় তার ২৫ থেকে ৭৫ হাজার ফুটের মধ্যে বজ্রপাতের ঘটনা ঘটে বেশি। এ এলাকায় তড়িৎ প্রবাহের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংঘর্ষ ঘটে। এখানে খাড়াভাবে যে বজ্রপাতের সৃষ্টি হয় তার তাপমাত্রা ৩০ হাজার থেকে ৫০ হাজার ডিগ্রি ফারেনহাইট। বজ্রপাতের গতিও প্রতি সেকেন্ডে ৬০ হাজার মিটার বেগে নিচে বা উপরের দিকে চলে যায়। ফলে এ পরিমাণ তাপসহ বজ্রপাত মানুষের দেহের ওপর পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই মৃত্যু হওয়া স্বাভাবিক। সাধারণত আকাশের ৪ মাইল সীমার মধ্যে মেঘের সৃষ্টি হয়। এ সীমার উপরে পানি, বাতাস থাকলেও তা ঠাণ্ডা এবং হাল্কা পরিমাণে থাকে। আকাশের এ সীমার মধ্যে বিভিন্ন ধরনের মেঘের সৃষ্টি হয়। এর মধ্যে কালো বা ঘন কালো মেঘ থেকে বেশি বজ্রপাতের ঘটনা ঘটে। বিশেষ করে বিকেলের দিকেই এ ধরনের মেঘ বেশি সৃষ্টি হতে দেখা যায়। অন্য সময়ে সংঘঠিত মেঘে বজ্র আওয়াজ থাকলেও বজ্রপাতের ঘটনা কম থাকে। সূর্যতাপ না থাকায় এবং ঠাণ্ডা আবহাওয়ার কারণে রাতের বেলায় বজ্রপাতের ঘটনা খুব কম হয়ে থাকে।

বজ্রপাতের কারণ ও প্রকৃতি সম্পর্কে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের তড়িৎ কৌশল বিভাগের সাবেক প্রধান ও বর্তমান সিন্ডিকেট সদস্য অধ্যাপক মো. আবদুল মতিন বলেন, ‘প্রাকৃতিক ঘটনা হলেও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বজ্রপাতের পরিমাণ অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। কার্বন, নাইট্রোজেন ও সালফার গ্যাসের পরিমাণ যত বাড়বে বজ্রপাতের পরিমাণও ততটা বাড়তে থাকবে। আর ভূমিতে বজ্রপাত ঘটার পেছনে অপরিকল্পিত মোবাইল নেটওয়ার্কের টাওয়ারও দায়ী।’

আবদুল মতিন বলেন, ‘মোবাইল টাওয়ারগুলো উচ্চতার কারণে বজ্রপাতের প্রথম শিকার হওয়ার কথা। কিন্তু আর্থ কানেকশন (ভূ-সংযোগ) ব্যবস্থা উন্নত হওয়ায় এবং বজ্রপাতের বিদ্যুতের প্রবাহকে অন্যদিকে সরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা বা প্রযুক্তি এ সব টাওয়ারে রয়েছে। একই সঙ্গে এ সব টাওয়ার অত্যধিক ইলেক্ট্রো-ম্যাগনেটিক ফিল্ড (তড়িৎ চৌম্বকক্ষেত্র) সৃষ্টি করায় বজ্রপাতে তৈরি হওয়া ইলেকট্রনও টাওয়ারগুলোর দিকে আকৃষ্ট হয়। আর উচ্চপ্রযুক্তির কারণে বজ্রপাতের বিদ্যুৎ এ সব টাওয়ার কিছুটা ভূ-সংযোগের মাধ্যমে কমিয়ে ফেলে বাকিটা অন্যদিকে সরিয়ে দেয়। ফলে যত্রতত্র বজ্রপাতের ঘটনা ঘটছে।’
আবদুল মতিন আরও বলেন, ‘একেকটি বজ্রপাতের সময় প্রায় ৬০০ মেগা ভোল্ট বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়। বাসাবাড়িতে আমরা যে বিদ্যুৎ ব্যবহার করছি তার ক্ষমতা মাত্র ২২০ ভোল্ট। শিল্পকারখানায় ১২০০ ভোল্টের বিদ্যুৎ ব্যবহার হয়। আর জাতীয় গ্রিডে ১১ হাজার ভোল্টের বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়। একজন মানুষের মৃত্যুর জন্য মাত্র ১১০ ভোল্ট বিদ্যুতই যথেষ্ট।’ (উল্লেখ্য, ১ মেগা ভোল্ট=১০ লাখ ভোল্ট, এই হিসেবে একেকটি বজ্রপাতের সময় প্রায় ৬০ কোটি ভোল্ট বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়।

বজ্রপাতের অন্যতম কারণ কালো মেঘের উপাদান সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. এ কিউ এম মাহবুব বলেন, ‘বজ্রপাতের কারণ নিয়ে আমাদের তেমন কোনো গবেষণা নেই। তবে সৃষ্টির শুরু থেকেই বজ্রপাতের ঘটনা ঘটছে। এখনও পর্যন্ত আমরা জানি বজ্রপাত ঘটে কালো মেঘের সংঘর্ষের ফলে। সাদা মেঘে বজ্রপাত ঘটানোর মতো উপাদান থাকে না। বাংলাদেশে জুন-জুলাই মাসে মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে বাতাসে প্রচুর জলীয়বাষ্প থাকে। আর এই জলীয়বাষ্প বাতাসের প্রভাবে উপরে উঠে কালো মেঘের সৃষ্টি করে। আর কালো মেঘ বৃষ্টি ও কালবৈশাখী ঝড় সৃষ্টি করে।’

অধ্যাপক মাহবুব বলেন, ‘কালো মেঘে নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইড, সালফার ডাই অক্সাইডসহ সালফার ও নাইট্রোজেনের বেশ কিছু যৌগ গ্যাস বিদ্যমান থাকে। বায়ুমন্ডলের অন্যতম উপাদানগুলো হলো অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, হাইড্রোজেন ও কার্বন ডাইঅক্সাইড ও কার্বন মনোঅক্সাইড। কিন্তু বর্তমানে বায়ুমণ্ডলে সালফার ও নাইট্রোজেনের অন্যান্য যৌগিক গ্যাসের পরিমাণ বেড়ে গেছে। শিল্প-কারখানার নির্গত টক্সিক গ্যাসগুলো জলীয়বাষ্পের সঙ্গে একত্রিত হয়ে কালো মেঘের সঙ্গে মিশে যায়।’

অধ্যাপক মাহবুব বলেন, ‘আসলে আমাদের এ বিষয়ে কোনো গবেষণা না থাকায় আমি নিশ্চিত করে বলতে পারব না, এসব টক্সিক গ্যাস বজ্রপাতের জন্য দায়ী কিনা। তবে এসব গ্যাসের পরিমাণ বায়ুমণ্ডলে প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। একই সঙ্গে বজ্রপাতের পরিমাণটাও এখন বেড়েছে। যেহেতু কালো মেঘের সংঘর্ষে বজ্রপাতের ঘটনা ঘটে, তাই এসব টক্সিক গ্যাস বজ্রপাতের জন্য দায়ী হতে পারে।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/জেডআরসি/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!