• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

কী অন্যায় ছিল ঐ শিশুর?


মুন্তাকিম চৌধুরী মার্চ ১৮, ২০১৯, ০৭:৪৭ পিএম
কী অন্যায় ছিল ঐ শিশুর?

ঢাকা : জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলে ট্র্যাঙ্কবন্দি নবজাতক উদ্ধার ও মৃত্যুর ঘটনা খুবই বেদনাদায়ক। কী অন্যায় ছিল ঐ শিশুর?

তাকে যিনি প্রসব করেছেন, উনিতো মা, মা হিসেবে তার অনুভুতি কেমন, আমরা কি জানি?

একটি শিশু প্রসব করার আগে কতোশত দিন তাকে নিজ দেহে ধারণ করতে হয়, নিজের শরীরের মধ্যে আরেকটি শরীর ধাপে ধাপে বেড়ে ওঠে, নারীত্বের পূর্ণতা নাকি মাতৃত্বে। অথচ, এই সময়টুকু গর্ভধারিনীকে যথেষ্ট শারিরীক কষ্টের মধ্য দিয়ে পার হতে হয়; তবে মানসিক অভিজ্ঞতা স্বর্গীয় বলে শুনে এসেছি। প্রসব বেদনা ভয়াবহ, তবে মা সন্তানের মুখ দেখে সেই কষ্ট ভুলে যান – এরকম বলা হয়। এই যে দৃশ্যমান বিষয়গুলোর বিপরীতে তাত্ত্বিক বিষয়ের অবতারণা, এগুলো কেমন কেমন যেনো মনে হয়।

সমাজ কি আসলে সৎভাবে এইসব প্রচার করে? নারীকে কষ্ট স্বীকার করে নেয়ার জন্যে এইসব মনভুলানো কথা মনে গেঁথে দেয়া হয় না তো?

জাবি’র ঐ মা নিশ্চয় এতো সুখ স্বপ্ন দেখার সুযোগ পান নি, সন্তানের মুখ দেখে কষ্ট ভুলে যাবার উপায় তার ছিল না!

জানি, এপর্যন্ত পড়ে অনেকে অধৈর্য হয়ে যাচ্ছেন, তাকে মা বলাটা অনেকের পছন্দ হচ্ছে না। তাকে ব্যাভিচারিনি, স্বৈরিণী, দুষ্টা-নষ্টা বলছি না কেনো, এতে আমার প্রতিও অপ্রসন্ন হচ্ছেন কেউ কেউ। যদি তাই হয়ে থাকে, তবে জানুন, আপনাকেও ঐ শিশুটির হত্যাকারী হিসেবে আমি গণ্য করি।

উনি বিবাহ বহির্ভুত শারিরীক সম্পর্কে জড়িয়েছেন, এতে ধর্মীয় ও সামাজিক রীতির লঙ্ঘন হয়েছে, সন্দেহ নাই। (সমাজের কথায় পরে আলাদাভাবে আসছি) এদেশ সেক্যুলার, বিচারের দন্ড ধর্মের হাতে নেই, কাজেই ধর্মের বিবেচনায় অন্যায় হলেও, ধর্মীয়ভাবে তার শাস্তি দেয়ার বৈধতা কারো নেই।

নারীর শাস্তিবিধানে যারা খুব উৎসাহের সাথে উত্থিত হয়ে যান, তারা দেশকে ধর্মরাষ্ট্র বানানোর জন্যে চেষ্টা করে দেখতে পারেন। বাংলাদেশ ধর্মরাষ্ট্র হলে পরে যা করা বৈধতা পাবে, তা এখন করতে যাওয়া নিশ্চয় বৈধ নয়।

তবে, এই অতিউৎসাহীরা বুঝবে না, আমি তাদের বোঝার পরোয়াও করি না; কিন্তু জানিয়ে রাখি, আমি চাই ধর্মের শিক্ষা প্রচার পাক, ধর্মের নৈতিকতাবোধ জনমনে প্রোথিত হোক। সমাজ ধর্মানুরাগীতে ছেয়ে যাক। তবে, ঘোড়ার আগে গাড়ী জুরতে চাওয়া অনভিপ্রেত; শিক্ষা পৌঁছে দেয়ার আগে শাস্তি দিতে অতিউৎসাহ দেখানো অন্যায়।

এখন যদি সমাজের প্রসঙ্গে যাই, বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয়বর্ষের ছাত্রী, তার নারীত্বের পূর্নউদ্ভাসের মধ্যে বিবাহের বৈধতা নিয়ে শরীরবৃত্তীয় সহজাত চাহিদাগুলো মেটাতে পারছিলেন না কেনো? ক্যারিয়ার গড়তে হবে; বা অন্তত লেখাপড়া করে অমুক অমুক সার্টিফিকেট জোগাড় না হলে বায়োডাটা ইমপ্রেসিভ হবে না, যেমন ছেলের সাথে বিয়ে হলে সামাজিক মুখ রক্ষা হয়, সেরকম বিয়ের আলাপ আসবে না। ফলে অবদমনকে মেনে নিয়ে, লেখাপড়াকে গুরুত্ব দিতে হয়েছে।

তবে, এক্ষেত্রে উনি বয়সের চাপল্যে হোক, কিংবা স্বভাবে “দুষ্টা” বিধায় অবদমনের কারাগার থেকে স্খলিত হয়েছেন। এটি একটি দিক, এই স্খলনে কী শাস্তির বিধান আইনে আছে, তা হতে পারতো।

কিন্তু, সমাজ আইনের সীমায় থেমে থাকে না। সমাজ কলঙ্ক আরোপ করে, ধিক্কার দেয়, কিন্তু সাহায্যের হাত বাড়ায় না। সমাজের মূলধারাচ্যুত কোনো কোনো ব্যাক্তি কোনো কোনো সময় সাহায্যের হাত বাড়ান বটে, তবে সেগুলো খুবই দূর্লভ ব্যাতিক্রম।

কুমারি মাতা তার স্খলনের ফলে গর্ভধারণের কথা টের পাওয়ার পর প্রথম উদ্যোগ হতে পারতো গর্ভপাত ঘটানো। এতে পাপ স্খালন না হোক, আরো অনেক পাপ যে একের পর এক যোগ হলো, তা থেমে যেতে পারতো। কিন্তু, আইনি জটিলতায়, এবং সামাজিক লোকনিন্দার চাবুকের আতঙ্কে, গর্ভপাত ঘটানো সহজ নয়। কুমারি মাতা গর্ভপাত ঘটাতে গিয়ে অপ্রশিক্ষিত হাতের ক্ষপ্পরে পড়ে নানা শারিরীক জটিলতার শিকার হন, এমনকি অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মৃত্যুবরণ করার ঘটনা অহরহ ঘটছে। আরো নোংরা ব্যাপারও আছে, পাবলিক পোস্টে সেসব আর না লিখি।

এখানে, একটি প্রশ্ন আমার মনে জাগে, বাংলাদেশে কি গর্ভপাত অবৈধ? তবে, এতো গর্ভপাতের ক্লিনিক এখানে ওখানে গজায় কী করে?

গর্ভপাত যদি অবৈধ হয়, তবে, কুমারি মাতাদের ভ্রূণের ব্যাপারে বিধান কী? যে অবস্থাতেই গর্ভধারণের ঘটনা ঘটুক না কেনো, জন্ম নেয়া শিশুটিতো নিস্পাপ। ধর্ম বা সমাজের বিচারে সে ক্লেদজ কুসুম, তাই বলে তার পরিণতি ট্র্যাঙ্ক অথবা ডাস্টবিন? এটা কোনো কথা হলো?

অনেক সমাজেই এখন “সংসার” করার জন্যে বিবাহ আর শর্ত নয়। এদেশে অনেকে মনে করেন, তারা খুবই নিকৃষ্ট মানুষ – প্রায় জন্তু জানোয়ার পর্যায়ের। কিন্তু, সে ব্যাপারটির ঔচিত্য বা বিবাহ আবশ্যিক শর্ত হওয়ার আলাপে না গিয়েও বলতে পারি, ঐসব সমাজের অনেকগুলোতেই শিশুর আইনি অধিকার খুব দৃঢ়ভাবে রক্ষার চেষ্টা রাষ্ট্রীয়ভাবে করা হয়।

সেখানে আর যা-ই হোক, লোকের নিষ্ঠুর ছি ছি শোনার ভয়ে নিস্পাপ শিশুকে ডাস্টবিনে ফেলতে হয় না; সে প্রেক্ষিতে আমরা কোথায় কী অবস্থানে আছি?

এই সমাজে অগভীর শিক্ষার-চিন্তার চপল মানুষ বেশী; নিজে চিন্তা করার সক্ষমতা নেই, ফলে তারা যা বলেন, নিজে থেকে বলেন না, কোথাও কোনো আলোচনা শুনেছিলেন, সেটা খর্ব মস্তিষ্কে পুরোটা ধারণ করতে পারেন নাই, তাই কোথাও কোনো আলোচনায় দুয়েকটি কি ওয়ার্ডে মিল পেলেই, সেই আধাআধিটুকু উগড়ে দেন।

লেখার শেষে আমি কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করবো; তবে উত্তর দেয়া আবশ্যিক বিবেচনা করবেন না। আমি উত্তর পাওয়ার আশায় প্রশ্ন করি না; যিনি পড়লেন, উনি যেনো এইসব প্রশ্ন নিয়ে ভাবেন, সেই ইচ্ছে থেকে প্রশ্ন করি।

১. ধর্ম বা নৈতিক শিক্ষা সর্ব সাধারণে পৌঁছানোর দায়িত্ব কার? সেই দায়িত্বপালন কি সুসম্পন্ন হচ্ছে?

২. রোজগার, সংসার, সামাজিকতা কি ঐক্যতানে আছে?

৩. কেউ স্খলিত হলে তার শাস্তির বিধান, সংশোধনের পথ কি? এই সমাজে গুড সামারিটান, গার্ডিয়ান এঞ্জেলের দেখা পাওয়া যায় না; ছি ছি করা লোকেরা কি তাহলে বরং অপরাধী কি না?

৪. আমি ট্র্যাঙ্কে শিশু লুকানোর মধ্যে লোক লজ্জায় গোপনীয়তা বজায় রাখার চেষ্টা দেখি, কিন্তু সাথে সাথে, শিশুটিকে আগলে রাখার প্রচেষ্টাও দেখি। ফলে, সমাজের এতো ছি ছি করাকে আমি অশ্রদ্ধা করি, কারণ, আমার বিবেচনায় নৈতিক শিক্ষা প্রসারে যথেষ্ট ভূমিকা সমাজ রাখছে না, এবং “পাপী”কে ধিক্কার দেয়ার জন্যে খবিস যতো রেডি আছে, সৎপথে আনার প্রচেষ্টারত সাধু সেই তুলনায় প্রায় নেই বলা যায়। আমার কি কোথাও ভুল হচ্ছে?

ইসলাম ধর্মে তওবার ক্ষেত্রে কোনো সীমার শর্ত নাই; যতো বড় পাপীই হোক না কেনো, অন্তর থেকে অনুশোচনা করে ক্ষমা চাইলে ক্ষমার আশা করতে পারে। আল্লাহ্‌ যেখানে বান্দার তওবার জন্যে অধীর হয়ে আছেন, সেখানে কোন মোল্লা এতো বড় হয়ে গেছে যে, পাপীকে ঘৃণা-নিন্দা করে?

এবং, অন্যান্য ধর্মে পাপীর ক্ষমা নাই, এমন নিশ্চয় নয়। এবং, সমাজ যদি বিবেচনাবোধ দেখাতে ব্যার্থ হয়, সে সমাজ ঔচিত্যের লাথিতে লাথিতে ধ্বসে যাবে।

যে অচলায়তন নিস্পাপ শিশুকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করতে বাধ্য করে, তার আনুগাত্য করা অযৌক্তিক।

যদি, মধুর সান্ত্বনা-ভরে,
তুমি না মুছাবে করে,
কেন ভাসি নয়ন-সলিলে গো?

পাপী তাপী কেন সবে,
তোমারে ডাকিয়া ক’বে,
মনোব্যাথা তুমি না শুনিলে গো?

যদি, পাতকী না পায় গতি,
কেন, ত্রিভুবন-পতি,
পতিত-পাবন নাম নিলে গো?

লেখক: সমাজ বিশ্লেষক

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!