• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ভাসমান বীজতলা


ঝালকাঠি প্রতিনিধি আগস্ট ৩১, ২০১৮, ০২:৫৯ পিএম
ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ভাসমান বীজতলা

ছবি: সোনালীনিউজ

ঝালকাঠি : অতিবৃষ্টি ও বন্যায় ডুববে না। সেচের প্রয়োজন পড়বে না। কীটনাশক ছিটাতে হবে না। সারের প্রয়োজন হবে না। এমন বীজতলা এতদিন ছিল কৃষকদের স্বপ্নে। সেই স্বপ্নের বীজতলা বাস্তবেই তৈরি করছেন কৃষকরা। একটি-দুটি নয়, এমনি অর্ধশত বীজতলা তৈরি হয়েছে ঝালকাঠীতে। এ বছরই নয়, গতবছর অন্তত ৬০টি স্থানে বন্যা সহিষ্ণু ভাষমান বীজতলা তৈরি করেছিল প্রান্তিক কৃষকরা। তাদের অনুসরণ করেই চলতি আমন মৌসুমে দেশের বন্যা কবলিত ১৪ জেলার ৫৬টি উপজেলায় ৭২০টি ভাসমান আমনের বীজতলা তৈরি করা হচ্ছে। এসব বীজতলায় উৎপাদিত আমন চারা কৃষকদের মাঝে বিনামূল্যে বিতরণ করা হবে।

কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ বলছে, ‘বন্যা এলাকার কৃষকরা যেন রোপা আমনের চাষ করতে পারে, এ জন্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে চারা বিতরণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বন্যা ও বৃষ্টির জন্য যেসব এলাকার বীজতলা পানিতে ডুবে আছে। সেসব জায়গায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর নিজেদের উদ্যোগে কলাগাছের ভেলায় ভাসমন বীজতলা তৈরি করে চারা উৎপাদনের উদ্যোগ নিয়েছে। এই চারা কৃষকদের মাঝে বিনামূল্যে বিতরণ করা হবে।’ ইতিমধ্যেই ঝালকাঠীর চার উপজেলায় অর্ধশত স্থানে ভাসমান সবজি ও ধানের বীজতলা তৈরির কাজ শেষ করেছেন কৃষকরা।

বিশাল সমুদ্রে একখন্ড সবুজ : ঝালকাঠীর কাঁঠালিয়া উপজেলার আনইলবুনিয়া আর জয়খালী গ্রাম। বিষখালী তীরের এই গ্রামের কৃষি জমি জোয়ারে ডুবছে। তখন বিশাল কৃষি জমি পানি থৈ থৈ। দেখলে মনে হবে বিশাল সমুদ্র। সেই সমুদ্রের মাঝে মধ্যে একখন্ড সবুজের হাত ছানি। কাছে যেতেই অবাক হবেন। কলার ভেলায় বিশাল সমুদ্রে ভেসে বেড়াচ্ছে বীজতলাটি। ভেলার ওপর বীজতলা। গাঢ় সবুজের সেই রোপা আমন বাতাতে ভেসে বেড়াচ্ছে দিকবেদিক। যখন ভাটার সময়, তখনো ক্ষেত্রে হাটু পানি। ক্ষেতের আগাছা মাথা উঁকি দিয়ে নিজের অবস্থান জানান দিচ্ছে। সেই আগাছা ভেদ করে বীরদর্পে তখনো ভাষমান বীজতলা।

কৃষি বিভাগ বলছে, দক্ষিণাঞ্চলে প্রতিবছরই বন্যা, অতিবৃষ্টি এবং জোয়ারের পানিতে বীজতলা নষ্ট হচ্ছে। তাই যথাসময়ে ফসল উৎপাদনে বিলম্ব হচ্ছে। একই সঙ্গে ফসলের ঘাটতি হচ্ছে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রান্তিক কৃষকরা। সেই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ভাসমান বীজতলা তৈরি করতে গতবছরই কৃষকদেরকে উদ্বুদ্ধ করা হয়। অতিবৃষ্টির কারণে বীজতলার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে জেলার ৬০টি স্থানে ভাসমান বীজতলা তৈরি করা হয়েছে। সদর উপজেলায় ১৫টি, নলছিটিতে ৮টি, রাজাপুরে ১২টি এবং কাঁঠালিয়ায় ২৫টি। এ বছরও একইভাবে বীজতলা তৈরি হয়েছে।  

ভাষমান বীজতলা : জোয়ারের পানি এখনো নামেনি। এদিকে রোপা আমন ধানের বীজতলা তৈরির সময়ও শুরু হয়ে গেছে। এই অবস্থায় কৃষি বিভাগের সহযোগিতায় কাঁঠালিয়ার কৃষকেরা কলাগাছের ভেলায় রোপা আমনের ‘ভাসমান’ বীজতলা করেছেন। নলছিটি, ঝালকাঠী, রাজাপুর উপজেলায় এই ভাসমান বীজতলা তৈরি করা হচ্ছে। কাঁঠালিয়া এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, নিচু এলাকা থেকে জোয়ারের পানি না নামায় বীজতলার জন্য কলাগাছ দিয়ে ১০ মিটারের ভেলা বানানো হয়েছে। এর প্রস্থ দেড় মিটার। কচুরিপানা বিছিয়ে ভেলার ওপর কাদামাটি ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এরপর বীজ ফেলা হবে।

একেকটি ভাসমান বীজতলায় এক কেজি অঙ্কুরিত বীজ ছিটানো হয়েছে। তাতে যে চারা জন্মেছে, তা এক বিঘা জমিতে রোপণ করা সম্ভব। পানির ওপর ভাসমান থাকার কারণে এরূপ বীজতলায় পানি সেচের দরকার হয় না। জুলাই মাসের মাঝামাঝি থেকে বীজতলা তৈরির মৌসুম শুরু হয়ে গেছে। আর আগস্টের প্রথম সপ্তাহ থেকে রোপা আমনের চারা রোপণ করা যায়। তবে পানি নেমে না যাওয়ায় নিচু জমিতে চারা লাগানো যাচ্ছে না। কিন্তু নিচু এলাকার জন্য এবার বিআর-২২ জাতের রোপা আমনের বীজতলা তৈরি করা হচ্ছে। এটি বিলম্ব জাতের। আগস্ট মাসের শেষ দিকে এই জাতের ধানের চারা রোপণ করা যাবে।

কাঁঠালিয়া উপজেলা উপ সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. আবুল কালাম হাওলাদার জানান, তৈরিকৃত ভেলায় প্রতি বর্গমিটারে ৮০-১০০ গ্রাম অঙ্কুরিত বীজ ফেলতে হয়। বীজ বপনের ২৫-৩০ দিন পরেই চারা রোপনের উপযোগী হয়ে যায়। এভাবে তৈরিকৃত এক শতাংশ জমির চারা দ্বারা কমপক্ষে ২০ শতাংশ জমি রোপণ করা যায়। তিনি আরো বলেন, বন্যার পানিতে ভাসমান আগাম সবজির ও ধানের বীজতলা তৈরি করতে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে। কয়েকটি স্থানে সবজি ও ধানের বীজতলা হাতে কলমে তৈরি করে কৃষকদের দেখানো হয়েছে। এর পর কৃষকরা নিজেই সবজি ও ধানের বীজতলা তৈরি করছেন। দুটি গ্রামে আদর্শ ভাসমান ১২টি বীজতলা তৈরি করা হয়েছে।

কৃষকরা যা বলছেন : মার্চ মাসের শেষ দিকে অতিবৃষ্টির কারণে দক্ষিণাঞ্চলের বোরো ধান তলিয়ে নষ্ট হয়ে যায়। পরে আরও দুই দফা টানা বৃষ্টির কারণে আউশ ধানও নষ্ট হয়ে যায়। জুলাই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে কিছু এলাকা থেকে পানি নামতে শুরু করে। তবে বঙ্গোপসাগর তীরের নিচু এলাকা থেকে এখনো পানি নামেনি। মধ্য জুলাই থেকে বিভিন্ন উঁচু এলাকায় রোপা আমনের বীজতলা তৈরি শুরু হয়ে গেছে। নিচু এলাকায় পানি নামার পর যাতে দ্রুত চারা রোপণ করা সম্ভব হয়, সে জন্য ভাসমান বীজতলা তৈরির পরিকল্পনা নেন কৃষি কর্মকর্তারা। তবে নিম্নাঞ্চল থেকে পানি না নামলে ‘ভাসমান বীজতলা’ তৈরি কোনো কাজে আসবে না।

উপজেলার কাঁঠালিয়া ইউনিয়নের আনইলবুনিয়া, গ্রামের হাচান সিকদার বললেন, ‘সাত বিঘায় বোরো করছিলাম। সব পানিয়ে খাইয়া হালাইছে। ক্ষতির শেষ নাই। এ্যাহন আকাশো মেঘ দেখলে ডর লাগে। এরপরও ভেলায় আমনোর বীজতলা হরছি।’

জয়খালী গ্রামের আরেক কৃষক লিটন খান বলেন, একেক বিঘা জমিতে ধান রোপণ থেকে শুরু করে কাটা পর্যন্ত সাড়ে তিন থেকে চার হাজার টাকা ব্যয় হয়। কয়েকদিন পর পর বৃষ্টি হচ্ছে। পানি যতটুকু নামে, বৃষ্টিতে ততটুকুই আবার বেড়ে যায়।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/এইচএআর

Wordbridge School
Link copied!