• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

খামারিদের লোকসানের দায় কার?


বিশেষ প্রতিনিধি জুলাই ৩০, ২০১৯, ১২:২২ পিএম
খামারিদের লোকসানের দায় কার?

ঢাকা : প্রতিদিন দেশের তরল দুধ বাজারজাতকারী কোম্পানিগুলো প্রায় ৮ লাখ লিটার দুধ সংগ্রহ করে প্রান্তিক খামারিদের কাছ থেকে। যার আর্থিক মূল্য ৩ কোটি টাকারও বেশি। এখন দুধ কেনাবেচা বন্ধ থাকায় ক্ষতির মুখে পড়েছেন খামারিরা, এ বিপুল পরিমাণ অর্থ লোকসান হিসেবে গুনতে হচ্ছে তাদেরই।

রোববার (২৮ জুলাই) পাস্তুরিত দুধ উৎপাদন ও বিপণনে হাইকোর্ট থেকে পাঁচ সপ্তাহের নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার একদিন পর সোমবার (২৯ জুলাই) শুধু বাংলাদেশ দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় ইউনিয়ন পরিচালিত মিল্ক ভিটার ওপর থেকে তা প্রত্যাহার করেছেন সুপ্রিম কোর্টের চেম্বার বিচারপতি। অর্থাৎ এখন শুধু মিল্ক ভিটার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা উঠে গেল।

এমন পরিস্থিতিতে যদি মিল্ক ভিটা মঙ্গলবার (৩০ জুলাই) থেকে স্বাভাবিক সময়ের মতো প্রতিদিন ১ লাখ ৩০ হাজার লিটার দুধও সংগ্রহ করে, তারপরও অন্যান্য কোম্পানির কার্যক্রম বন্ধ থাকায় বিপুল পরিমাণ দুধ অবিক্রীত থেকে যাবে। যার খেসারত গুনতে হবে প্রান্তিক খামারিদের।
কারণ তথ্য বলছে, মিল্ক ভিটা ছাড়া আড়ং প্রতিদিন ১ লাখ ৫ হাজার, প্রাণ ডেইরি ১ লাখ ও আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজ ৯০ হাজার লিটার তরল দুধ সংগ্রহ করত। আর নিষেধাজ্ঞাসহ দেশের সবগুলো কোম্পানি মিলে দৈনিক সংগ্রহের পরিমাণ ছিল প্রায় ৮ লাখ লিটার।

অন্যদিকে পাস্তুরিত দুধ পরীক্ষায় সিসা ও ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতির বিষয়টি সামনে আসার পর থেকেই সব কোম্পানির দুধের বিক্রিই কমে গেছে।

জাতীয় ডেইরি উন্নয়ন ফোরামের এক তথ্য বলছে, দেশের দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদনকারী শীর্ষস্থানীয় চার প্রতিষ্ঠান মিল্ক ভিটা, আড়ং, প্রাণ ডেইরি ও আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজের দুধ বিক্রি বেশ কমেছে। গত মাসে (জুন) তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত যেখানে প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিদিন গড়ে চার লাখ ২৫ হাজার লিটার দুধ বিক্রি করেছে, চলতি মাসের একই সময়ে বিক্রি দুই লাখ ৮৫ হাজার ৫০০ লিটারে নেমে এসেছে।

বর্তমান পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুধে সিসা ও ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতির জন্য খামারি, সরবরাহকারী নাকি অন্য কেউ দায়ী সেটা এখনো নির্ধারণ হয়নি। যার উৎস আগে খুঁজে বের করা উচিত। তার আগে এমন সিদ্ধান্তে শুধু খামারিরাই ক্ষতির মুখে পড়ছেন।

অন্যদিকে রাজধানীর দোকানগুলোতে গতকাল আদালতের নির্দেশে দুধ সরবরাহ বন্ধ রেখেছিল কোম্পানিগুলো। পাশাপাশি দুধ সংগ্রহ এলাকা পাবনা এবং সিরাজগঞ্জেও চারটি কোম্পানি খামারিদের কাছ থেকে দুধ কেনেনি। ফলে দুধ বিক্রি না করতে পেরে প্রান্তিক খামারিরা ওইসব এলাকার রাস্তায় দুধ ঢেলে প্রতিবাদ করেছেন।

পাবনার ভাঙ্গুরা উপজেলার পাথরঘাটা গ্রামের খামারিদের সংগঠনগুলোর সমন্বয়ক হারুনুর রশিদ বলেন, হাইকোর্টের আদেশ মোতাবেক দুধ কেনা বন্ধ রেখেছে কোম্পানিগুলো। কিন্তু এখন আমরা কীভাবে বাঁচব? কীভাবে পশুর খাদ্য কিনব?

সোমবার মিল্ক ভিটার নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের পরও খামারিদের শঙ্কা কাটছে না বলে পাবনা ও সিরাজগঞ্জের এলাকার কয়েকজন খামারির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়।

তারা আরো বলেছেন, পাবনা-সিরাজগঞ্জ এলাকায় প্রতিদিন প্রায় পাঁচ লাখ লিটার দুধ উৎপাদিত হয়। যার মধ্যে মিল্ক ভিটা যদি ১ লাখ ৩০ হাজার লিটার দুধ কেনে। তারপরও বাকি দুধ অবিক্রীত থেকে যাবে।

তারা আরো জানান, ইতোমধ্যে ক্ষতিকর উপাদান পাওয়ার খবরে বাজারে তরল দুধ বিক্রি কমে গেছে। তাতে কোম্পানিগুলো দুধের দাম কমিয়ে দিয়েছিলেন। তাতে বেশ কয়েক সপ্তাহ কম দামে খোলাবাজারে বিক্রিতে বাধ্য হয়েছেন তারা। এরপর এমন সিদ্ধান্ত তাদের সর্বস্বান্ত করে দেবে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দুই জেলার প্রায় দুই লাখ খামারির আয়ের উৎস দুধ বিক্রি। সেসব খামারি উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার মধ্যে রয়েছেন। দুধ বিক্রি করতে না পারলে বাধ্য হয়ে খামার বন্ধ করে দিতে হবে।

ভাঙ্গুরার পারভাগুড়া গ্রামের খামারি হাসিনুর রহমান বলেন, আমার খামারে প্রতিদিন ৬০ লিটার করে দুধ উৎপাদন করা হয়। এই দুধ ব্র্যাক জগাতলা দুগ্ধ শীতলীকরণ কেন্দ্রে বিক্রি করি, যা এখন বন্ধ। কিন্তু এ দুধ বিক্রির টাকার ওপর ভরসা করে আমি তিন লাখ টাকা লোন নিয়ে গাভী কিনেছি। এখন ওই ব্যাংকে কিস্তি দেব কীভাবে? কীভাবে গাভীকে খাওয়াব।

তিনি বলেন, বাইরে দুধ বিক্রি করতে গেলে ছয়শ থেকে সাতশ টাকা মণ দরে দুধ বিক্রি করতে হয়। এভাবে চলতে থাকলে গাভী বিক্রি করে দেওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না।

অন্যদিকে এমন পরিস্থিতির প্রভাব আরো নেতিবাচক হতে পারে বলে জানিয়ে জাতীয় ডেইরি উন্নয়ন ফোরামের সাধারণ সম্পাদক এবং ব্র্যাক এন্টারপ্রাইজ আড়ংয়ের পরিচালক এম আনিসুর রহমান বলেন, তরল দুধ নিয়ে ভোক্তাদের মনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে। এটি জাতীয় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যার দ্রুত সমাধান করা না গেলে দেশের খামারিরা আরো বিপদে পড়বেন। কারণ এ সুযোগে মানহীন আমদানি করা গুঁড়ো দুধের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে দেশ।

তিনি আরো বলেন, সিসা বা অ্যান্টিবায়োটিক যদি থাকে, সেটার উৎস আগে খুঁজে বের করা উচিত। এর উৎস হতে পারে গরুর খাবার, ওষুধ, মাটি ও পানি। তাই উৎস কোথায়, সেটা বের করে সমাধানের সময় দেওয়া উচিত।

অন্যদিকে গতকাল আদালতে উপস্থিত মিল্ক ভিটার ব্যবস্থাপনা পরিচালক দেলোয়ার হোসাইন গণমাধ্যমকে বলেন, আমাদের কাছে কিছু রিপোর্ট ছিল যেগুলো আমরা নিজস্ব উদ্যোগে পরীক্ষা করিয়েছিলাম। সায়েন্স ল্যাবরেটরি, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরি এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন একটি ল্যাবরেটরিতে এই পরীক্ষা করিয়েছিলাম। সেগুলো আমরা চেম্বার আদালতে উপস্থাপনের জন্য দিয়েছিলাম। আদালত সেগুলো বিবেচনায় নিয়ে হাই কোর্টের আদেশটি স্থগিত করেছেন।

তিনি বলেন, এতে খামারিরা অনেক উপকৃত হবেন। সারা দেশে খামারিদের মধ্যে একটা আনন্দ কাজ করবে। মিল্ক ভিটার সংগ্রহ ৭৫ হাজার লিটারে নেমে এসেছে জানিয়ে দেলোয়ার হোসাইন আরো বলেন, যেহেতু চেম্বার আদালত হাই কোর্টের আদেশটি স্থগিত করেছেন, তাই মিল্ক ভিটা কাল থেকেই উৎপাদন, সরবরাহ ও বিপণনে যাবে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!