• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১
এসডিজি গোল-১৬ অর্জন

গলার কাঁটা রোহিঙ্গা সংকট


নিজস্ব প্রতিবেদক সেপ্টেম্বর ২২, ২০২০, ০৩:৫৫ পিএম
গলার কাঁটা রোহিঙ্গা সংকট

ঢাকা : এসডিজি (টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা) গোল-১৬ (শান্তি, ন্যায়বিচার ও কার্যকর প্রতিষ্ঠান) অর্জনে গলার কাঁটা এখন রোহিঙ্গা সংকট। এটি শুধু বাংলাদেশের শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য দুশ্চিন্তার কারণ নয়, বরং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা এবং অগ্রগতির জন্যও ভাবনার বিষয়।

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে নির্যাতনের শিকার হয়ে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। যথাযথ নাগরিকত্বের মর্যাদা নিয়ে এই আশ্রয় প্রার্থীদের মিয়ানমারে নিরাপদ ও সুশৃঙ্খল প্রত্যাবর্তন এ অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করবে বলে মনে করছে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি)।

‘টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট: বাংলাদেশের অগ্রগতি প্রতিবেদন-২০২০’-এ বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। সংস্থাটির মতে, রোহিঙ্গাদের শান্তিপূর্ণ প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করা গেলে এসডিজি অর্জনে সম্পদের ওপর চাপ কমবে। সম্মান ও মর্যাদার সঙ্গে নাগরিককে ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ করা আবশ্যক। গত জুন মাসে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে জিইডি। সমপ্রতি এটি প্রকাশ করা হয়।

প্রতিবেদনটি তৈরির দায়িত্বপ্রাপ্ত সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম বলেন, দুনিয়াজুড়ে সহিংসতা দমনে অগ্রগতি, আইনের শাসনের প্রসার, প্রাতিষ্ঠান শক্তিশালীকরণ এবং সব মানুষের জন্য ন্যায়বিচারের প্রাপ্যতা এখনো সমতাভিত্তিক হয়নি। এখনো কয়েক মিলিয়ন মানুষ নিরাপত্তা অধিকার ও সুযোগ থেকে বঞ্চিত। একই সঙ্গে রাষ্ট্রীয় সেবা এবং বৃহত্তর অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নকে অবহেলা করা হচ্ছে। সহিংসতার ভিন্ন রূপ-তথা যৌন ও জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতা এবং অপরাধপ্রবণতা  উন্নয়নের গতি টেনে ধরছে। এ জন্য এসডিজি-১৬ অর্জনে নতুন উদ্যোগ  গ্রহণ করা জরুরি।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নারীরা শারীরিক, মানসিক ও যৌন সহিংসতার বেশি শিকার হচ্ছে দরিদ্র পরিবারে। এ জন্য ব্যাপক জনসচেতনতা, আরো জোরালো প্রচেষ্টা এবং স্থানীয় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে আইন প্রয়োগেরও দরকার পড়বে। তা ছাড়া মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমনে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা দৃঢ় করা জরুরি।

পাচারকারীরা উন্নত ও তেলসমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় অতিথি কর্মীর প্রবেশে বৈধতার সুযোগ কাজে লাগায়, কেননা হাজারো বাংলাদেশি অনেক বেশি সুযোগের আশায় বিদেশে পাড়ি জমাতে চায়। তাদের অনেকেই মানব পাচারকারীদের জালে আটকা পড়ে, যারা পরবর্তীকালে অন্য দেশে জোর করে শ্রম অথবা অন্য শোষণমূলক পরিস্থিতির শিকার হয়।

জিইডির প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, এসডিজি-১৬ এর অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত বেশ ভালো অগ্রগতি অর্জন করেছে। সফলতা এসেছে সব ধরনের সহিংসতা ও সম্পর্কিত মৃত্যুহার তাৎপর্যপূর্ণভাবে কমানোর ক্ষেত্রে। সবার জন্য নিবন্ধনের মতো বৈধ পরিচয় এবং সব পর্যায়ে কার্যকর, দায়বদ্ধ ও স্বচ্ছ প্রতিষ্ঠান উন্নয়ন করা হয়েছে। দেশের সরকারের  প্রাণপণ চেষ্টা রয়েছে জনসাধারণের তথ্য অধিকার প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা ও মৌলিক স্বাধীনতা রক্ষার জন্য। এ ছাড়া সচেষ্ট রয়েছে নির্যাতন, শোষণ, পাচার এবং শিশু নির্যাতন ও সব ধরনের সহিংসতা বন্ধে।

উল্লেখযোগ্য হারে দুর্নীতি ও সব ধরনের উৎকোচ কমাতে এবং সংশ্লিষ্ট জাতীয় সংস্থাকে শক্তিশালী করতে সরকার চেষ্টা চালাচ্ছে। সহিংসতা প্রতিরোধ এবং সন্ত্রাস ও অপরাধের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা নিয়ে দেশে সব পর্যায়ে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়ানো হচ্ছে।

তা ছাড়া বহুপক্ষীয় দাতার প্ল্যাটফর্ম গ্লোবাল কমিউনিটি এনগেজমেন্ট অ্যান্ড রেসিলিয়েন্স ফান্ডের (জিসিইআরএফ) আওতায় বাংলাদেশ একটি মিশ্র ধারার পদ্ধতির প্রসার ঘটেছে। এতে সরকার ও সুশীলসমাজের কর্মীরা একসঙ্গে কাজ করেন। তারা তৃণমূল পর্যায়ের অভিঘাত সহনশীলতাকে প্রবলতর করেন ও তা কাজে লাগান উগ্রবাদ ও চরমপন্থি প্রবণতার বিরুদ্ধে। নারীর প্রতি বৈষম্য ঘটে ব্যক্তি, প্রাতিষ্ঠানিক কিংবা উদ্যোগের (এন্টারপ্রাইজ) ক্ষেত্রে। সব ধরনের বৈষম্য প্রতিরোধ আরো কার্যকর কর্মশালা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম ও তৃণমূল পর্যায়ে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, শান্তি, মানবাধিকার, স্থিতিশীলতা ও আইনের শাসনের ভিত্তিতে কার্যকর নিয়ন্ত্রণ ছাড়া টেকসই উন্নয়নের কথা চিন্তা করা অসম্ভব। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সহিংসতা ও নিরাপত্তাহীনতার বিধ্বংসী প্রভাব রয়েছে। এতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এমনকি এ থেকে সৃষ্ট দুর্দশা কয়েক প্রজন্ম ধরে স্থায়ী হয়। যৌন সহিংসতা, অপরাধ, শোষণ ও নির্যাতন অহরহ ঘটে। তবে বাংলাদেশ সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা মানুষদের রক্ষায় কাজ করছে। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আইনের শাসন ও মানবাধিকারের প্রসার ঘটানো গুরুত্বপূর্ণ। একইভাবে দেশের সরকারি প্রতিষ্ঠানে সব সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ মজবুত করাও জরুরি।

এসডিজি-১৬ অর্জনের চ্যালেঞ্জ: জিইডির প্রতিবেদনে এসডিজি-১৬ অর্জনে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ তুলে ধরা হয়েছে। এগুলোর বিষয়ে বলা হয়েছে, যদিও বেশ কিছু কার্যক্রম বাস্তবায়িত হয়েছে, তবু বেশ কিছু বিষয় রয়েছে যা এই গোল অর্জনে প্রতিবন্ধক হয়ে ওঠে।

প্রথমত, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণায়ের প্রাপ্ত তথ্য নিয়মিত হালনাগাদ করা হয় না। ফলে উপযুক্ত কার্যক্রম গ্রহণ এবং সেগুলো সঠিকভাবে পরিচালনা করা কঠিন হয়ে পড়ে। এতে অগ্রাধিকারের ক্ষেত্র নির্ধারণ ও যথাযথ অর্থায়ন কৌশল অবলম্বন করা কঠিন হয়ে যায়। এমনকি আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অন্বেষণ করাও দুরূহ হয়ে পড়ে। দ্বিতীয়ত, সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর মধ্যে অপর্যাপ্ত সমন্বয়ের কারণে বাজেট বরাদ্দ ও এসডিজি সম্পর্কিত কার্যক্রমের মূল্যায়নে অনেক অনৈক্য দেখা দেয়।

জিইডির এর আগে প্রকাশিত ২০১৮ সালের এসডিজি বাস্তবায়নে অর্থায়ন কৌশলে এসডিজি-১৬ অর্জনে বাড়তি বিনিয়োগের পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল। সে হিসাবে ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রয়োজন ধরা হয় ১০৮ কোটি টাকা বা ১ দশমিক ০৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর ধারাবাহিকতায় ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ১৭৮ কোটি টাকা বা ১ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার এবং ২০২৯-৩০ অর্থবছরে ২৩৩ কোটি টাকা বা ২ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের লক্ষ্য ধরা হয়েছিল। এই বাড়তি খরচের ৮০ শতাংশ সরকারি উৎস এবং ২০ শতাংশ বাইরের উৎস থেকে আসার কথা।

২০২০ সালে জন নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলার জন্য অতিরিক্ত ৪০ কোটি টাকা বা শূন্য দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। যা এসডিজি অর্থায়ন কৌশলের প্রাক্কলিত ব্যয়ের মাত্র ৩৬ দশমিক ৬ শতাংশ। কাজেই অর্থায়ন ঘাটতি পূরণে আন্তর্জাতিক সংস্থা ও উন্নয়ন অংশীদারদের সঙ্গে আরো সহযোগিতা বাড়ানো বুদ্ধিমানের কাজ হবে।

তৃতীয়ত, এসডিজি-১৬ অর্জনে কার্যকর বিচার ব্যবস্থায় জনসাধারণের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করাও মৌলিক চ্যালেঞ্জ।

এ ছাড়া সহিংসতার ঘটনা, বিশেষ করে পারিবারিক সহিংসতা এবং নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতার বিষয়ে অভিযোগ করা দেশে বড় একটি বিষয়। আসলে সহিংসতা রোধ, ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তিদের রক্ষা, ভিকটিমকে সহায়তা দেওয়া এবং হামলাকারীকে আরো আইনানুগ প্রক্রিয়ায় প্রক্রিয়ার আওতায় আনতে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষকে সময়মতো অবহিত করা প্রয়োজন।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!