• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

চীন-মার্কিন কূটনীতি ও কোরিয়ার ভবিষ্যৎ


আব্দুর রহমান লাবু সেপ্টেম্বর ২, ২০১৯, ০২:২০ পিএম
চীন-মার্কিন কূটনীতি ও কোরিয়ার ভবিষ্যৎ

ঢাকা : সাম্প্রতিক সময়ে অর্থনীতির খেলায় চীন-মার্কিন বাণিজ্যযুদ্ধের মাধ্যমে মূলত যুক্তরাষ্ট্র বলির পাঁঠায় পরিণত করতে চাইছে বৃহত্তর এশিয়া অঞ্চলের উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোকে। মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব কমে যাওয়ায় পশ্চিমা বিশ্বের নজর এখন পড়েছে দূরপ্রাচ্যে। মার্কিন প্রশাসন চাইছে স্থিতিশীল এশিয়াকে অস্থিতিশীল করে চীন-রাশিয়ার প্রভাব কমিয়ে এশিয়ায় নিজেদের আধিপত্য পোক্ত করতে।

কিন্তু সেই লক্ষ্য পূরণের পথে বড় বাধা হয়ে প্রতিবন্ধকতার দেয়াল তুলে রেখেছে চীন ও উত্তর কোরিয়া। তাই কোরীয় উপদ্বীপকে অশান্ত করতে সেই ১৯৫০ সাল থেকে তৎপরতা চালিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। উভয় কোরিয়ার মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র প্রত্যক্ষ সামরিক সহযোগিতা করেছিল দক্ষিণ কোরিয়াকে। ঠিক তখন থেকেই কোরিয়া ও আমেরিকার মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস দানা বাঁধে।

এদিকে আদর্শিক মিল ও বাণিজ্যিক স্বার্থে চীন রবাবরই উত্তর কোরিয়ার পাশে থেকেছে। আবার চীনের অকৃত্রিম বন্ধু রাশিয়ার অস্ত্র আমদানিকারক দেশের মধ্যে উত্তর কোরিয়া অন্যতম। তাই কোরিয়া ইস্যুতে রাশান পররাষ্ট্রনীতিও চীন অনুসৃত। অন্যদিকে এশিয়ায় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার সহযোগী হিসেবে আমেরিকা বেছে নিয়েছে অগ্রসরমাণ অর্থনীতির দেশ জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়াকে।

অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান কোরীয় ইস্যুতে দ্বৈতনীতির অনুসরণ করছে মার্কিন প্রশাসন। একদিকে স্বপ্ন দেখাচ্ছে পরমাণু কর্মসূচি প্রত্যাহার করলে উত্তর কোরিয়ার সোনালি ভবিষ্যৎ গড়ে দেবে যুক্তরাষ্ট্র; অন্যদিকে পরমাণু  কর্মসূচিতে পিছু না হটলে সামরিক পদক্ষেপে ধ্বংস করে দেওয়া হবে। কিন্তু মার্কিন মুলুকের মধু খাওয়ানোর লোভ দেখিয়ে বিষ খাওয়ানোর প্রবণতা কারো অজানা নয়।

আমরা জানি, মার্কিন স্বার্থবিরোধী অনেক দেশের রাষ্ট্রপ্রধানকে তারা সরিয়ে দিয়ে তাঁবেদার সরকার বসিয়ে স্বার্থ হাসিল করেছিল। উদাহরণস্বরূপ ইরাকি প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন ও লিবিয়ার গাদ্দাফি সরকারের পতনের প্রসঙ্গটি প্রণিধানযোগ্য।

আবার তাদের কুখ্যাত গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ’র মাধ্যমে তারা গোপন মিশন চালিয়ে অনেক দেশের শাসককে সরাতে সর্বদাই তৎপর রয়েছে। ইরানের স্বাধীন সরকারকে হটিয়ে শাহ সরকারের পত্তন কিংবা কিউবার অবিসংবাদিত নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রোকে সরাতে বারবার হামলা করেও সফল না হওয়ার ইতিহাস সবারই জানা।

গাদ্দাফি মার্কিন প্রশাসনের চতুরতার ফাঁদে পড়ে পরমাণু কর্মসূচি বন্ধ করার অল্পদিনের মধ্যেই গাদ্দাফির পতন হয়। তাই কোরিয়া যে লিবিয়ার পথ অনুসরণ করবে না, তা বলাবাহুল্য। বরং চীন-রাশিয়ার পরোক্ষ মদতে ও সহায়তায় উত্তর কোরিয়া পরমাণু কর্মসূচি চলমান রাখবে-এটাই সত্য।

পারস্পরিক উসকানি ও অব্যাহত যুদ্ধ হুমকির মধ্যেই চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে পরমাণু ইস্যুতে ভিয়েতনামে মিলিত হয়েছিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও কোরীয় নেতা কিম জং উন। সেই সংলাপে সমাধান না হলেও উত্তেজনা প্রশমিত হওয়ায় স্বস্তি ফিরে এসেছিল এশিয়সহ বিশ্বপরিমণ্ডলে। আবার উত্তর কোরিয়ান নেতা কিম জং উন ও দক্ষিণ কোরিয়ান নেতা মুন জে উনের মধ্যকার শান্তি আলোচনায় শান্তির আশা জেগেছিল বিশ্ববাসীর বুকে।

কিন্তু বিধিবাম, শান্ত কোরিয়া উপদ্বীপ মার্কিন প্রশাসনের ভুল পদক্ষেপে আবার নতুন করে অশান্ত হওয়ার পথে। সম্প্রতি আমেরিকা-দক্ষিণ কোরিয়ার যৌথ সামরিক মহড়ায় সেই ছাইচাপা আগুন যেন আবার জ্বলতে শুরু করেছে। উত্তর কোরিয়ার নতুন করে ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা ও দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে শান্তি আলোচনা নাকচ করায় যুদ্ধাশঙ্কা ঘনীভূত হচ্ছে বলেই প্রতীয়মান। এমন বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে নিরাপদ এশিয়ার স্বার্থে কূটনৈতিক উদ্যোগ জরুরি হয়ে পড়েছে বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা।

২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে কিম প্রশাসন দূরপাল্লার হাইড্রোজেন বোমাসমৃদ্ধ ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার জেরে মার্কিনি চাপে  নিরাপওা পরিষদ কোরিয়ার ওপর ষষ্ঠবারের মতো অর্থনৈতিক অবরোধ জারি করেছিল। তবে চীন-রাশিয়ার মধ্যস্থতায় আরোপিত অবরোধ কঠোরতার পরিবর্তে ছিল অনেকটাই নমনীয়।

কিন্তু অর্থনৈতিক অবরোধ-নিষেধাজ্ঞা উত্তর কোরিয়া যে থোড়াই কেয়ার করে, তা আগেই প্রমাণিত হয়েছে। যেমনটা বলেছিলেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, নিজ দেশের অস্তিত্ব রক্ষায় উত্তর কোরিয়া ঘাস খেয়ে থাকবে তবু পরমাণু কর্মসূচি থেকে পিছু হটবে না। কেননা দূরপ্রাচ্যে মার্কিন আগ্রাসন নীতি, চিরবৈরী প্রতিবেশী দেশ জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার হাত থেকে নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থেই উত্তর কোরিয়া পরমাণু অস্ত্রের সক্ষমতা অর্জন করেছিল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিভক্ত কোরিয়ার মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধে (১৯৫০-১৯৫৩) যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল প্রত্যক্ষ সামরিক-অর্থনৈতিক সহযোগিতা করেছিল দক্ষিণ কোরিয়াকে। সে সময় ভারত-জাপানও সমভাবে সমর্থন দিয়েছিল দক্ষিণ কোরিয়াকে। সে যুদ্ধে চীন-রাশিয়াকে পাশে পেয়ে সার্বভৌমত্ব টিকিয়েছিল উত্তর কোরিয়া। যুদ্ধ-পরবর্তীতে  দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। লক্ষ্য উত্তর কোরিয়াকে নিশ্চিহ্ন করে আধিপত্য বাড়িয়ে চীনসহ এশিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করা। তখন থেকেই নিজ ভূখণ্ড রক্ষা করতে চীন-রাশিয়ার পরোক্ষ সহযোগিতায় পরমাণু সক্ষমতা অর্জনের কাজে হাত দেয় উত্তর কোরিয়া।

অব্যাহত পশ্চিমা হুমকিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে প্রথমবারের মতো ২০০৬ সালে পরমাণু বোমার পরীক্ষা চালিয়ে পারমাণমিক শক্তিধর দেশের তালিকায় নাম লেখায় উত্তর কোরিয়া। ঠিক তখন থেকেই কোরীয় ইস্যুতে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি ব্যাপক পরিবর্তন আসে। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা যুদ্ধবাজ নেতা জন বোল্টন ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও চাইছেন উত্তর কোরিয়ায় সামরিক পদক্ষেপ। উভয়ের ভুল পরামর্শে ট্রাম্প র্যাপিড সিদ্ধান্ত নিয়ে আক্রমণ করলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠবে বলেই মনে করেন রাজনৈতিক বোদ্ধারা। তাই কোরীয় সংকটকে উসকে দেয় এমন কর্মকাণ্ড থেকে উভয় দেশকে বিরত রাখতে কূটনৈতিক পথে হাঁটাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ।

এদিকে এশিয়ায় ট্রাম্পের আধিপত্য খর্ব করতে উত্তর কোরিয়াকেই ট্রাম্প কার্ড হিসেবে বেছে নিয়েছে চীন ও রাশিয়া। তাই উত্তর কোরিয়াকে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে অর্থনৈতিক ও সামরিক সহায়তা দিয়ে আসছে ওই দুই বন্ধুদেশ। তাছাড়া কিম জং উনও ভালো করেই জানেন, যত দিন চীন-রাশিয়া পাশে আছে তত দিন তাদের ভূখণ্ডে হামলা চালানোর সাহস পাবে না মার্কিন প্রশাসন। কেননা সমাজতান্ত্রিক আদর্শিক ও নির্ভরযোগ্য সহযোগী চীন-রাশিয়ার কাছ থেকেই উত্তর কোরিয়া অস্ত্র আমদানি করে।

আবার উত্তর কোরিয়ার জ্বালানি চাহিদার নব্বই শতাংশ তেল রপ্তানি করে চীন। উত্তর কোরিয়ার অর্থনৈতিক অগ্রগতির অন্যতম খাত হলো বস্ত্র-বয়ন শিল্পজাত পণ্য রপ্তানি ও প্রবাসীদের রেমিট্যান্স। যাহোক, কোরীয় নেতার অব্যাহত যুদ্ধের হুমকি এবং ৪৫ শত কিলোমিটার দূরত্বে আঘান হানতে সক্ষম হোয়াসন-১০ হাইড্রোজেন বোমার পরীক্ষা চালানোয় ঘুম হারাম হয়েছে ট্রাম্প প্রশাসনের। আর নিরাপত্তা হুমকিতে ভূগছে মার্কিনিদের  ঘনিষ্ঠ মিত্র দক্ষিণ কোরিয়া-জাপান-ভারত।

এমতাবস্থায় মার্কিন-কোরিয়ার  অব্যাহত হুমকি এশিয়ায় পরমাণু প্রতিযোগিতা বাড়িয়ে দেবে নিঃসন্দেহে। নিরাপত্তার স্বার্থে দক্ষিণ কোরিয়া-জাপান এখন পরমাণু সক্ষমতা অর্জনে মনোযোগ দেবে ও সামরিক শক্তি বাড়াতে বিলিয়ন ডলার ব্যয় করবে। ইতোমধ্যে দেশ দুটি যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে অস্ত্র আমদানি করতে স্বীয় দেশের পার্লামেন্টের অনুমোদন নিয়েছেন।

এ রকম পরিস্থিতিতে চীনের ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড কর্মসূচি এতদাঞ্চলের দেশগুলোকে একাট্টা রাখার এবং চীনের প্রতি তাদের সমর্থন যুক্তরাষ্ট্রে সামরিক ও অর্থনৈতিক যুদ্ধনীতিতে বড় বাধা হয়ে দেখা দিতে পারে বলে মনে করছি। আর এর মাধ্যমে আঞ্চলিক নিরাপত্তা রক্ষাসহ পৃথিবীকে আরেকটি বিশ্বযুদ্ধ থেকে রক্ষা করবে বলে আশা রাখি।

সব থেকে বড় কথা, একবিংশ শতক হচ্ছে কূটনীতির খেলা, সামরিক শক্তির নয়। সেই কূটনীতির চাল দিয়ে জয় করতে হবে বিশ্বকে।

লেখক : কলেজশিক্ষক

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!