• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ছেলেকে বলতে পারিনি ১০০ ধর্ষকদের মধ্যে তার বাবা কে!


নিউজ ডেস্ক জুলাই ১, ২০১৯, ০৮:২৩ পিএম
ছেলেকে বলতে পারিনি ১০০ ধর্ষকদের মধ্যে তার বাবা কে!

ঢাকা: ২৪ বছর বয়সী রুয়ান্ডার এই যুবকটি একজন যুদ্ধশিশু। সে জানে না তার বাবার পরিচয়। অবশেষে এই সত্য জানার পর সে শোকে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। কেননা তার মা দেশটির গণহত্যার সময় ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন, যার ফসল এই যুবক। তিনি বিবিসি-কে বলেছেন কিভাবে তিনি তার জন্মের পেছনের ঘটনা জেনেছেন। বর্তমান সময়েও ধর্ষণ লজ্জাজনক হওয়ায় তাদের নাম বদলে দেয়া হয়েছে।

ধরা যাক ছেলেটির নাম জ্যঁ-পিয়ের। তিনি বলেন, প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনীর সময় একটি ফর্মে তার বাবা-মায়ের নাম জানতে চাওয়া হয়েছিলো। আর ঠিক ওই সময়েই নিজের বাবা সম্পর্কে জানার আগ্রহ তৈরি হয় তার মধ্যে। ‘আমি তাকে চিনি না- আমি তার নাম জানি না,’ তিনি বলেন।

তখন ঘরে বাবা না থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু ছিল না। কারণ ১৯৯৪ সালে রুয়ান্ডার গণহত্যায় ৮০০,০০০ মানুষ নিহত হওয়ায় অনেক শিশুই ছিলো পিতৃহীন। কিন্তু তারা তাদের বাবার নাম জানতো অনেক সময়ই গ্রামে মানুষের মুখে গুঞ্জন শুনেছে সে, এমনকি কয়েকবার নামও শুনেছে, কিন্তু পুরো সত্য জানতে বছরের পর বছর সময় লেগে যায় তার।

তার মা ক্যারিন তাকে যে ঘটনা শুনিয়েছিলেন তা ‘একবারেই মেনে নেয়ার মতো না। তার কাছে অনেক ধরণের তথ্য ছিল। সে গুজব শুনেছে। গ্রামের সবাই জানে যে ধর্ষণের শিকার হয়েছিলাম আমি। আর এতে আমার করার মতো তেমন কিছুই ছিল না’। বলেন ক্যারিন।

‘আমার ছেলে জিজ্ঞাসা করতে থাকে যে তার বাবা কে। কিন্তু আমি বলতে পারিনি যে আমাকে ধর্ষণ করা ১০০ জন পুরুষের মধ্যে তার বাবা আসলে কে।’

আমি পালিয়ে যেতে পারিনি

১৯৯৪ সালে ১০০ দিনের গণহত্যার সময় ধর্ষণের কারণে ঠিক কত শিশু জন্ম গ্রহণ করেছিলো তার সঠিক সংখ্যা জানা যায় না। সংঘাত বা যুদ্ধ সম্পর্কিত যৌন নির্যাতন বন্ধে কাজ করে যাচ্ছে জাতিসংঘ- কারণ যুদ্ধের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয় ধর্ষণকে। সিরিয়া থেকে শুরু করে কলোম্বিয়া কিংবা ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো থেকে শুরু করে গত বছর মিয়ানমারেও ধর্ষণকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।

জাতিসংঘ ঘোষিত যুদ্ধে যৌন নির্যাতন প্রতিরোধ দিবসকে সামনে রেখে ধর্ষণের শিকার মানুষেরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিশেষ হ্যাশট্যাগ #EndRapeinWar ব্যবহার করে নিজেদের গল্প জানাচ্ছেন। তবে যারা ধর্ষণের শিকার হয়েছেন তাদের পক্ষে ওই ঘটনার ২৫ বছর পরে এসেও সেগুলো আবার মনে করা খুব সহজ ব্যাপার নয়।

ক্যারিনের ঘটনা শুনলে বোঝা যায়, সত্য বলতে গিয়ে কেন তিনি তার ছেলে বড় হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করেছেন।

প্রথম যখন তিনি ধর্ষণের শিকার হয়েছেন তখন তিনি তার ছেলের বয়সীই ছিলেন। তিনি ছিলেন তুতসি নারী এবং শিশুদের মধ্যে যারা হুতু প্রতিবেশী, যোদ্ধা আর সেনাদের হাতে যৌন নিগ্রহের শিকার হয়েছেন বলে মনে করা হয় সেই লাখো নারীদের একজন। তখন গণহত্যা মাত্র শুরু হয়েছিলো। তখনো তার মুখের দুপাশে রামদা সদৃশ বস্তুর আঘাতে সৃষ্ট ক্ষত থেকে রক্ত পড়তো। যার কারণে এখনো তার খেতে এবং কথা বলতে সমস্যা হয়।

তার উপর আক্রমণকারীরা যারা এতদিন তার সম্প্রদায়েরই মানুষ ছিল, তারা তাকে টেনে হিঁচড়ে একটি গর্তের কাছে নিয়ে যায়, যেখানে আগে থেকেই একটি স্কুলের পুরুষ, নারী আর শিশুদের হত্যার পর মরদেহগুলো জড়ো করছিলো তারা। কিন্তু তার ক্ষত আর ব্যথার পরেও ক্যারিন জানতেন যে তিনি মরতে চান না। সেনাদের হাতে ছোট গাছ ও লাঠির দ্বারা যৌন নির্যাতনের ফলে তার দেহে অভাবনীয় ক্ষতি হবে, একথা জেনেও মরতে চাননি তিনি।

তবে এরপর যখন আরেকটি দল তার উপর হামলে পরে তার সারা শরীরে কামড়ের ক্ষত তৈরি করে তখন আর বেঁচে থাকতে চাননি তিনি। ‘এখন আমি তাড়াতাড়ি মরতে চাই। আমি অনেক বার মরতে চাই।’

কিন্তু এটা ছিল তার দুর্ভোগের শুরু মাত্র। যে হাসপাতাল তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করছিলো সেটিতেও হামলা চালিয়ে দখলে নেয় হুতু যোদ্ধারা। ‘আমি পালাতে পারিনি। আমি যেতে পারিনি কারণ আমার সব কিছুই ছিল ভাঙা,’তিনি বলেন।

‘যেকেউ চাইলেই আমার উপর যৌন নির্যাতন করতে পারতো। এমনকি তারা যদি আমার উপর প্রস্রাব করতে চাইলেও তা করতে পারতো।’

রুয়ান্ডার প্যাট্রিয়টিক ফ্রন্টের সেনারা হাসপাতালটি দখল মুক্ত করার পরেই শেষমেশ প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পেয়েছিলেন ক্যারিন। পরে ফিরেছিলেন তার গ্রামে-দুর্বল, বিধ্বস্ত, রক্তাক্ত কিন্তু জীবিত অবস্থায়। যখন চিকিৎসকরা তাকে খুঁজে বের করেন তখন তিনি গর্ভবতী ছিলেন। যা চিকিৎসকদের জন্য ছিল একটি বড় ধাক্কা।

‘আমি জিজ্ঞাসা করছিলাম যে আমি আসলে কি করবো। কারণ আমার শরীরে অবশিষ্ট বলতে তেমন কিছুই ছিল না। আমি ভাবতে পারতাম না যে কি হতে যাচ্ছে।’

‘যখন শিশুটি জন্ম নিলো, আমি বুঝতে পারি নি কি হল। আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না যে এই শিশুটি আমার থেকেই জন্ম নিয়েছে। আমি সারাক্ষণ ভাবতাম যে আমার সাথে আসলে কি হল। জন্মানোর পর আমি বাচ্চাটিকে রেখে দেই। যদিও তার প্রতি আমার কোন ভালোবাসা ছিল না।’

পরিত্যক্ত শিশু

এমন গল্প-কিংবা এর চেয়ে একটু হয়তো আলাদা- গত ২৫ বছর ধরে রুয়ান্ডার শিশুদের কাছে শত শত বার বলা হয়েছে। তবে জনসমক্ষে বলা হয়েছে খুবই কম।

‘ধর্ষণ একটি ট্যাবু। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পুরুষের পরিবর্তে দোষারোপ বা লজ্জার মুখে পরতে হয় ধর্ষণের শিকার নারীকে,’ বলেন সারভাইভারস ফান্ড (সারফ) এর প্রধান নির্বাহী স্যাম মুনডেরেরে।

গণহত্যার সময় ধর্ষণের শিকার মা ও শিশুদের শিক্ষা এবং মানসিক সহায়তায় ফাউন্ডেশন রুয়ান্ডা কর্মসূচি নামে একটি প্রকল্পের সমন্বয়ে কাজ করে সারফ।

তিনি বলেন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে, ভয়ংকর অভিজ্ঞতার কারণে অনেক স্বজনেরাই মাকে তার সন্তান পরিত্যাগ করতে বলে। অনেক ক্ষেত্রে আবার বিয়ের সম্পর্ক পর্যন্ত ভেঙ্গে যায়। সম্ভব হলে নারীরা গোপনে এই শিশুদের লালন করে। ফলে জ্যঁ পিয়েরের মতো ফর্ম পূরণ করার সময় অনেক শিশুরাই বুঝতে পারে যে তাদেরকে গর্ভে ধারণ করা হয়েছিলো মাত্র।

‘বিষয়টি এখন এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, মায়েরা তার শিশুদের বলছেন কিভাবে গণহত্যার পর তারা জন্মেছিলো। তবে অনেকের কাছে এটা বলা অনেক সহজ যে, তার বাবা যুদ্ধে মারা গিয়েছিলো। কিন্তু বাচ্চারা যখন বড় হয় তখন তারা বিভিন্ন ধরণের প্রশ্ন করতে শুরু করে। যার কারণে অনেক সময় সত্য বলতে বাধ্য হয় মায়েরা।’

স্যাম বলেন, বছরে পর বছর ধরে, ফাউন্ডেশন রুয়ান্ডা মায়েদের এ বিষয়ে সহায়তা করে চলেছে। কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সত্য ঘটনা শিশুদের মধ্যে মানসিক আঘাত তৈরি করে।

‘এমন ঘটনার প্রভাব দীর্ঘদিন ধরে থেকে যেতে পারে। এমনকি এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মেও এটি প্রভাব বিস্তার করে,’তিনি বলেন। স্যাম একজন তরুণীর কথা বলেন, যিনি তার বাবার বিষয়টি তার নতুন স্বামীর কাছ থেকে গোপন করেছিলো। কারণ, তার মতে, এটি জানলে তার বিবাহিত জীবনে ক্ষতিকর প্রভাব পরার আশঙ্কা ছিল।

তারপর আরেকজন মায়ের কথা বলেন তিনি, যিনি তার মেয়ের প্রতি খারাপ আচরণ করতেন। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন যে, তার বাজে স্বভাবের পেছনে তার জন্মের প্রক্রিয়া দায়ী ছিল।

আর ক্যারিনের মতো অনেক মা রয়েছেন যারা তাদের সন্তানের জন্য কোন মমতা অনুভব করেন না। যার প্রভাব এখনো পর্যন্ত পুরোপুরি বোঝা সম্ভব হয়নি।

‘আমাদের চিন্তার বাইরেও অনেক প্রভাব থাকে," বলেন স্যাম। ‘এসব তরুণদের নিজেদেরই অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়। আমরা সহায়তা করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। যাতে তারা সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। তারা যাতে বুঝতে পারে যে, রুয়ান্ডার আর দশজন তরুণের মতোই স্বাভাবিক তারা।’

সম্পর্কের আঘাত

শেষমেশ ক্যারিন জ্যঁ-পিয়েরেকে তার ১৯ কিংবা ২০ বছর বয়সে গর্ভধারণ এবং সন্তান জন্মদানের পুরো ঘটনাই বলেন। পিয়েরে সেটা মেনে নেন। কিন্তু এখনো তার মনে হয় যে, তার জীবনে তার বাবার কমতি রয়েছে। যাই হোক আশ্চর্যজনকভাবে, তার মায়ের উপর যে ব্যক্তি হামলা করেছিলো তাকে ঘৃণা করে না সে। আর, ক্যারিনও তাকে ক্ষমা করার সিদ্ধান্ত নেয়।

তিনি বলেন, বাস্তবিক সত্য হচ্ছে, ‘আমার জন্য অন্যতম কষ্টের বিষয় ছিলো তাদের সম্পর্কে ভাবা। কিন্তু যখন আমি ক্ষমা করলাম, আমার ভালো লাগতে শুরু করলো।’

জ্যঁ পিয়েরে বলেন, ‘তার প্রতি আমার কখনো রাগ হয়নি। মাঝে মাঝে আমি তার সম্পর্কে ভাবি, আমার মনে হয়, জীবনে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমার বাবাকে পাশে পেলে আমার অনেক ভালো লাগতো।’

একজন মেকানিক হওয়ার জন্য প্রশিক্ষণ নেয়ার চিন্তা করছেন জ্যঁ এবং এক সময় তার নিজেরও একটা পরিবার থাকবে।

‘আমি আমার পরিবারকেও সাহায্য করতে চাই,’তিনি বলেন। যদিও তার জন্য অর্থের প্রয়োজন আর অর্থই আমার কাছে তেমন নেই।

আর ক্যারিন, বড় হওয়ার পর জ্যঁ পিয়েরের সাথে সম্পর্ক মজবুত করতে কাউন্সেলিংয়ে অংশগ্রহণ করেছেন। ‘আমি এখন মনে করি এটাই আমার সন্তান।’

সারফের সহায়তায় কেনা নতুন বাড়ির সিঁড়িতে বসে দূর পাহাড়ের দিকে তাদের তাকিয়ে থাকা দেখলে পোক্ত সম্পর্কের আঁচ পাওয়া যায়। গ্রামের পাশেই তাদের বাড়িটি- সেই গ্রাম, যে গ্রামে বেড়ে উঠেছেন ক্যারিন, যে গ্রাম ছেড়ে পালিয়েছেন একসময়। সেই গ্রাম যেখানে পিয়েরেকে শুধু একজন তরুণ নামে ডাকা হতো।

কিন্তু এখন সবকিছু শান্ত। পরিবার আর সম্প্রদায়, সবাই তাদেরকে মেনে নিয়েছে।

‘তারা জানে যে দীর্ঘ সময় ভয়ংকর অভিজ্ঞতার শোকে স্তব্ধ হয়ে পার করেছি আমি এবং এখানে আমি সুখী,’ক্যারিন বলেন। আর জ্যঁ পিয়েরে তার মাকে নিয়ে গর্বিত।’এটা বোঝাটা একটু কঠিন কিন্তু আমি তার উন্নতিতে খুব খুশি হয়েছি। তার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোকে তিনি যেভাবে নিয়েছেন। ভবিষ্যৎ এবং সামনে এগিয়ে যাওয়া নিয়ে তিনি যেভাবে ভাবেন তা আমার খুবই পছন্দ।’

সোনালীনিউজ/ঢাকা/এসএস

Wordbridge School
Link copied!