• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি ১৮৬৫ কোটি টাকা


নিজস্ব প্রতিবেদক আগস্ট ৬, ২০১৯, ০২:১১ পিএম
জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি ১৮৬৫ কোটি টাকা

ঢাকা : মিয়ানমারের রাখাইনে সেনাবাহিনী ও সরকার সমর্থকদের নিপীড়ন ও জিঘাংসার শিকার হয়ে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর থেকে নতুন-পুরনো মিলে ১১ লাখ ১৯ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের ৩৪টি শরণার্থী শিবিরে এখন তারা বসবাস করছে।

বন ও পাহাড় কেটে তাদের বসতি গড়ে তুলতে গত দুই বছরে ধ্বংস হয়েছে ছয় হাজার ২০০ একর বন। কক্সবাজারের দক্ষিণ বন বিভাগের এসব বনের মধ্যে দুই হাজার ২৭ একর সৃজিত আর চার হাজার ১৩৬ একর প্রাকৃতিক বন।

গত ৩ জুলাই কক্সবাজারের দক্ষিণ বন বিভাগ থেকে চট্টগ্রাম বনসংরক্ষক দপ্তরে পাঠানো এক প্রতিবেদনে এসব উল্লেখ করা হয়। বন বিভাগ বলছে, রোহিঙ্গাদের আগমনে কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের বনজ এবং জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি হয়েছে প্রায় এক হাজার ৮৬৫ কোটি ৫৬ লাখ ৫৭ হাজার টাকা।

প্রতিবেদনে বলা হয়, আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা বসবাস করছেন উখিয়ার কুতুপালং, বালুখালী, বালুখালী ঢালা, ময়নারঘোনা, তাজনিম-খোলা, মক্করার বিল, হাকিমপাড়া, জামতলি বাঘঘোনা, শফিউল্লাকাটা এবং টেকনাফের পুটিবুনিয়া ও কেরানতলী এলাকাসহ বন বিভাগের গেজেটভুক্ত প্রায় ছয় হাজার ২০০ একর বনভূমিতে। রোহিঙ্গাদের আগমনে বন ও পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।

টাকার হিসাবে সৃজিত এবং প্রাকৃতিক বনের ক্ষতি হয়েছে ৪৫৬ কোটি আট লাখ তিন হাজার ৬৪০ টাকা। একইভাবে জীববৈচিত্র্যের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এক হাজার ৪০৯ কোটি ৪৮ লাখ ৫৪ হাজার ১৯৫ টাকা। সে হিসাবে বনজ এবং জীববৈচিত্র্যের ক্ষতির পরিমাণ টাকার হিসাবে এক হাজার ৮৬৫ কোটি ৫৬ লাখ ৫৭ হাজার ৮৩৫ টাকা।

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ইতোমধ্যে ক্যাম্পে দুই লাখ ১২ হাজার ৬০৭টি ঘর, আট হাজার ৫২৪টি নলকূপ, ৫২ হাজার ১৬৫টি টয়লেট, ১৩ হাজার ৭০৮টি গোসলখানা, ১৩ কিলোমিটার বিদ্যুৎ লাইন, ৩০ কিলোমিটার সড়ক, ত্রাণ সংরক্ষণের জন্য ২০টি অস্থায়ী গুদাম এবং ২০ কিলোমিটার খাল খনন করা হয়েছে। স্থাপনার সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এমনকি স্থাপনা নির্মাণের জন্য সরকারি-বেসরকারি এবং আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলো ব্যাপক হারে পাহাড় কাটছে।

পাহাড় কেটে ক্যাম্প ইনচার্জ, পুলিশ ক্যাম্প, বিভিন্ন সংস্থার অফিসের জন্য স্থায়ী অবকাঠামো তৈরি করা হচ্ছে, যা বন ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি।

এছাড়া বিশ্বব্যাংক এবং এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়নে শিগগিরই সেখানে তিনতলা ২০টি সাইক্লোন শেল্টার, ৬০টি গভীর নলকূপসহ পানি সংরক্ষণাগার ও পানি সঞ্চালন লাইন, ২০টি ফিক্যাল স্লাজ ম্যানেজমেন্ট ইউনিট, ২০টি সেফটিক ট্যাংক, ছয়টি সাব-স্টেশনসহ ৫০ কিলোমিটার বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন, পর্যাপ্ত রাস্তাঘাট, সেতু-কালভার্ট এবং অন্যান্য অবকাঠামো তৈরি করা হবে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে উখিয়া-টেকনাফের বনভূমি ও বনজসম্পদ পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাবে বলে প্রতিবেদনে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়।

প্রতিবেদন আরো বলছে, কক্সবাজার জেলার পাহাড়গুলো প্রধানত নরম ও দোআঁশ মাটির হওয়ায় মাটির কাঠিন্য বা দৃঢ়তা কম। ফলে টানা কয়েকদিন বৃষ্টি হলে পাহাড়ধসের আশঙ্কা বেড়ে যায়। গত বর্ষা মৌসুমেও পাহাড়ধসে অনেক ক্ষতি হয়েছে। উখিয়া ও টেকনাফে পাহাড় এবং বনভূমি কেটে অপরিকল্পিত রোহিঙ্গা বসতি গড়ে তোলায় বর্ষায় পাহাড়ধসের আশঙ্কাও রয়েছে।

কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) হুমায়ুন কবীর বলেন, রোহিঙ্গাদের দ্বারা ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণের জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।

এ কমিটি প্রাথমিকভাবে যে প্রতিবেদন দিয়েছে, সে প্রতিবেদনে সৃজিত বন, প্রাকৃতিক বন আর জীববৈচিত্র্য মূলত তিন ভাগে ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়েছে, যা টাকার অঙ্কে এক হাজার ৮৬৫ কোটি ৫৬ লাখ ৫৭ হাজার ৮৩৫ টাকা।

কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালাম বলেন, রোহিঙ্গারা আসার কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে বনের। বনভূমিতেই তাদের জন্য আবাসস্থল তৈরি করা হয়েছে। বন পরিবেশের এ ক্ষতি কোনোভাবেই পোষানো সম্ভব নয়। এমন পরিস্থিতিতে ক্যাম্পের অভ্যন্তরে বনায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আশা করি কিছুটা হলেও বনের ক্ষতি পোষানো যাবে।

প্রতিবেদন প্রকাশের অগেই গত ২০ জুন রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলনকেন্দ্রে বিশ্ব পরিবেশ দিবস ও বৃক্ষমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এমন ক্ষতির ইঙ্গিত দেন। তিনি বলেন, মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মানবিক কারণে আশ্রয় দেওয়া হলেও তাদের কারণে বনাঞ্চলের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে।

ফের ১০ জুলাই রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ‘গ্লোবাল কনভেনশন অন অ্যাডাপটেশনের সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী তার কথা অনেকটা পুনর্ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর কারণে দেশের প্রাকৃতিক পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে। ফলে এলাকাগুলো অনেকটাই অনিরাপদ ও ঝূঁকিপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। তাই যত দ্রুত তারা নিজেদের দেশে ফিরে যায়, ততই সেটা বাংলাদেশের জন্য মঙ্গল হবে বলে আমি মনে করি।

সবশেষ এমন ক্ষতি পুষিয়ে নিতে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোর ভেতর-বাইরে বিভিন্ন প্রজাতির সাড়ে সাত লাখ গাছের চারা লাগানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তিনটি আন্তর্জাতিক সংস্থা পরিচালিত ‘সেফ প্লাস’ কর্মসূচি এবং আরো কিছু বেসরকারি সংস্থার সমন্বিত উদ্যোগে এই বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি বর্ষাকালজুড়ে চলবে বলে জানিয়েছেন ইন্টার সেক্টর কো-অর্ডিনেশন গ্রুপের (আইএসসিজি) মুখপাত্র সৈকত বিশ্বাস।

রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে পাহাড়ধসের ঝুঁকি কমাতে তিন বছরমেয়াদি ‘সেফ প্লাস’ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে জাতিসংঘের তিনটি সংস্থা; আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম), কৃষি ও খাদ্যবিষয়ক সংস্থা (এফএও) এবং বিশ্বখাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি)।

বনায়নের পাশাপাশি বনাঞ্চল উজাড় ঠেকাতে তারা জ্বালানি কাঠের বিকল্প হিসেবে এক লাখ ৪৫ হাজার রোহিঙ্গা পরিবারে এলপিজি গ্যাস সরবরাহ করছে। ২০১৮ সালের মার্চ থেকে এ কর্মসূচি চলমান রয়েছে।

সৈকত বিশ্বাস বেনারকে বলেন, আইওএম, এফএও এবং ডব্লিউএফপি ছাড়াও বনায়ন কর্মসূচিতে যোগ দিয়েছে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা-ইউএনএইচসিআর, ব্রিটিশ আমেরিকান ট্যোবাকো বাংলাদেশ (বিএটিবিসি) এবং দেশি-বিদেশি বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা।

জুনের শেষভাগে কক্সবাজারের এক অনুষ্ঠানে সেফ প্লাসের আইওএম ইউনিটের প্রধান প্যাট্রিক কেরিগনন বলেন, এখন পর্যন্ত এই কর্মসূচি খুবই সফল। কিন্তু তিন বছরমেয়াদি প্রকল্পে পর্যাপ্ত অর্থ সহায়তা পাওয়া যায়নি। অনুষ্ঠানে ডব্লিউএফপির ইমারজেন্সি কো-অর্ডিনেটর (ইসি) পিটার গেস্ট বলেন, রোহিঙ্গাদের আবাসস্থল তৈরির জন্য বনাঞ্চল ধ্বংস হয়েছে। বনের এই ক্ষয়ক্ষতি পুনরুদ্ধারে আমরা বনায়নের উদ্যোগ নিয়েছি।

এর মাঝেই সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুরো ক্ষতি কোনো দিনও পূরণ হবে না। উখিয়ার কুতুপালং, মধুরছড়া ও লম্বাশিয়া শরণার্থী শিবির সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, পাহাড়ধস ঠেকাতে পাহাড়ের ঢালুতে লাগানো হচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ, দেওয়া হয়েছে বাঁশের বেড়া। আর সেখানেই লাগানো হচ্ছে, সেগুন, গর্জন, নিমসহ নানা প্রজাতির গাছ আর সবুজ ঘাস।

উখিয়ার মধুরছড়ার ক্যাম্প-১৭-এর হেড মাঝি আবু তাহের বেনারকে বলেন, রোহিঙ্গারা এসব এলাকায় যখন আসে, তখন ছোট-বড় অনেক গাছ ছিল। নানা কারণে এগুলো কাটা পড়েছে। কেউ ঘর তৈরির জন্য গাছ কেটেছে, কেউবা জ্বালানি হিসাবে ব্যবহারের জন্য গাছ কেটেছে। নানা কারণে এলাকাটি গাছশূন্য।

রোহিঙ্গাদের অধিকার আদায়ের সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের চেয়ারম্যান মুহিব উল্লাহ বেনারকে বলেন, গাছগুলো বড় হলে কিছুটা হলেও পরিবেশের ক্ষতি কেটে যাবে। এ জন্য রোহিঙ্গাদের সচেতনতা বাড়াতে হবে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!