• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

জুয়ার টাকায় বিলাসী জীবন, ফেঁসে যাচ্ছেন মেনন


নিজস্ব প্রতিবেদক অক্টোবর ২২, ২০১৯, ০৫:১৭ পিএম
জুয়ার টাকায় বিলাসী জীবন, ফেঁসে যাচ্ছেন মেনন

ঢাকা: ইয়াংম্যানস ক্লাবের চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননের নাম ক্যাসিনোর সুবিধাভোগী হিসেবে উঠে এসেছে। সাম্প্রতি ক্ষমতাসীন জোট ১৪ দলের এই বর্ষীয়ান নেতা ঢাকার ক্যাসিনো কারবারের নায়ক ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট ও খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়ার কাছ থেকে ক্যাসিনোর টাকার ভাগ নিতেন।

যুবলীগ ঢাকা দক্ষিণের বহিষ্কৃত সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট ও সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া র‌্যাব হেফাজতে রিমান্ডে এই তথ্য দিয়েছেন।

র‌্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে দুজনই বলেছেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ওয়ার্কার্স পার্টির চেয়ারম্যান রাশেদ খান মেননকে মোটা অঙ্কের অর্থ দিয়েছেন তারা। এ ছাড়া দীর্ঘদিন তাকে প্রতি মাসে মোটা অঙ্কের টাকা দিতেন তারা। এর বিনিময়ে মেনন তাদের ক্যাসিনো কারবারে সহযোগিতা করতেন। তাদের দেয়া এসব তথ্য যাচাই-বাছাই করে র‌্যাব এরই মধ্যে অনেক সত্যতা পেয়েছে। ক্যাসিনো সম্রাট ও খালেদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে জিজ্ঞাসাবাদ করা হতে পারে রাশেদ খান মেননসহ যুবলীগ স্বেচ্ছাসেবক লীগের শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন নেতাকে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে। 

ক্ষমতাসীন দলের একাধিক নেতার বক্তব্যেও রাশেদ খান মেননকে জিজ্ঞাসাবাদের ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। রমনা থানায় করা অস্ত্র ও মাদক আইনের মামলায় সম্রাট ১০ দিন এবং তার সহযোগী এনামুল হক ওরফে আরমান পাঁচ দিনের রিমান্ডে রয়েছেন। সোমবার তাদের রিমান্ডের ছয় দিন পার হয়েছে। র‌্যাব-১ কার্যালয়ে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। রাজনৈতিক নেতা নামধারী অনেকেই সম্রাটের দফতরে হাজির হতেন জুয়ার টাকার ভাগ নিতে। প্রতি মাসে ব্যাগভর্তি করে জুয়ার টাকা নিয়ে তারা বেরিয়ে যেতেন। সিসি ক্যামেরায় ধারণ করা ভিডিও ফুটেজেও এর প্রমাণ রয়েছে। 

অন্যদিকে, আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের বিভিন্ন নেতা ছাড়াও টাকার ভাগ পেতেন পল্টন, মতিঝিল ও ফকিরাপুল এলাকার প্রভাবশালীরা। র‌্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে সম্রাট তার চাঁদাবাজির টাকার ভাগ নেয়া প্রভাবশালী যাদের নাম বলেছেন, তাদের মধ্যে রয়েছেন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মোল্লা আবু কাওসার এবং যুবলীগের একজন শীর্ষ নেতা। সম্রাটের কাছ থেকে মাসে ১০ লাখ টাকা চাঁদা নিতেন মেনন। 

এমনকি প্রতি মাসে নিয়মিত মাসোহারা না পেলে তিনি অকথ্য ভাষায় যুবলীগের নেতাদের গালাগাল করতেন। জুয়ার টাকায় ঘন ঘন বিদেশ ভ্রমণসহ বিলাসী জীবনযাপন শুরু করেন বর্ষীয়ান এই বামপন্থী নেতা। ইয়াংমেনস ক্লাব থেকে র‌্যাবের উদ্ধার করা চাঁদাবাজির খাতায় মেননের নাম রয়েছে ৫নং সিরিয়ালে।

এদিকে, র‌্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে সম্রাট জানান, গত সংসদ নির্বাচনের আগে রাশেদ খান মেনন এককালীন দেড় কোটি টাকা নেন। পার্টির ফান্ডে নির্বাচনী ডোনেশন হিসেবে এই টাকা নেন তিনি। এ ছাড়া পোস্টার ছাপানো থেকে শুরু করে নির্বাচনী ক্যাম্প বানানো ও মাইকে প্রচারের সবকিছুই আয়োজন করে দেন সম্রাট। খালেদের মাধ্যমে এসব নির্বাচনী আনুষ্ঠানিকতা সম্পর্কিত খরচের বিল দেয়া হতো।

তিনি আরও বলেন, তিনি নিজেও ঢাকা-৮ আসন থেকে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। রাশেদ খান মেনন তাকে নির্বাচনে সব ধরনের সহায়তার আশ্বাস দেন। সম্রাটকে বিশেষ স্নেহ করতেন রাশেদ খান মেনন। রাজনৈতিক মহলে সম্রাটের অকুণ্ঠ প্রশংসা করতেন। বিভিন্ন সভা-সমাবেশে প্রকাশ্যেই বলতেন ‘সম্রাটের হৃদয় আকাশের মতো উদার। সে একদিন অনেক বড় নেতা হবে’।

জিজ্ঞাসাবাদে সম্রাট জানিয়েছেন, আন্ডারওয়ার্ল্ডের সন্ত্রাসী থেকে খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে যুবলীগের রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করেন রাশেদ খান মেনন। খালেদকে আরও বড় পদ-পদবি দেয়ার জন্য তিনি বিভিন্ন প্রভাবশালী মহলে তদবির করেন। মেননের আশ্রয় পেয়ে রাজধানীর বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করেন খালেদ। রাজধানীর অন্যতম বৃহৎ প্রাচীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হাবিবুল্লাহ বাহার কলেজে খালেদের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। 

এই কলেজে নিয়োগ বাণিজ্য থেকে শুরু করে উন্নয়নকাজ ও শিক্ষার্থী ভর্তিতে বিপুল অংকের টাকা লেনদেন হয়। খালেদের মাধ্যমে এই টাকার একটি বড় অংশ চলে যেত রাশেদ খান মেননের পকেটে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি থাকাকালেও মেননের বিরুদ্ধে ভর্তি বাণিজ্যের অভিযোগ ওঠে। নামকরা দুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভিকারুননিসা নূন ও আইডিয়াল কলেজে ভর্তি বাণিজ্যের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন রাশেদ খান মেনন ও তার সহযোগীরা। মেননের বিরুদ্ধে অনেক অভিভাবক শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে লিখিত অভিযোগও জমা দেন। কিন্তু শেষমেশ তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। 

এ ছাড়া আইডিয়াল স্কুলে ভর্তিবাণিজ্য নিয়ে সাংবাদিকরা অনুসন্ধান করে তার বিরুদ্ধে ভয়াবহ নিয়োগ বাণিজ্যের প্রমাণ পায়। কিন্তু তার হাইভোল্টেজ তদবিরের কারণে ওই সময় এসব রিপোর্ট কেউ ছাপতে পারেনি। ২৮ সেপ্টেম্বর ইয়ংম্যানস ক্লাবে অভিযান চালানোর সময় ক্যাসিনো থেকে আর্থিক সুবিধাভোগীদের নামের একটি লম্বা লিস্ট উদ্ধার করে র‌্যাব। এ তালিকার ৫ নম্বরে নাম আছে রাশেদ খান মেননের। তার নামের পাশে লেখা আছে ১০ লাখ। 

অর্থাৎ ক্যাসিনো থেকে মাসে রাশেদ খান মেনন ১০ লাখ টাকা পেতেন। অবশ্য ক্যাসিনোর সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন রাশেদ খান মেনন এমপি। তিনি বারবারই গণমাধ্যমে বলছেন, ক্লাব পরিচালনার সঙ্গে জড়িত থাকলেও ক্যাসিনোর সঙ্গে তার কোনো সম্পৃক্ততা নেই।

এ ছাড়া র‌্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে সম্রাট জানান, গত সংসদ নির্বাচনের আগে রাশেদ খান মেনন এককালীন কয়েক কোটি টাকা নেন। পার্টি ফান্ডে নির্বাচনী ডোনেশন হিসেবে এই টাকা নেন তিনি। এ ছাড়া পোস্টার ছাপানো থেকে শুরু করে নির্বাচনী ক্যাম্প বানানো ও মাইকে প্রচারের সবকিছুই আয়োজন করে দেন সম্রাট। খালেদের মাধ্যমে এসব নির্বাচনী আনুষ্ঠানিকতা সম্পর্কিত খরচের বিল দেয়া হতো।

সম্রাট আরও বলেন, তিনি নিজেও ঢাকা-৮ আসন থেকে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। রাশেদ খান মেনন তাকে নির্বাচনে সব ধরনের সহায়তার আশ্বাস দেন। সম্রাটকে বিশেষ স্নেহ করতেন রাশেদ খান মেনন। রাজনৈতিক মহলে সম্রাটের অকুণ্ঠ প্রশংসা করতেন। বিভিন্ন সভা-সমাবেশে প্রকাশ্যেই বলতেন ‘সম্রাটের হৃদয় আকাশের মতো উদার। সে একদিন অনেক বড় নেতা হবে’।

সূত্র আরো জানায়, রিমান্ড জিজ্ঞাসাবাদে বহিষ্কৃত যুবলীগ নেতা খালেদও তথ্যপ্রমাণ দিয়ে মেননের চাঁদাবাজির ফিরিস্তি তুলে ধরে। খালেদ জানান, মেনন ভাইকে বিভিন্ন টেন্ডার থেকেও টাকাপয়সা দিতে হতো। বড় বড় অনেক ঠিকাদারি কাজের টেন্ডার পাওয়ার পর ৫ পার্সেন্ট হারেও কমিশন নিয়েছেন মেনন। জিকে শামীমের সঙ্গে তার বিশেষ সখ্যতা গড়ে ওঠে।

এদিকে, র‌্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে ক্যাসিনো কেলেঙ্কারিতে বামপন্থী নেতা রাশেদ খান মেননের নাম উঠে আসা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল সারওয়ার বিন কাশেম বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে সম্রাট অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন। এসব তথ্য-উপাত্ত যাচাই-বাছাই করে দেখা হচ্ছে। ক্যাসিনোর সঙ্গে যারাই জড়িত ছিলেন তাদের সবাইকেই আইনের মুখোমুখি করা হবে। 

সে ক্ষেত্রে কে বাম নেতা বা কে ডানপন্থী নেতা তা আমাদের বিবেচ্য নয়।ক্যাসিনো থেকে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননের চাঁদা নেয়ার অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক ও তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ।

তিনি আরো বলেন, ‘বিষয়টি তদন্তাধীন। তবে আমি মনে করি, যদি এটি (মেননের বিরুদ্ধে অভিযোগ) সত্য প্রমাণিত হয়, সেটি অত্যন্ত দুঃখজনক হবে। যে ধরনের রাজনীতিবিদের নাম এখানে আসছে, সেটি আসাটাই উচিত হয়নি। আসাটা আমরা কখনও কল্পনাও করিনি।

 ড. হাছান মাহমুদ বলেন, ‘যে কারও নাম যদি আসে তাদের বিরুদ্ধে তো দেশের আইন আছে, আইন অনুযায়ী অবশ্যই ব্যবস্থা হবে।’

তবে সম্রাট ও খালেদ রিমান্ডে যেসব তথ্য দিয়েছেন, তা অস্বীকার ও মিথ্যা দাবি করে রাশেদ খান মেনন। 

তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘রিমান্ডে যারা এসব তথ্য দিচ্ছে, তা সত্য নয়। যেখানে ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক কমিশনার বলেছেন ক্যাসিনোর বিষয়ে তিনি কিছু জানতেন না, সেখানে ক্যাসিনোর ব্যাপারে আমি কী করে জানব। আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা তথ্য ছাড়ানো হচ্ছে।’

সোনালীনিউজ/এমএএইচ

Wordbridge School
Link copied!