• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

জেলিমাখা ঝকঝকে মাছ বাজারে, নষ্ট করতে পারে কিডনি-খাদ্যনালি


নিউজ ডেস্ক সেপ্টেম্বর ১১, ২০২০, ০৯:২৩ এএম
জেলিমাখা ঝকঝকে মাছ বাজারে, নষ্ট করতে পারে কিডনি-খাদ্যনালি

ঢাকা: রাজধানীর মতিঝিলে বাংলাদেশ ব্যাংক আর জীবন বীমা টাওয়ারের মাঝখানের ফাঁকা গলিতে বসে মাছের বাজার। বাজারের ২০টি দোকানের প্রতিটিতেই বিকেলের ঝকঝকে আলোতেও মাছের ডালার ওপর জ্বলছে চার-পাঁচটি এনার্জি সেভিং বাল্ব। যেখানে ১৮ ওয়াটের বাতিতে বড় একটি কক্ষ আলোকিত হয়ে যায়, সেখানে চার ফুট বাই চার ফুট জায়গায় রাখা মাছের ডালার ওপর এত আলো কেন?

জানতে চাইলে এক বিক্রেতার উত্তর, একটু পরই সন্ধ্যা হয়ে যাবে, তাই আগেই বাতি জ্বালিয়েছেন। আলো বেশি হলে ক্রেতাদের মাছ দেখতে সুবিধা হয়। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা যায় ভিন্ন কথা। মাছের ওপর বেশি আলো ফেললে দেখতে চকচক করে। এতে নরম ও পচা মাছও টাটকা মনে হয় ক্রেতার কাছে। দাম ভালো পান বিক্রেতারা। ক্রেতারা সাধারণত চোখের দেখায়ই মাছ কিনে থাকে, ধরে দেখে কম। তাই আলোর ঝলকানিটা বেশি দেওয়া হয়।

শুধু এই বাজারে নয়, দেশের প্রায় প্রতিটি মাছের বাজারে একই অবস্থা। এতে যে প্রতিদিন বহু ক্রেতা ঠকছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। প্রতিটি মাছের বাজারেই থাকে প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি বাতি। প্রতিটি মাছের ডালার ওপর চার থেকে পাঁচটি উজ্জ্বল আলোর বাল্ব লাগানো হয়। এতে প্রতারিত হচ্ছে ক্রেতারা। প্রতারণার শিকার একজন সরকারি একটি ব্যাংকের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আলমগীর। রাজধানীর মুগদা এলাকার এই বাসিন্দা বলছিলেন, ‘বাজার থেকে দেখে আনলাম তাজা মাছ, বাসায় এনে ধরে দেখি এগুলো একেবারেই নরম। কয়েকটি পচাও রয়েছে।’

পদ্মা ও মেঘনা নদীর ইলিশ মাছ হয় একটু বেশি উজ্জ্বল। বেশি চকচকে হয়, রুপালি রংটাও হয় বেশি। সাগরের ইলিশ তুলনামূলক কম উজ্জ্বল।

অতিরিক্ত আলো কাজে লাগে এ ক্ষেত্রেও। আলোর ঝলকে ক্রেতার কাছে সব মাছই মনে হয় উজ্জ্বল ও বেশি রুপালি। নদীর ইলিশের দাম বেশি। তাই অধিক আলোর মুনাফা যায় মাছ বিক্রেতার পকেটে।

তবে বিষয়টি মানতে নারাজ বিক্রেতারা। জানতে চাইলে রাজধানীর ঢালি বাজারের মাছ বিক্রেতা নজরুল ইসলাম বলেন, বাতি বেশি দেওয়া হয় ক্রেতার সুবিধার জন্যই। ক্রেতা ভালোভাবে দেখে মাছ কিনতে পারে আর মাছের বাজার সাধারণত একটু ভেতরের দিকে থাকে, তাই বাতিও বেশি লাগে।

অতিরিক্ত বাল্ব লাগানোর খরচও অতিরিক্ত। মাস শেষে বিদ্যুৎ বিলও দিতে হয় কয়েক গুণ বেশি। সেই খরচ শেষ পর্যন্ত মাছের দাম বাড়িয়ে ক্রেতার ঘাড়েই চাপিয়ে দেন বিক্রেতা। বিভিন্ন বাজার ঘুরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সবচেয়ে ছোট দোকানদারকেও প্রতি মাসে বিদ্যুৎ বিল দিতে হয় হাজার টাকার ওপরে।

জানতে চাইলে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, সব ব্যবসায়ীই চান অধিক মুনাফা করতে। এটাই এখনকার স্বাভাবিক চিত্র। অধিক আলোর প্রতারণা এই কারণেই। এটি অনৈতিক কাজ। এ ক্ষেত্রে ক্রেতার সতর্কতাই বেশি দরকার।

আলোর ঝলকানির সঙ্গে মাছের বাজারে জেলির প্রতারণাও রয়েছে। এই পদ্ধতি অবশ্য বেশ পুরনো। মাছের ওজন বাড়াতে এবং শক্তপোক্ত দেখাতে মাছে সিরিঞ্জ দিয়ে জেলি ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। মাছের বাজারে বিভিন্ন অভিযানের চিত্রে দেখা যায়, আড়তেই এই অপকর্মটি বেশি করা হয়।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মামুনুর রশিদের নেতৃত্বে ঢাকা মহানগরীর বাজারগুলোতে মৎস্য অধিদপ্তরের তিনটি দল নিয়মিত তদারকি করে। জানতে চাইলে মামুনুর রশিদ বলেন, ‘মাছে এখন ফরমালিন দেন না ব্যবসায়ীরা। মাছের আইসিং (বরফীকরণ) ও পরিবহনব্যবস্থা উন্নত হওয়ায় এমনিতেই মাছ ভালো থাকে। তবে জেলি মেশানো হয়। বাজার থেকে প্রায়ই আমরা জেলি মেশানো চিংড়ি পাচ্ছি।’ তাঁর দেওয়া তথ্য মতে, গত ৪ সেপ্টেম্বর যাত্রাবাড়ীর আড়তে অভিযান চালিয়ে ৬৫ কেজি জেলি মেশানো বাগদা ও গলদা চিংড়ি আটক করা হয়। তবে এগুলোর মালিক খুঁজে পাওয়া যায়নি। তিনি বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে আমরাও চিন্তিত। বড় ধরনের অভিযান প্রয়োজন। আমরা শিগগিরই র‌্যাবকে নিয়ে নামব।’

বছর তিনেক আগে বগুড়ায় গলদা চিংড়ি খেয়ে একজন বিচারকসহ কয়েকজন ক্রেতা অসুস্থ হয়ে পড়ার খবর পাওয়া যায়। এরপর শহরের মাছের বড় আড়ত চেলোপাড়া চাষিবাজার ও ফতেহ আলী খুচরা বাজারে একজন নির্বাহী হাকিমের নেতৃত্বে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়। ওই সময় মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর রাসায়নিক জেলি মেশানো প্রায় ৬০ কেজি গলদা চিংড়ি জব্দ করা হয়েছিল।

বগুড়ার ঘটনার পর পর জেলি মেশানো প্রায় এক টন গলদা চিংড়ি পাওয়া যায় রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর দুই মৎস্য আড়তে। র‌্যাব-১০-এর ভ্রাম্যমাণ আদালত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের শাস্তিও দেন।

অভিযোগ পাওয়া যায়, শুধু চিংড়ি নয়, জেলি দেওয়া হয় পুঁটি, বোয়ালসহ বেশ কিছু মাছে। এতে মাছ ভারী ও পিচ্ছিল হয় এবং টাটকা মনে হয়।

ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া বছর চারেক আগের এক ভিডিওতে দেখা যায়, এক গৃহিণী মাছের ফেরিওয়ালাকে জেলি মেশানো চিংড়ি মাছসহ হাতেনাতে ধরেছেন। ওই গৃহিণী এক কেজি চিংড়ি থেকে তাত্ক্ষণিক আড়াই শ গ্রাম জেলি বের করে বিক্রেতাকে দেখান। পচে যাওয়া মাছগুলোকে শক্ত ও তাজা দেখাতেই মূলত জেলি ঢোকানো হয়েছিল।

ক্যাব সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, মাছের মধ্যে জেলির মতো ক্ষতিকর পদার্থ দেওয়া বড় একটি অপরাধ। মাছের দাম বেশি রাখলে কিংবা পচা মাছ বিক্রি করলে ভোক্তা হয়তো আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, কিন্তু ক্ষতিকর পদার্থ মানুষের জীবনের ক্ষতি করে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা ভোক্তার স্বার্থ রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষকে এসব বিষয়ে কঠোর নজরদারি রাখতে হবে।

চিকিৎসকরা বলছেন, মাছে ব্যবহৃত এই রাসায়নিক জেলি জীবননাশী ও মারাত্মক ক্ষতিকর। এগুলো মানুষের খাদ্যনালি, পরিপাকতন্ত্র এমনকি কিডনিও নষ্ট করতে পারে। এসব বিষাক্ত রাসায়নিক খেয়ে মানুষ ক্যান্সারেও আক্রান্ত হতে পারে।

জানতে চাইলে মৎস্য অধিদপ্তরের উপপরিচালক (ঢাকা) সৈয়দ আলমগীর বলেন, মাছে জেলি মেশানো হয়ে থাকে মূলত ওজনে প্রতারণা করার উদ্দেশ্যে। এক কেজি মাছে ২০০ গ্রাম পর্যন্ত জেলি পাওয়া যায়। তিনি বলেন, ‘এগুলো নির্মূলে উৎসস্থল ধ্বংস করতে হবে। তবে এত দিন করোনার কারণে সমন্বিতভাবে কাজ করা যায়নি। এখন আবার সমন্বয়ের চেষ্টা চলছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সব পক্ষের সমন্বয়ে শিগগিরই এসব বিষয় নিয়ন্ত্রণে মাঠে নামব আমরা। জেলির উৎসস্থল প্রতিরোধে র‌্যাব ও মৎস্য অধিদপ্তরের খুলনা অফিসকে অনুরোধ করা হয়েছে।’

ফরমালিন ও ক্ষতিকর জেলি মেশানোর শাস্তি সম্পর্কে জানতে চাইলে র‌্যাবের নির্বাহী হাকিম সরওয়ার আলম বলেন, অপরাধের ধরন অনুসারে শাস্তি হয়। তবে সর্বোচ্চ শাস্তি পাঁচ বছরের কারাদণ্ড অথবা ২০ লাখ টাকা জরিমানা। এখন পর্যন্ত এ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ শাস্তি হয়নি। এক বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হওয়ার নজির রয়েছে বলে তিনি জানান।

সরওয়ার আলম বলেন, ‘গত দুই সপ্তাহে কারওয়ান বাজার ও যাত্রাবাড়ী আড়তে অভিযান চালিয়ে জেলি মেশানো চিংড়ি পেয়েছি আমরা। জেলি নিয়ন্ত্রণে আরো বেশি করে অভিযান চালানো হবে।’ ঢাকায় যারা জেলি মেশায় তারা পুরান ঢাকার মৌলভীবাজর থেকে এসব কিনছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা তাঁর। বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান চলছে বলে জানান তিনি।

মৎস্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, নিরাপদ খাদ্য অধিদপ্তর ও মৎস্য অধিদপ্তর—সব পক্ষই মাছের বাজারে এসব প্রতারণা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে রয়েছে। ভোক্তা যদি প্রতারিত হয় তবে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে অভিযোগ করার সুযোগ রয়েছে। তাদের অভিযোগকেন্দ্র রয়েছে। মৎস্য অধিদপ্তরেরও অভিযোগ বাক্স রয়েছে। ব্যক্তিগতভাবেও তাদের কাছে অভিযোগ জানানো যায়।সূত্র:কালের কণ্ঠ

সোনালীনিউজ/এইচএন

Wordbridge School
Link copied!