• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

জোটের কারণে প্রার্থী মনোনয়নে ঝামেলায় আ.লীগ


বিশেষ প্রতিনিধি নভেম্বর ২১, ২০১৮, ১০:৫৪ পিএম
জোটের কারণে প্রার্থী মনোনয়নে ঝামেলায় আ.লীগ

ঢাকা : আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বেশ কিছু আসনে প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে ঝামেলায় পড়েছে আওয়ামী লীগ। কারণ সেসব আসনে দলের শক্তিশালী প্রার্থীর পাশাপাশি জোটের শরিক দলেরও প্রভাবশালী নেতা রয়েছেন। ফলে এসব আসনে প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়েছে ক্ষমতাসীন দলটি। সংশ্লিষ্ট নির্ভরযোগ্য সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

সূত্রমতে, আগামী ৩০ ডিসেম্বরের ভোটকে সামনে রেখে ক্ষমতাসীন দল প্রার্থিতা প্রায় চূড়ান্ত করে ফেলেছে। যদিও এখনো দেওয়া হয়নি আনুষ্ঠানিক ঘোষণা। আর প্রাথমিকভাবে দলটি ৩০০ আসনেই প্রার্থী প্রায় চূড়ান্ত করেছে, যদিও এর মধ্যে ৬৫ থেকে ৭০টি আসনে তাদের প্রার্থী থাকবে না। কারণ, সেগুলো ছেড়ে দিতে হবে শরিক দলগুলোকে।

২০০৮ সালের মতোই মহাজোট করে এবার নির্বাচনে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ। বরং ওই বছরের তুলনায় এবার জোটের আকার হচ্ছে আরও বড়। সাবেক রাষ্ট্রপতি একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর যুক্তফ্রন্ট, বিএনপির সাবেক নেতা ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার তৃণমূল আওয়ামী লীগ, বিএনপির সাবেক শরিক ইসলামী ঐক্যজোটসহ আরও কিছু ধর্মভিত্তিক দলও যুক্ত হচ্ছে এই জোটে।

নতুন দল যুক্ত হওয়ায় আসনের দাবিদার যেমন বেড়েছে, তেমনি দলের নেতারাও যারা নির্দিষ্ট কিছু আসনে কয়েক বছর ধরে তৎপর, সেগুলো ছেড়ে দিতে রাজি হচ্ছেন না। ফলে এসব আসন নিয়ে বারবার আলোচনায় বসতে হচ্ছে।

ঢাকা-১৮ আসনে গত দুবারের সংসদ সদস্য সাহারা খাতুন এবারও ভোটের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তবে জাতীয় পার্টি আসনটি চাইছে দলের কো-চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের জন্য।

ঢাকা-১৭ আসন চেয়েছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। এ আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য মহাজোটের শরিক বিএনএফের আবুল কালাম আজাদ। এখান থেকেই আবার প্রার্থী হতে চান চলচ্চিত্রের মিষ্টি মেয়েখ্যাত সারাহ বেগম কবরী।

লক্ষ্মীপুর-২ আসনে গত নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বীতায় জাতীয় পার্টি থেকে জেতেন মোহাম্মদ নোমান। তিনি এবার মহাজোটের প্রার্থী হতে চান। তবে সেখানে আছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় যুব ও ক্রীড়াবিষয়ক সম্পাদক হারুনুর রশিদ। তিনি ওই আসনের সাবেক সংসদ সদস্যও।

নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনে গত নির্বাচনে জাতীয় পার্টির লিয়াকত হোসেন খোকার বিপরীতে প্রার্থী দেয়নি আওয়ামী লীগ। তবে এবার আসনটি চাইছেন দলের কেন্দ্রীয় উপকমিটির সদস্য এ এইচ এম মাসুদ দুলাল। তিনি গত কয়েক বছর ধরেই এখানে কাজ করছেন। সাবেক সংসদ সদস্য কায়সার হাসনাতও সেখানে দাবিদার।

এরকম যেসব আসনে জোটের শরিকদের ছাড় দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে প্রায় সবখানেই দীর্ঘদিন ধরে মাঠে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী নেতারা। তারা তাকিয়ে দলের শীর্ষ পর্যায়ের সিদ্ধান্তের ওপর।

আবার জোটের শরিকেরাও চাহিদা দিয়েছে আকাশচুম্বী। ১৪ দলের শরিকেরা ১৭৯ আসনের তালিকা দিয়েছে, জাতীয় পার্টি চেয়েছে ৭৬টি। তবে বিষয়টি ‘কামান পেয়ে পিস্তল’ পাওয়ার মতো হবে, এটা জানেন তারাও। মূলত গত নির্বাচনে যেসব আসনে ছাড় পাওয়া গিয়েছিল, সেগুলো পেলেই খুশি তারা।

যদিও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে সর্বোচ্চ ৭০ আসনে ছাড় দেওয়ার কথা প্রচার করতে বলেছেন।

আওয়ামী লীগের নেতারা জানান, ২০১৪ সালে যেসব আসনে অন্যদের ছাড় দেওয়া হয়েছিল, তার সবগুলোতেও ছাড় দেওয়া হবে, এমন নয়।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির ভোটে ঢাকার ২০টি আসনের মধ্যে তিনটিতে জাতীয় পার্টির প্রার্থীকে ছাড় দিয়েছে আওয়ামী লীগ। তবে এর প্রতিটি আসনেই এবার ক্ষমতাসীন দলের নেতারা মনোনয়ন চাইছেন।

ঢাকা-৪ (শ্যামপুর-কদমতলী) আসনে সৈয়দ আবু হোসেন বাবলাকে না দিয়ে নৌকা নিয়ে দাঁড়াতে চান ২০০৮ সালে জয়ী সানজিদা খানম এবং প্রধানমন্ত্রীর সাবেক একান্ত সহকারী সচিব আওলাদ হোসেনসহ কয়েকজন।

ঢাকা-১ (দোহার-নবাবগঞ্জ) আসনে জাতীয় পার্টির সালমা ইসলামের বিপক্ষে তৎপর রয়েছেন আওয়ামী লীগেরই একাধিক প্রভাবশালী নেতা। তাদের মধ্যে আছেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুল মান্নান খান।

গত নির্বাচনে আব্দুল মান্নান খানকে হারিয়ে নির্বাচিত হন সালমা ইসলাম। এবারও তিনি জাতীয় পার্টির প্রার্থী হতে চান। তার ছেলে শামীম ইসলাম নৌকা প্রতীকে প্রার্থী হতে মনোনয়ন ফরম নিয়েছেন ঢাকা-১১ আসন থেকে।

ঢাকা-৮ (রমনা-মতিঝিল-পল্টন) আসনে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননকে ২০০৮ সাল থেকেই ছাড় দিয়ে আসছে আওয়ামী লীগ। এবার সেখানে দৃষ্টি দিয়েছেন আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন, স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মোল্লা মো. আবু কাউছারসহ কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা।

নোয়াখালী-৪ আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক একরামুল করিম চৌধুরী। তিনি সংগঠন ও জনগণের কাছে সমান জনপ্রিয়। এ আসন থেকে মহাজোটের মনোনয়ন দাবি করছেন বিকল্পধারার মহাসচিব আব্দুল মান্নান।

২০০৮ সালের নির্বাচনে মান্নান নোয়াখালীর ওই আসন ছাড়াও ঢাকা-১২ ও লক্ষ্মীপুর-৪ আসন থেকেও ভোট করেন। তবে জিততে পারেননি একটিতেও। নোয়াখালী সদর আসনে আওয়ামী লীগের শক্তিশালী প্রার্থী থাকায় মান্নানকে লক্ষ্মীপুর-৪ দেওয়া যায় কি না, এ নিয়েও চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। তবে সেখানকার বর্তমান সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগের আব্দুল্লাহ আল মামুন। তিনি গত পাঁচ বছরে এলাকায় দৃশ্যমান উন্নয়ন করেছেন। তিনি এবারও জয়ের প্রত্যাশায়। এই আসনে নৌকার মনোনয়ন পান আওয়ামী লীগের কৃষি ও সমবায় সম্পাদক ফরিদুন্নাহার লাইলী।

বিকল্পধারার যুগ্ম মহাসচিব মাহী বি চৌধুরী মুন্সীগঞ্জ-১ আসনে নির্বাচন করতে চান। এখানে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য সুকুমার রঞ্জন ঘোষ। মনোনয়নপ্রত্যাশী হিসেবে আছেন আরও বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা।

সিলেট-৬ আসন থেকে মহাজোটের মনোনয়ন চান বিকল্পধারার নেতা শমসের মবিন চৌধুরী। এ আসনে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য হলেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। এ আসনটি ছাড় দিতে নারাজ আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীরা।

চট্টগ্রাম-৯ আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য জাতীয় পার্টির জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু। এ আসন থেকে আওয়ামী লীগের হয়ে নির্বাচন করতে চান চট্টগ্রামের প্রয়াত মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরীর ছেলে মুহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল।

নড়াইল-১ থেকে জাসদের একাংশের সভাপতি শরীফ নুরুল আম্বিয়া নৌকা প্রতীক চাচ্ছেন। এখানে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য কবিরুল হক মুক্তি।

নড়াইল-২ আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী হিসেবে বাছাই করেছে ক্রিকেটার মাশরাফি বিন মুর্তজাকে। এই আসনটি গতবার ছাড় দেওয়া হয়েছিল ওয়ার্কার্স পার্টিকে। ফলে বর্তমান সংসদ সদস্য শেখ হাফিজুর রহমানের কপাল পুড়ছে।

নেত্রকোনা-৫ আসনে মহাজোটের প্রার্থী হতে চাইছেন জাসদের সহসভাপতি লুৎফা তাহের। এ আসনে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী সংসদ সদস্য ওয়ারেস হোসেন বেলাল। তিনি লুৎফা তাহেরের দেবর।

ময়মনসিংহ-৪ আসনে ধর্মমন্ত্রী নাকি জাতীয় পার্টির রওশন এরশাদকে প্রার্থী করবে মহাজোট- এই প্রশ্ন এখন বড় হয়ে উঠেছে। কারণ, ২০০৮ সালে জয়ী আওয়ামী লীগ আর রওশনকে ছাড় দিতে চাইছে না। আবার রওশনও এই আসন থেকে নিজের শক্তিতে জিতেছেন ১৯৯৬ সালে।

ময়মনসিংহ-৮ আসনে আওয়ামী লীগ বরাবর শক্তিশালী। তবে গত নির্বাচনে আসনটিতে ছাড় দেওয়া হয় জাতীয় পার্টির ফখরুল ইমামকে। তিনি সংসদে এরই মধ্যে পরিচিত হয়ে উঠেছেন জোরালো বক্তব্য রেখে। তাই তার দল আসনটি আবার চাইছে। তবে আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য আবদুস সাত্তার এবার ছাড় দিতে চাইছেন না।

গাজীপুর-৪ আসনে মনোনয়ন চান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোভিসি ও গণতন্ত্রী পার্টির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শহিদুল্লাহ শিকদার। এ আসনের সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগের সিমিন হোসেন রিমি।

জাতীয় পার্টির (জেপি) মহাসচিব শেখ শহীদুল ইসলাম মাদারীপুর-৩ আসন থেকে মনোনয়ন চাইছেন। এখানে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পাচ্ছেন দপ্তর সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপ। এ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য দলের সাংগঠনিক সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম।

সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দীলিপ বড়ুয়া চট্টগ্রাম-১ আসনের মনোনয়ন চাইছেন। এ আসনে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোশাররফ হোসেন বর্তমান সংসদ সদস্য।

সাতক্ষীরা-১ আসনে গত নির্বাচনে নৌকা নিয়ে জেতেন ওয়ার্কার্স পার্টির মুস্তফা লুৎফুল্লাহ। এ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য শেখ মুজিবুর রহমানসহ অর্ধডজন নেতা।

একইভাবে চট্টগ্রাম-৫ আসনে আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, সিলেট-২ আসনে ইয়াহ্ইয়া চৌধুরী, সিলেট-৫ আসনে সেলিম উদ্দিন, রংপুর-১ আসনে মসিউর রহমান রাঙ্গা, কুমিল্লা-২ আসনে আমির হোসেন, কুমিল্লা-৮ আসনে নুরুল ইসলাম মিলন ও বরিশাল-৬ আসনে নাসরিন জাহান রত্না, কিশোরগঞ্জ-৩ আসনে মজিবুল হক চুন্নুর আসনে আওয়ামী লীগের একাধিক প্রভাবশালী নেতা দলের মনোনয়ন চান। খোদ জাতীয় পার্টির শক্তিশালী অবস্থান থাকা রংপুর, গাইবান্ধা, নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রামেও আওয়ামী লীগের একাধিক সংসদ সদস্য জিতে এসেছেন লড়াই করে। কিন্তু সেগুলো জাতীয় পার্টি দাবি করছে।

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা জানান, এবার ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে বিএনপি ভোটে আসায় কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বীতার আভাস পাচ্ছেন তারা। এ কারণে জোটের মধ্যে ঐক্য জরুরি বলে মনে করছেন। তাই প্রার্থী বাছাইয়ে হিসাব-নিকাশ করতে হচ্ছে। তাই আওয়ামী লীগের অনেক নেতার কপাল পুড়তে পারে। আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই তা স্পষ্ট হবে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!