• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

জ্বর সর্দি কাশি রোগীদের স্পর্শ করছেন না ডাক্তাররা


বিশেষ প্রতিনিধি এপ্রিল ২২, ২০২০, ১০:০০ এএম
জ্বর সর্দি কাশি রোগীদের স্পর্শ করছেন না ডাক্তাররা

ঢাকা : করোনা ভাইরাসের প্রভাব পড়েছে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে। ব্যক্তিগত নিরাপত্তার অভাবে চিকিৎসকরা রয়েছেন আতঙ্কে। জ্বর, সর্দি, কাশি ও শ্বাসকষ্টসহ এ ভাইরাসের উপসর্গের সঙ্গে সামান্য মিল পেলেই রোগীদের স্পর্শ পর্যন্ত করছেন না ডাক্তাররা।

অর্থাৎ কোনো কারণে সর্দি, জ্বর, হাঁচি, কাশি, গলাব্যথা থাকলে অন্য কোনো রোগের চিকিৎসা করাতে চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন সাধারণ রোগীরা। এমন পরিস্থিতিতে অনেক রোগী এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ছোটাছুটি করতে করতেই প্রাণ হারাচ্ছেন। চরম বিপাকে পড়েছেন গাইনি, ক্যান্সার, হার্ট ও ডায়াবেটিকের রোগীরা।

এ অবস্থায় দেশের প্রতিটি জেলায় একটি করে হাসপাতাল কোভিড-১৯ রোগীদের জন্য প্রস্তুত রাখার পরামর্শ দিয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, জ্বর, সর্দি, কাশির রোগীরা আগে মারা যেত না। কিন্তু এখন যাচ্ছে। অর্থাৎ বিনা চিকিৎসায় তারা মারা যাচ্ছেন। তাই তাদের চিকিৎসা নিশ্চিত করতে প্রতিটি জেলায় একটি হাসপাতাল প্রস্তুত রাখতে হবে।

যে জেলায় মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল আছে, সেখানে জেলা সদর হাসপাতাল জ্বর, সর্দি, কাশি ও করোনা রোগীদের চিকিৎসার জন্য প্রস্তুত রাখতে হবে। তাহলে বিনা চিকিৎসায় কেউ মারা যাবে না।

যেমন কুমিল্লায় মেডিক্যাল কলেজের পাশাপাশি ২৫০ শয্যার একটি হাসপাতাল আছে। এক্ষেত্রে ২৫০ শয্যার হাসপাতালকে করোনা রোগীদের জন্য প্রস্তুত করা যেতে পারে। বিশেষজ্ঞ কমিটির বৈঠকে এটি একটি উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেন।

বিশিষ্ট কার্ডিওলজিস্ট অধ্যাপক ডা. বরেণ চক্রবর্তী বলেন, হার্টের রোগীদেরও শ্বাসকষ্ট হতে পারে। তার মানে এই নয় যে, সে করোনায় আক্রান্ত। বিশিষ্ট ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. শেখ গোলাম মোস্তফা বলেন, ক্যান্সারের রোগীদেরও তাপমাত্রা বেশি হতে পারে। নিউমোনিয়াও হতে পারে। ফুসফুসের ক্যন্সার রোগীদেরও শ্বাসকষ্ট একটি উপসর্গ। তাই জ্বর, সর্দি কাশি ও শ্বাসকষ্ট হলেই করোনা নয়।

শরিবার ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে সুলতানা (২৬) নামক এক রোগী বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন। করোনা সন্দেহে তাকে আলাদা কর্নারে রাখা হয়েছিল। কিন্তু পরীক্ষায় তার নেগেটিভ রিপোর্ট আসে।

কিন্তু জ্বর, সর্দি কাশির কারণে চিকিৎসকরা তাকে একবার দেখার পরে আর কাছে যাননি। চিকিৎসার অভাবেই সুলতানা মারা যায় বলে তার মা দাবি করেন। এর আগে রাজধানীর কয়েকটি হাসপাতালে তাকে নেওয়া হয়। সেখানেও তাকে চিকিৎসা না দিয়ে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তার বাড়ি নোয়াখালীর সোনাইমুড়ি।

সুলতানার মতো আরো কতো রোগী প্রতিদিন চিকিৎসার অভাবে মারা যাচ্ছেন- তার কোন হিসাব নেই। শুধু তাই নয়, স্বাভাবিক সময়ে যেসব হাসপাতাল ও ক্লিনিক রোগীতে ঠাসা থাকত সেগুলো এখন প্রায় রোগীশূন্য।

করোনা ছাড়া বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে যারা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, চিকিৎসাসেবা না পেয়ে তারাও হাসপাতাল ছাড়ছেন। এমনকি অনেক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বন্ধ রেখেছেন ‘প্রাইভেট চেম্বার’। রাজধানী ও রাজধানীর বাইরের জেলাগুলোয় একই অবস্থা বিরাজ করছে। করোনা আতঙ্কে চিকিত্সকদের একটি বড় অংশ সব ধরনের চিকিত্সা সেবা থেকে নিজেদের বিরত রেখেছেন।

ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জামের (পিপিই) স্বল্পতা এবং সাধারণ রোগীরা যে করোনা আক্রান্ত নন, তা নিশ্চিত না হওয়ার কারণেই মূলত হাসপাতালগুলোতে এমন সংকট সৃষ্টি হয়েছে-এমনটি মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

তাদের মতে, যাদের ন্যূনতম করোনার উপসর্গ রয়েছে, তাদের পরীক্ষা করানো জরুরি। তাহলেই চিকিত্সকরা নিশ্চিন্তে সাধারণ রোগীদের সেবা দিতে পারবেন। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে দেশের হাসপাতালগুলোতে চিকিত্সকদের জন্য পর্যাপ্তসংখ্যক সুরক্ষা সরঞ্জাম দেওয়া হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা আরো বলেন, বর্তমান সময়ে কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়ে যত মানুষের মৃত্যু হয়েছে তার চেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে চিকিত্সা না পেয়ে।

বাংলাদেশ মেডিক্যাল এসোসিয়েশনের মহাসচিব ডা. এহতেশামুল হক দুলাল বলেন, মঙ্গলবার (২১ এপ্রিল) পর্যন্ত ১৬৩ জন চিকিত্সক, ৬০ নার্সসহ ৩৯২ জন চিকিত্সাসেবা কর্মী আক্রান্ত। ব্যক্তিগত সুরক্ষার অভাব এবং সরবারহকৃত নিম্নমানের সুরক্ষাসামগ্রী ব্যবহারের কারণে চিকিত্সক নার্সসহ সেবাকর্মীরা আক্রান্ত হচ্ছেন। চিকিত্সক পরিবারের রোগীরাও পাচ্ছেন না হাসপাতালের চিকিত্সা সেবা।

এদিকে দেশে করোনা ভাইরাসের কমিউনিটি ট্রান্সমিশন এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে উদ্ভূত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় গঠিত ‘জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটি’র বৈঠক সোমবার বিকালে অনুষ্ঠিত হয়েছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রোভিসি, বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের নবজাতক বিভাগের চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সহিদুল্লা’র সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, টেকনিক্যাল কমিটির চার দফা সুপারিশ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।

এর আগে বৈঠকে বিশেষজ্ঞরা পর্য়ালোচনায় বলেন, রাজধানীর মিটফোর্ড হাপসাতালকে ১৪ দিন বন্ধ রেখে জীবানুমুক্ত করতে হবে। এ হাসপাতালের জরুরি সেবাগুলো এই সময়ে মহানগর হাসপাতালে স্থানান্তর করা যেতে পারে।

সুপারিশগুলো হলো-

১. মেডিসিন, পালমোলজিস্ট ও এনেসথেসিয়োলজিস্টসহ প্রয়োজনীয় সংখক বিশেষজ্ঞ চিকিত্সক দিয়ে চিকিত্সা সেবা কমিটির সুপারিশ গঠন করতে হবে।

২. মাইক্রোবায়োলজিস্ট ও বায়োলজিস্টদের দিয়ে রোগ নির্ণয়ের জন্য কমিটি গঠন।

৩. ডাক্তারদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে ও তাদের উত্সাহ দেওয়ার কমিটি গঠন ও

৪, রোগের সম্প্রসারণ, বর্তমান অবস্থা ও কিভাবে ছড়াছে, করোনা রোগীর গতিবিধি সম্পর্কে সরকারকে পরামর্শ দেওয়ার জন্য কমিটি গঠনের সুপারিশ করা হয়।

এদিকে ‘জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটি’র সদস্যসচিব হিসেবে কাজ করছেন সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা। তিনি বর্তমানে কোয়ারেন্টাইনে আছেন।

কমিটির প্রথম বৈঠকে তাকে সরিয়ে মন্ত্রণালয় বা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাউকে সদস্য সচিব করার জোর দাবি জানানো হয়। বৈঠকে বিশ্বব্যাপী করোনার প্রাদুর্ভাব এবং বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়।

চীনে প্রথম করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হওয়ার পর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সারাবিশ্বকে সতর্ক করে দিয়েছিল। গত ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। বাংলাদেশ অনেক সময় পেলেও সুষ্ঠু পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় চিকিত্সা সেবা নিয়ে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। টেকনিক্যাল কমিটিতে ভাইরোলজিস্ট ও মাইক্রোবায়োলজিস্ট সঙ্গে রাখার জন্য সুপারিশ করা হয়।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা বলেন, স্বাস্থ্য সেবায় সমন্বয়ের বড় ঘাটতি রয়েছে। স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারাই এখন স্নায়ুরোগে ভুগছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরেও সমন্বয়ের অভাব রয়েছে বলে একজন কর্মকতা স্বীকার করেন।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!