• ঢাকা
  • বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

‘জয় বাংলা’ মুক্তির স্লোগান হোক জাতীয় স্লোগান


এস এম মুকুল মার্চ ২৭, ২০১৯, ০৮:২২ পিএম
‘জয় বাংলা’  মুক্তির স্লোগান হোক জাতীয় স্লোগান

ঢাকা : জয় বাংলা আমাদের মুক্তি ও চেতনার স্লোগান। একটি জাতির মুক্তির প্রেরণার শক্তি। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে এই স্লোগান শুনলে পাকিস্তানিদের গাত্রদাহ হতো। আরো যাদের গাত্রদাহ হতো- তারা ছিল এদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তি। এর প্রতিশোধ হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের বন্দি করে তাদের ওপর আমৃত্যু পাশবিক অত্যাচার চালিয়ে জিন্দাবাদ বলানোর প্রচেষ্টা করা হতো। কিন্তু ‘জয় বাংলা’ ছিল এক উজ্জীবনী শক্তির নাম। শত অত্যাচারেও দেশপ্রেমিক জনগণ ও মুক্তিযোদ্ধারা নির্মম মৃত্যুকে বরণ করে নিয়েছেন ‘জয় বাংলা-জয় বাংলা’ জপে জপে।

বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট থেকে জানা যায়, স্বাধীনতার মহান স্থপতি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির স্বাধীনতার জন্য অকুণ্ঠ চিত্তে বলেছিলেন— ‘প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায়, সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোল এবং তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাক। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব— এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ।’ দীর্ঘ ভাষণের সমাপ্তি টেনেছেন ‘জয় বাংলা’ বলে।

বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে সেই ‘জয় বাংলা’ তখন থেকেই মুক্তিকামী স্লোগান হয়ে গেল। মানুষের মুখে মুখে মুখরিত হতো এই ‘জয় বাংলা’ স্লোগান। যদিও ‘জয় বাংলা’ মূলত আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার স্লোগান। স্বাধীনতার এক দাবিতে ক্রমান্বয়ে এই স্লোগানটিই হয়ে ওঠে বাংলার এবং বাঙালির মুক্তির স্লোগান। তবে ‘জয় বাংলা’ ছিল আমাদের ধ্যানধারণা। অপরাপর বিশ্লেষণ থেকে জানা যায়, ‘জয় বাংলা’ কেবল একটি স্লোগান হিসেবে নয় একটি আদর্শের দৃপ্ত উচ্চারণ ছিল। এই ‘জয় বাংলা’ সাধারণ একটি স্লোগানকে হূদয়ে ধারণ করে স্বাধীনতাকামী বাঙালিরা কাঁপিয়ে দিয়েছিল পাকিস্তানকে। আবার ‘জয় বাংলা’ শব্দটি যখন কবি নজরুল ব্যবহার করেন তিনিও ভাবেননি, এক দিন এই শব্দটি একটি জাতিকে নতুন জীবনের পথ দেখাবে।

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, সত্তরের নির্বাচনে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের পক্ষ থেকে ছাপানো এক প্রচারপত্রের শেষে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান নিয়ে একটি বাণী লেখা ছিল— ‘শত প্রতিবন্ধকতা, লোভ-লালসা, আত্মকলহ, দ্বিধা-দ্বন্দ্ব দূর করে এগিয়ে যেতে হবে। মনে রাখতে হবে, ‘জয় বাংলা’ আমাদের ধ্যান ধারণা, ‘জয় বাংলা’ কেবল একটি  স্লোগান নয়, ‘জয় বাংলা’ একটি আদর্শ। ‘জয় বাংলা’ আমাদের মূল উৎস। ‘জয় বাংলা’ আমাদের চলার শেষ প্রান্ত। জয় বাংলা।’

অপর তথ্যে জানা যায়, জয় বাংলা শব্দটি সর্বপ্রথম ১৯৬৯ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মধুর ক্যান্টিনে সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের এক সভায় ছাত্র আফতাব আহম্মেদ ও চিশতী হেলালুর রহমান ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি উচ্চারণ করেন। তবে ১৯৭০ সালের ১৯ জানুয়ারি ঢাকা পল্টনের এক জনসভায় ছাত্রনেতা সিরাজুল আলম খান তার ভাষণে সর্বপ্রথম জয় বাংলা স্লোগানটি উচ্চারণ করেছিলেন বলে প্রচলিত আছে।

আবার তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই স্লোগানটি প্রথম ব্যবহার করেছিলেন ১৯৭০ সালের ৭ জুন ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানের বিশাল জনসভায়। পরবর্তী সময়ে ১৯৭১ সালের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের শেষে জয় বাংলা বলেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তবে বলতে দ্বিধা নেই, জয় বাংলা স্লোগানটি সাধারণ মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে বঙ্গবন্ধুর মুখে উচ্চারণের পর থেকেই। এ কারণে বঙ্গবন্ধু ও জয় বাংলা শব্দ দুটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণে উজ্জীবিত হয়ে জয় বাংলা স্লোগানের চেতনায় ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে বাঙালি জাতি হিসেবে যুদ্ধে নেমেছিল। বাঙালি মুক্তি সেনারা তখন গর্ব করে বলত, আমরা জয় বাংলার লোক।

জয় বাংলা ছিল বাঙালিকে জাগিয়ে তোলার স্লোগান। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে একতার প্ল্যাটফরম। তথ্য বিশ্লেষণে জানা গেছে, ১৯৬৯ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর শিক্ষা দিবস পালন উপলক্ষে সেপ্টেম্বরের ১৫ তারিখ থেকেই তিন দিনব্যাপী কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়।

১৫ তারিখ সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে সাধারণ ছাত্রসভা চলাকালীন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আফতাব উদ্দিন আহমদ ‘জয় বাংলা’ বলে স্লোগান দিলে ইকবাল হলের আরেক শিক্ষার্থী চিশতি শাহ হেলালুর রহমানও চিৎকার দিয়ে ওঠেন ‘জয় বাংলা’ বলে। মধুর ক্যান্টিনের এই ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি পাকিস্তানের ভিত্তিমূল ভেঙে দেওয়ার পথ রচনা করবে সেটা তখন কেউই হয়তো আন্দাজ করতে পারেনি। ১৫ সেপ্টেম্বরের সেই জয় বাংলা ধীরে ধীরে ছাত্রনেতাদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

১৯৭০ সালের ১১ জানুয়ারি পল্টন ময়দানে আওয়ামী লীগের এক জনসভায় মঞ্চের সামনে টাঙিয়ে দেওয়া হয় জয় বাংলা লেখা ব্যানার। শিল্পী কামাল আহমেদের ডিজাইন করা সেই ব্যানার থেকেই সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে এই জয় বাংলার চেতনায় বাঙালির মুক্তির অগ্নস্ফুিলিঙ্গ। সেদিন প্রধান বক্তা হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানও উপস্থিত ছিলেন সেই মঞ্চে। সেখানে দাঁড়িয়েই তৎকালীন জনপ্রিয় ছাত্রনেতা সিরাজুল আলম খানও এই স্লোগান দিয়েছিলেন। তবে তখন পর্যন্ত ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি ছাত্রনেতাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।

এরপর ১৯৭০ সালের ৬ মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রচার প্রচারণায় এই স্লোগান ব্যাপকভাবে ব্যবহূত হতে থাকে। ব্যানারে ফেস্টুনে জয় বাংলা স্লোগান ছাত্রদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনকে সামনে রেখে পূর্ব পাকিস্তানে জোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের কাউন্সিল উপলক্ষে ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে পল্টনে র‍্যালির কুচকাওয়াজে অংশ নেওয়ার জন্য গঠন করা হয় ‘জয় বাংলা বাহিনী’।

আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বে সেই কুচকাওয়াজে অংশগ্রহণকারীদের টুপিতে সেফটিফিন দিয়ে আটকনো হয় এই জয় বাংলা লেখা স্লোগান। ৭ জুন ঢাকার রেসকোর্স মাঠে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল পরবর্তী জনসভার ভাষণেই প্রথমবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মঞ্চ থেকে এই স্লোগানটি উচ্চারণ করেন। তারপর থেকেই এই স্লোগান অগ্নি স্লোগানে রূপ নেয়।

চার জানুয়ারি ১৯৭১ ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সভার শুরুতেই স্লোগান উঠে ‘বীর বাঙ্গালী অস্ত্র ধরো/বাংলাদেশ স্বাধীন করো, লাল সূর্য উঠেছে/বীর জনতা জেগেছে।’ ছাত্রজনতার স্লোগানগুলো মন দিয়ে শুনে প্রধান অতিথি শেখ মুজিব বক্তৃতায় দাঁড়ালেন। বক্তৃতা শেষ করলেন শুধু ‘জয় বাংলা’ দিয়ে। ৩ মার্চ পল্টনে ছাত্র পরিষদের সভার জন্য স্বাধীন বাংলাদেশের ঘোষণা এবং কর্মসূচি আকারে একটি ইশতেহার তৈরি করা হয়। এই ইশতেহারের শিরোনাম দেওয়া হয় ‘জয় বাংলা-ইশতেহার নং এক’।

মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে ২ মার্চ উত্তোলন করা হয় স্বাধীন বাংলার পতাকা। তখন জয় বাংলা ধ্বনিতে উদ্বেলিত হয় উপস্থিত ছাত্রজনতা। এই জয় বাংলার মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে সমগ্র বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধভাবে ৯ মাসের বীরত্বপূর্ণ সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের আত্মাহুতি ও ২ লাখ মা বোনের সম্ভ্রমহানির বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাক হানাদার বাহিনীকে পরাস্ত করে বিজয় ছিনিয়ে আনে। কারণ জয় বাংলার অবস্থান ছিল মুক্তিকামী বাঙালিদের হূদয়ের মণিকোঠায়। তাই জয় বাংলা কোনো দলীয় স্লোগান নয়।

জয় বাংলা হোক আমাদের জাতীয় স্লোগান। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রতিটি দেশপ্রেমিক নাগরিকের দায়িত্ব জয় বাংলা স্লোগানকে ধারণ করে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। এটাই হবে লক্ষ শহীদদের প্রতি প্রকৃৃত ভালোবাসা ও সম্মান জানানোর সর্বোত্তম পন্থা।

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!