• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

ডানা মেলছে মেট্রোরেল


নিজস্ব প্রতিবেদক এপ্রিল ২৫, ২০১৯, ০২:৩৩ পিএম
ডানা মেলছে মেট্রোরেল

ঢাকা: রাজধানীর প্রায় ২২ কিলোমিটার সড়কে এখন প্রকল্পের কাজ দৃশ্যমান। চলতি বছরের শেষেই দেখা যাবে রাজধানী ঢাকা শহরে ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটার গতিসম্পন্ন সবচেয়ে দ্রুতগতির ট্রেন চলাচল।

যানজট নিরসনে আশাজাগনিয়া মেট্রোরেলের দ্বিতীয় অংশের কাজও চলছে সমানতালে। চূড়ান্তও হয়েছে প্রকল্পের কোচের ডিজাইন। সে মোতাবেক জাপানের কোম্পানির কারখানায় লোকোমোটিভের রেপ্লিকা তৈরি হয়েছে। চলতি বছরের মধ্যে প্রকল্পের উত্তরা থেকে আগারগাঁও অংশ ও আগামী বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে পুরো কাজ শেষ হওয়ার কথা। কাজ শেষ হলে ঘণ্টায় ৬০ হাজার যাত্রী পরিবহন সম্ভব হবে বিদ্যুৎচালিত এই ট্রেনে।

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় দেখা গেছে, মেট্রোরেলের কাজের কারণে যানজট বেড়েছে। সরু হয়েছে বিভিন্ন এলাকার সড়ক। শতাধিক বাসের চলার পথ পরিবর্তন করা হয়েছে। আগামীতে আরো কিছু রুটে বাস চলাচলে পরিবর্তন আনা হবে বলে জানা গেছে।

জানা গেছে, নির্মাণকাজের কারণে কিছুটা জনদুর্ভোগ হলেও তা সাময়িক। প্রকল্পের কাজ যত দ্রুত শেষ হবে ততই দুর্ভোগ কমে আসবে। সরকার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে যেসব বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে চায়, সেগুলোকে ‘ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্প’ হিসেবে ঘোষণা করা করেছে। এই প্রকল্পের অন্যতম হলো মেট্রোরেল। এজন্য ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা। প্রকল্প শুরুর পর আর্থিক সঙ্কট দেখা দেওয়ায় তা বাস্তবায়ন নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছিল। তা ছাড়া হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার ঘটনার পর প্রকল্পে নিয়োজিত বিদেশি প্রকৌশলীরা ভয়ে নিজ দেশে ফিরে গিয়েছিলেন। এতে কাজের গতি কিছুটা মন্থর হয়। ছয় মাস পর পুরোদমে কাজ শুরুর পাশাপাশি অর্থনৈতিক অচলাবস্থার সমাধান হয়।

ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের পরিচালনা পরিষদের ১১তম সভায় সম্প্রতি ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের (এমআরটি-৬) বাস্তবায়ন অগ্রগতি তুলে ধরা হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছরের আগস্ট মাস পর্যন্ত এই প্রকল্পের সার্বিক বাস্তব অগ্রগতি সাড়ে ১৬ শতাংশ। আর প্রকল্পের সার্বিক আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে ২৩ দশমিক ২২ শতাংশ। ১২০ মিটার উড়ালপথ (ভায়াডাক্ট) দৃশ্যমান হয়েছে। সংশোধিত পরিকল্পনা অনুযায়ী মেট্রোরেলের নির্মাণকাজ পুরোদমে এগিয়ে চলছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়। ২০১২ সালে এমআরটি-৬ বা মেট্রোরেল প্রকল্প নেওয়া হয়। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় বিশেষ উদ্যোগে সংশোধিত পরিকল্পনা নেওয়া হয়। উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত উড়ালপথ ও স্টেশন নির্মাণের কাজ শেষ করার কথা রয়েছে ২০১৯ সালের জুনে। চালু হওয়ার কথা এ বছরের ডিসেম্বরে। সব মিলিয়ে ২০২১ সালে কাজ শেষ হওয়ার কথা প্রকল্পে উল্লেখ রয়েছে।

প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, মেট্রোরেল প্রকল্পের কাজ আটটি প্যাকেজে ভাগ করা হয়েছে। প্রথম প্যাকেজের আওতায় ডিপো এলাকার ভূমি উন্নয়নের কাজ সবার আগে শুরু হয়। এই প্যাকেজের কাজ গত ৩১ জানুয়ারি শতভাগ শেষ হয়েছে। আর বিরতিতে ট্রেন রাখার স্থান, ট্রেন মেরামত ও মালামালের গুদাম, প্রধান ওয়ার্কশপসহ নানা অবকাঠামো নির্মাণকাজের বাস্তব অগ্রগতি ১৭ শতাংশ।

উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ১১ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার উড়ালপথ ও ৯টি স্টেশন নির্মাণ করা হচ্ছে প্যাকেজ ৩ ও ৪-এর আওতায়। পরে এই উড়ালপথের ওপরই ট্রেনের জন্য লাইন বসানো হবে। এই প্যাকেজের কাজ জুনের মধ্যে শেষ করতে হবে। গত আগস্ট পর্যন্ত এই প্যাকেজের অগ্রগতি ১৯ দশমিক ৪৬ শতাংশ।

প্রতি চার মিনিট পর এক হাজার ৮০০ যাত্রী : মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ বলছে, প্রকল্প চালু হলে প্রতি ৪ মিনিট পরপর ১ হাজার ৮০০ যাত্রী নিয়ে চলবে মেট্রোরেল। ঘণ্টায় চলাচল করবে প্রায় ৬০ হাজার যাত্রী। প্রায় ২০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে সময় লাগবে ৪০ মিনিটের কম। মেট্রোরেল প্রকল্পে বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা বসানোর কাজে বাস্তব অগ্রগতি ১ শতাংশ। ইতোমধ্যে প্রথম মেট্রোরেলের সামনের ও পেছনের নকশা এবং বাইরের রঙ চূড়ান্ত করা হয়েছে। এতে লাল-সবুজের প্রাধান্য রয়েছে।

এ বিষয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র তথ্য কর্মকর্তা আবু নাছের টিপু বলেন, ইতোমধ্যে মেট্রোরেলের লোকোমোটিভের ডিজাইন চূড়ান্ত করেছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। ওই ডিজাইনের ভিত্তিতে জাপানের সংশ্লিষ্ট কোম্পানির কারখানায় লোকোমোটিভের রেপ্লিকা তৈরি করা হয়েছে। রেপ্লিকার ছবিও আমরা পেয়েছি। শিগগিরই একটি প্রতিনিধিদল তা দেখতে যাবেন। এবং মেট্রোরেলের লোকোমোটিভে যেসব সুযোগ-সুবিধা থাকার কথা রয়েছে সেগুলো ঠিক থাকলে চূড়ান্ত লোকোমোটিভ তৈরির জন্য বলা হবে।

গত বছরের এপ্রিলে প্রথম স্প্যান : গত বছরের এপ্রিলে মেট্রোরেলের প্রথম স্প্যান বসে। রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়িতে দুটি পিলারকে যুক্ত করে এই স্প্যানটি বসানো হয়েছে।

জানা গেছে, উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মোট ২০ দশমিক এক কিলোমিটার দীর্ঘ এই রেলপথে ৭৭০টি স্প্যান বসবে।

প্রকল্পের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রায় ৫৯ একর জায়গার ওপর নির্মিত হচ্ছে মেট্রোরেলের মূল ডিপো। যেখান থেকে ৪ মিনিট ১৯ সেকেন্ড পর পর ছেড়ে যাবে ৬ জোড়া বগি নিয়ে বিদ্যুৎচালিত অত্যাধুনিক ট্রেন। নির্ধারিত সময়ের আগেই ডিপোর কাজ শেষ হবে।

এ বিষয়ে প্রকল্পের ব্যবস্থাপক বলেন, পুরো প্রকল্পের কাজ শেষ হলে প্রতি ঘণ্টায় ৬০ হাজার যাত্রী উভয় দিক থেকে আসা-যাওয়া করবে মেট্রোরেলে। জাপানের গাড়ি প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান কাওয়াসাকি-মিতসুবিশি থেকে কোচ আমদানি করা হবে। বিদ্যুৎচালিত এই ট্রেনে সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎসুবিধা নিশ্চিত করতে দুটি প্লান্টও নির্মাণ করা হচ্ছে। উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ৩৭৭টি পিয়ারের ওপর ৩৭৬টি স্প্যান বসে বিস্তৃত হবে মেট্রোরেল প্রকল্প।

আগারগাঁও থেকে সার্ক ফোয়ারা পর্যন্ত ৩ দশমিক ১৯ কিলোমিটার রুটে তিনটি স্টেশন থাকবে। এই অংশে থাকবে ১০০টি পিয়ার। এসব পিয়ার নির্মাণের জন্য এরই মধ্যে আগারগাঁও থেকে সার্ক ফোয়ারা পর্যন্ত সড়কের অনেক অংশে বিভাজক তুলে ফেলা হয়েছে। বসানো হয়েছে কংক্রিটের বেষ্টনী। এ কারণে আট লেনের সড়ক চার লেন হয়ে গেছে। এই চার লেনের সড়ক দিয়ে প্রায় দুই বছর যান চলাচল করবে।

ট্রাফিক বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, আগারগাঁও-ফার্মগেট থেকে মতিঝিল পর্যন্ত সড়কটি প্রস্থে প্রায় ২২ মিটার। এর মধ্যে সড়কের দুই পাশের মধ্যবর্তী ১১ মিটার অংশে মেট্রোরেল প্রকল্পের কাজ চলবে। তাই একপাশের মাত্র সাড়ে পাঁচ মিটারের মধ্যে যানবাহন চলাচল করবে। এই অংশ দিয়ে মাত্র একটি বাস অথবা প্রাইভেটকারের সঙ্গে খুব বড়জোর একটি মোটরসাইকেল পাশাপাশি একসঙ্গে চলতে পারবে। এ কারণে এই সড়কে যানজট হতে পারে। পরিস্থিতির সমাধানে ট্রাফিক বিভাগের পক্ষ থেকে সরকারের উচ্চপর্যায়ে ১৯ দফা প্রস্তাব দেয় হয়েছে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট (এআরআই) হিসেবে, ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত রাজধানীতে ঢাকায় বিআরটিএর নিবন্ধিত যানবাহন রয়েছে ১৩ লাখ ৭ হাজার ৫০০টি। এর মধ্য প্রাইভেটকার রয়েছে ২ লাখ ৭৭ হাজার ১৪১টি।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, আগারগাঁও থেকে শেওড়াপাড়া পর্যন্ত সব পিলার শতভাগ নির্মাণ করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে এসব পিলারের ওপরে বসছে স্প্যান। শেওড়াপাড়ায় ৮টি পিলারের ওপরে বসেছে স্প্যান। এক পিলার থেকে অন্য পিলার পর্যন্ত মোট ১২টি ছোট ছোট স্প্যান স্কাইচ ব্যবহার করা হচ্ছে। মেট্রোরেলের প্রতিটি পিলারের ব্যাস দুই মিটার, ভূগর্ভস্থ অংশের ভিত্তি তিন মিটার। অন্যদিকে মাটি থেকে পিলারের উচ্চতা ১৩ মিটার। একটি স্তম্ভ থেকে আরেকটির দূরত্ব ৩০ থেকে ৪০ মিটার।

এদিকে ফার্মগেট থেকে বাংলামোটর, শাহবাগ, দোয়েল চত্বর, প্রেস ক্লাব, পুরানা পল্টন, দৈনিক বাংলা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত কাজ দশ্যমান। ইতোমধ্যে সড়কের দুই অংশে মেট্রোরেলের জন্য জায়গা নির্ধারণ করে মাটির নিচের কাজ চলছে। খুলে ফেলা হয়েছে প্রেস ক্লাব ও মতিঝিল এলাকার ফুটওভারব্রিজ।

প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা আরো জানান, শেওড়াপাড়া থেকে আগারগাঁও পরিকল্পনা কমিশনের দ্বিতীয় গেট পর্যন্ত পিলার নির্মাণকাজ শেষ। এখন শুধু স্প্যান বসানো হবে। যেখানে পিলার নির্মাণ গ্যাপ রয়েছে সেখানে স্টেশন নির্মাণ পরিকল্পনার জন্যই রাখা হয়েছে। মিরপুর-১০ নম্বর গোল চত্বরের পাশেই নির্মিত হচ্ছে মেট্রোরেল স্টেশন। প্রকল্পের চূড়ান্ত রুট অ্যালাইনমেন্ট হলো- উত্তরা তৃতীয় ধাপ- পল্লবী, রোকেয়া সরণির পশ্চিম পাশ দিয়ে (চন্দ্রিমা উদ্যান-সংসদ ভবন) খামারবাড়ি হয়ে ফার্মগেট-সোনারগাঁও হোটেল-শাহবাগ-টিএসসি-দোয়েল চত্বর-তোপখানা রোড থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যন্ত।

স্টেশন হবে ১৬টি : প্রায় ২২ কিলোমিটার প্রকল্পের মধ্যে ১৬টি স্টেশন হচ্ছে— উত্তরা উত্তর, উত্তরা সেন্টার, উত্তরা দক্ষিণ, পল্লবী, আইএমটি, মিরপুর সেকশন-১০, কাজীপাড়া, তালতলা, আগারগাঁও, বিজয় সরণি, ফার্মগেট, সোনারগাঁও, জাতীয় জাদুঘর, দোয়েল চত্বর, জাতীয় স্টেডিয়াম ও বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত নয়টি স্টেশন নির্মিত হবে।

মেট্রোরেল প্রকল্পের প্রধান প্রকৌশলী (পূর্ত) আব্দুল বাকি মিয়া বলেন, দ্রুতগতিতে প্রকল্পের কাজ এগিয়ে যাচ্ছে। শুধু দিন নয় রাতেও চলছে স্প্যান বসানোর কাজ। উত্তরা দিয়াবাড়ি থেকে আগারগাঁওয়ের দূরত্ব ১১ কিলোমিটার। এর মধ্যে প্রায় দুই কিলোমিটার সড়কজুড়ে স্প্যান বসানো হয়েছে। কয়েক দিনের মধ্যেই আগারগাঁও থেকে পরিকল্পনা কমিশনের দ্বিতীয় গেট পর্যন্ত স্প্যান বসিয়ে ফেলব।

কয়েক স্থানে পিলারের গ্যাপ প্রসঙ্গে প্রকল্পের প্রধান প্রকৌশলী বলেন, এটা আমাদের টেকনিক্যাল কারণে। স্টেশন নির্মাণের স্থানে আগে দুই পাশে যাতায়াত ব্যবস্থা করব তারপরেই সড়কের মিডলে কাজ শুরু হবে। মেট্রোরেল পরিচালনার ঘণ্টায় দরকার হবে ১৩ দশমিক ৪৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। এজন্য উত্তরা, পল্লবী, তালতলা, সোনারগাঁও ও বাংলা একাডেমি এলাকায় পাঁচটি বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র থাকবে। ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটার বেগে ছুটবে এই ট্রেন। প্রকল্পের মোট ব্যয় ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকার মধ্যে সাহায্য হিসেবে জাইকা ঋণ দিচ্ছে ১৬ হাজার ৫৯৪ কোটি ৫৯ লাখ টাকা।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!