• ঢাকা
  • বুধবার, ১৭ এপ্রিল, ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

ডিম নিয়ে ভ্রান্ত ধারণার অবসান হোক


আর এস মাহমুদ হাসান অক্টোবর ১২, ২০২০, ০২:৪৭ পিএম
ডিম নিয়ে ভ্রান্ত ধারণার অবসান হোক

ঢাকা : প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণ, স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ডিমের গুরুত্ব এবং জনসাধারণের মাঝে ডিম সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে ১৯৯৬ সালে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় সর্বপ্রথম ‘বিশ্ব ডিম দিবস’ পালনের আয়োজন করা হয়। যা পরবর্তী সময়ে প্রতি বছর অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় শুক্রবার পালিত হয়ে আসছে।

বাংলাদেশে ২০১৩ সালে প্রথমবারের মতো ‘বিশ্ব ডিম দিবস’ পালন করা হয়। সেটি ছিল ১৮তম বিশ্ব ডিম দিবস। সেই থেকে প্রতি বছর সাধারণের মাঝে ডিম সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে পালিত হচ্ছে বিশ্ব ডিম দিবস। পুরো বিশ্বেই এ দিনটি একসঙ্গে উদযাপিত হয়ে থাকে।

‘প্রতিদিন ডিম খাই, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াই’ প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে এ বছর ২৫তম বিশ্ব ডিম দিবস পালিত হলো। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্যানুযায়ী, বছরে একজন মানুষের ন্যূনতম ১০৪টি ডিম খাওয়া উচিত। তবে আমাদের দেশের মানুষ বছরে ডিম খায় গড়ে মাত্র ৪৫-৫০টি। ডিমের নানাবিধ পুষ্টিগুণ সম্পর্কে সবাই কমবেশি জানে। ডিম খাওয়া বাড়াতে বিশ্ব ডিম দিবস পালিত ও পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার হিসেবে বিশ্বজুড়ে ডিমের ব্যাপক জনপ্রিয়তা থাকা সত্ত্বেও ডিম নিয়ে মানুষের মনে রয়ে গেছে অনেক ভ্রান্ত ধারণা, যা সম্পর্কে সচেতনতা জরুরি।

ডিম খাওয়া ভালো কি ভালো না তা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক বহুদিনের। চীনে প্রায় ৫ লাখ লোকের ওপর এক গবেষণা চালিয়ে বিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রতিদিন একটা করে ডিম খেলে হূদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি কমতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন, ডিম থেকে শারীরিক উপকার পেতে হলে স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপন করতে হবে। তবে একসময় বলা হতো বেশি ডিম খাওয়া শরীরের জন্য ক্ষতিকর, বিজ্ঞানীরা এখন সে মত পাল্টে ফেলেছেন।

অনেকেই মনে করেন, দিনে একটির বেশি ডিম খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলেন, দিনে তিনটি ডিম স্বাস্থ্যের জন্য পুরোপুরি নিরাপদ। ডিম প্রোটিনের একটি আদর্শ উৎস। তাই প্রোটিনের চাহিদা পূরণের জন্য ডিমকে আবশ্যিক মনে করেন পুষ্টি বিশেষজ্ঞরা।

বহুদিন পর্যন্ত ডিম শরীরে কোলেস্টেরল বাড়িয়ে দেয়, ডিমের মধ্যে সালমোনেলা রয়েছে তাই ডিম খাওয়া উচিত নয়— এমন খবর সংবাদমাধ্যমে প্রচার হয়েছে। অথচ ডিমকে ভালোভাবে রান্না করলে সালমোনেলা ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস হয়ে যায়। সব ডিমে যে সালমোনেলা আছে তাও কিন্তু নয়। ডিম পাড়ার পর ডিমটি নোংরা স্থানে পড়ে থাকলে কিংবা ডিমের গায়ে বিষ্ঠা লেগে থাকলে ডিমটি ব্যাকটেরিয়ায় আক্রান্ত হতে পারে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন স্থানে ডিম পাড়ার ব্যবস্থা করলে এবং ডিম ধুয়ে রাখলে ডিমে সালমোনেলা ঢোকার আশঙ্কা থাকে না।

অনেকের মতে, লাল ডিম ও সাদা ডিমের পুষ্টিগুণ ভিন্ন। ডিম লাল হবে নাকি সাদা, তা নির্ভর করে মুরগির পিগমেন্ট উৎপাদন ক্ষমতার ওপর। প্রকৃতপক্ষে সব রঙের ডিমের পুষ্টি উপাদান একই। তা ছাড়া অনেকেই আবার মনে করেন, ডিমের কুসুম যদি হলুদ হয়, তাহলে পুষ্টিমাণ বেশি। আর যদি কুসুমের রং হালকা হলুদ বা সাদাটে হয়, তাহলে তার পুষ্টিগুণ কম। এ ধারণাও একেবারেই অসত্য। কারণ, ডিমের কুসুমের রং যাই হোক না কেন, এর সঙ্গে পুষ্টিগুণের কোনো সম্পর্ক নেই। কারণ, ডিমের কুসুমের রং নির্ভর করে হাঁস-মুরগির খাদ্যের ভেতরে জ্যান্থোফিল নামক এক ধরনের পিগমেন্ট বা রঞ্জক পদাথের উপস্থিতির ওপর।

একইভাবে দেশি মুরগির ডিম ও ফার্মের মুরগির ডিমের মধ্যেও পুষ্টিমানের মৌলিক কোনো তফাত নেই। যে ডিমের আকার বা ওজন যত বড় সে ডিমে প্রোটিন, ফ্যাট, ভিটামিন, খনিজসহ অন্যান্য পুষ্টি উপাদান তত পরিমাণ বিদ্যমান। এ ছাড়া অনেকের ধারণা রান্না করা ডিমের তুলনায় কাঁচা ডিমে বেশি প্রোটিন থাকে। কিন্তু এর কোনো গ্রহণযোগ্য প্রমাণ নেই। বরং কাঁচা ডিম খেলে সালমোনেলা ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে। এর ফলে হঠাৎ বমি, পেটে অসুখ থেকে শুরু করে টাইফয়েড পর্যন্ত হয়ে থাকে।

আবার অনেকে বলেন, ডিম মানুষের রক্তে কোলেস্টেরলের পরিমাণ উচ্চমাত্রায় বৃদ্ধি করে। পুষ্টি বিশেষজ্ঞদের মতে, সব ধরনের কোলেস্টেরল দেহের জন্য সমান ক্ষতিকর নয়। ‘স্যাচুরেটেড ফ্যাট’ নামক খারাপ কোলেস্টেরল দেহের রক্তচাপ বাড়ায় এবং হূদযন্ত্রের ক্ষতি করে। প্রকৃত সত্যটা হচ্ছে ডিমে মাত্র ১.৬ গ্রাম স্যাটুরেটেড ফ্যাট এবং ২০০ মিলিগ্রাম কোলেস্টেরল রয়েছে যা হূদরোগ সৃষ্টির জন্য দায়ী বলে মনে করা হলেও, সাম্প্রতিক কিছু গবেষণায় এর ভিন্ন ফলও পাওয়া গেছে। ডিমের কোলেস্টেরল হূদরোগের ঝুঁকি বাড়ায় কি না এমন প্রশ্নে বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখেন যে ডিমের কোলেস্টেরল মানুষের রক্তে আসে না অথবা এলেও এর পরিমাণ খুবই নগণ্য।

অনেকে মনে করেন ডিম ও দুধ একসঙ্গে খাওয়া ঠিক নয়। ডিম এবং দুধ দুটোই প্রোটিনের আদর্শ উৎস। তবে ডিমের মধ্যে প্রোটিন ছাড়াও আছে অ্যামিনো অ্যাসিড, ভিটামিন ও আয়োডিন।

অপরদিকে দুধে রয়েছে ক্যালসিয়াম, যা দেহের বৃদ্ধির জন্য অপরিহার্য। তাই সিদ্ধ ডিমের সঙ্গে এক গ্লাস দুধ প্রোটিনের পাশাপাশি অন্যান্য দরকারি পুষ্টি উপাদানগুলোর চমৎকার সামঞ্জস্য সৃষ্টি করে। ডিম ও দুধ একসঙ্গে খেতে কোনোই সমস্যা দেখেন না বিশেষজ্ঞরা।

এসব বিবেচনা করেই জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা ২০১৩ সালের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করে যে, ডিমের কোলেস্টেরলের সঙ্গে হূদরোগের কোনো সম্পর্ক নেই। প্রতিদিন কমপক্ষে একটি করে ডিম খাওয়ার পরামর্শ দেয় এই সংস্থাটি। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন মিডিয়াতে প্রায়ই নকল বা প্লাস্টিকের ডিমের বিষয়ে খবর আসে। দেশের বাজারে এই কৃত্রিম ডিমের অস্তিত্ব রয়েছে বলে অনেকে প্রচারও করেন। কিন্তু বাংলাদেশে কোনো নকল ডিমের অস্তিত্ব নেই।

আবার সম্প্রতি বাজারে আসা অর্গানিক ডিমের পুষ্টিগুণ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। জনগণ মনে করে অর্গানিক ডিম ভোক্তার জন্য খুব নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত। কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে, কোনোভাবেই এসব ডিম অধিক পুষ্টিসমৃদ্ধ নয়।

আবার বেশ কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, ডিমের নানা উপকারিতার পাশাপাশি ডিমের কোলেস্টেরল হূদরোগ, ডায়াবেটিস, চুলকানির জন্য দায়ী। কিন্তু এগুলো প্রতিষ্ঠিত গবেষণা নয়। সুতরাং ডিম পরিহার করা অবশ্যই বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।

লেখক : শিক্ষার্থী, প্রাণিসম্পদ বিজ্ঞান ও ভেটেরিনারি মেডিসিন বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বশেমুরবিপ্রবি), গোপালগঞ্জ

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!