• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

ডেঙ্গু গবেষণায় অগ্রগতি নেই


নিজস্ব প্রতিবেদক অক্টোবর ১৯, ২০১৯, ০৮:০৬ এএম
ডেঙ্গু গবেষণায় অগ্রগতি নেই

ঢাকা : এ বছরে ডেঙ্গু ভুগিয়েছে সারা দেশকে। এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনাও কম হয়নি। এখনো ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০০০ সাল থেকে শুরু করে বাংলাদেশে ধীরে ধীরে ডেঙ্গুজ্বরের প্রকোপ বাড়তে থাকে। শুধু বাংলাদেশ নয়, পরিবেশের বৈরী প্রভাবের ফলে বিশ্বের অনেক দেশে রয়েছে এর প্রভাব। এরপরও সমস্যাটির সমাধানে বিশ্বব্যাপী গবেষণায় অগ্রগতি নেই বললেই চলে।

২০০০ সালে দেশে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত লোকের সংখ্যা ছিল ৫ হাজারের কিছু বেশি। কিন্তু ২০১৯ সালে এসে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা প্রায় লাখ ছুঁই ছুঁই। বেড়েছে মৃত্যুর সংখ্যাও। শুধু বাংলাদেশেই না, বিশ্বব্যাপী গত ৩০ বছরে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ৩০ গুণ বেড়েছে এবং ছড়িয়েছে ১০০টিরও বেশি দেশে। এর মধ্যে অধিকাংশ দরিদ্র দেশ হলেও ইউরোপ, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা এবং মেক্সিকান সীমান্তেও এ রোগ হানা দিয়েছে।

প্রসঙ্গত, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে এশিয়া, দক্ষিণ ও উত্তর আমেরিকার অনেক দেশে ডিডিটির মতো কীটনাশক স্প্রে দিয়ে মশা নিয়ন্ত্রণ করতে কার্যকর এবং অত্যন্ত ব্যয়বহুল প্রচেষ্টা চালানো হয়। যদিও এগুলো পরিবেশ বিপর্যয়ের সৃষ্টি করে। পরে তাই এভাবে মশা নিয়ন্ত্রণ বন্ধ রাখা হয়েছে। বর্তমানে মশা নিয়ন্ত্রণের ওষুধ, মশাধরার ফাঁদ, কীটনাশক লাগানো দ্রব্যসামগ্রী, যেমন মশারি, বন্ধ্যা মশা কিংবা প্রকৃতিতে প্রাপ্ত ব্যাকটেরিয়া ব্যবহার করে মশার বংশ বিস্তার রোধের চেষ্টা চলছে। যার অনেকগুলো এখনো গবেষণাগারের দরজা পেরুতে পারেনি বা সামান্য কিছুর ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল হয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, সাধারণত ক্রান্তীয় ও উপক্রান্তীয় অঞ্চলে পাওয়া যাওয়া নারী এডিস ইজিপ্টি মশা দ্বারা বাহিত (ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত) চার ধরনের (সেরোটাইপ) ডেঙ্গু ভাইরাসের যে কোনো একটি দ্বারা সৃষ্ট ফ্লু’র মতো এ রোগটি ৭০ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে কোনো লক্ষণ প্রকাশ করে না। তবুও বাকিদের জন্য কিন্তু তা মৃত্যুর কারণ হতে পারে। যদিও বায়োসেফটি লেভেল চিন্তা করলে ডেঙ্গু ভাইরাসটি ৪ ধরনের রিস্ক গ্রুপের মধ্যে দ্বিতীয় গ্রুপে পড়ে, অর্থাৎ এটি তেমন বিপজ্জনক নয়। কিন্তু এটি মশাবাহিত হওয়াতে এর আক্রমণ খুব দ্রুত একটি জনগোষ্ঠীতে ছড়িয়ে পড়ে।

জানা গেছে, ডেঙ্গু ভাইরাস আবিষ্কার হওয়ার প্রায় ৫৫ বছর পর এ ভাইরাস শনাক্তকরণের জন্য পরীক্ষা কিট বাজারে আসে। অথচ এইচআইভি আবিষ্কারের মাত্র দুই বছরের মাথায় বাজারে পরীক্ষা করার কিট চলে আসে।

মার্কিন ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্টেশন (এফডিএ) শুধু এইচআইভি সংক্রমণের চিকিৎসার জন্য দুই ডজনেরও বেশি অ্যান্টি-ভাইরাল ওষুধ অনুমোদন করেছে। অথচ ডেঙ্গু চিকিৎসার জন্য এখন পর্যন্ত একটিও ওষুধ বাজারে নেই। ২০১৬ সাল নাগাদ ২৫০টিরও বেশি এইচআইভি ভ্যাকসিনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল পরিচালিত হয়েছে অথচ ডেঙ্গুর হয়েছে মাত্র ৬০টি।

এদিকে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা ১৯৯০ সালে বিভিন্ন দেশের সামগ্রিক স্বাস্থ্য এবং আয়ুর তুলনা করার একটি উপায় হিসেবে ডিসেবিলিটি-অ্যাডজাস্টেড লাইফ ইয়ার (ডালি) স্কোরিং করার পদ্ধতি প্রবর্তন করেন। যার মাধ্যমে কোনো একটি নির্দিষ্ট রোগের কারণে অস্বাস্থ্য, অক্ষমতা অথবা অপরিণত বয়সে মৃত্যুর ফলে কোনো নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর কত বছর নষ্ট হয় তা জানা যায়। যে রোগের স্কোর যত বেশি যে রোগ তত বেশি ক্ষতিকর।

২০১৯ সালের জুন মাসে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা যায়, অবহেলিত ক্রান্তীয় রোগ গোত্রের মধ্যে ম্যালেরিয়ার সর্বোচ্চ ডালিস্কোর ৪ দশমিক ৫ কোটি। তার পরই দ্বিতীয়তে আছে ২৯ দশমিক ২ লাখ নিয়ে ডেঙ্গু। এই রোগগুলো হয়ে থাকে মূলত উষ্ণ অঞ্চলের দেশগুলোতে। যেখানে বসবাস করে পৃথিবীর সবচেয়ে দরিদ্র জনগোষ্ঠী, যারা নিজেরা গবেষণায় অসমর্থ বা নিজেদের গবেষণার অর্থ বরাদ্দ কম।

এমন পরিস্থিতির পরও কেন ডেঙ্গুর অ্যান্টি ভাইরাস আবিষ্কার হচ্ছে না সে বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের অধ্যাপক জানান, ডেঙ্গু রোগ হয় কম আয়ের দেশগুলোতে। যেখানে ওষুধ বিক্রির বাজার খুবই ছোট। এক কথায় ওষুধের ব্যবসা করে বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানি যারা মূলত নতুন ওষুধ তৈরির জন্য গবেষণা করে থাকে, তারা তেমন লাভ পাবে না।

এ কথা সত্য, নতুন ওষুধ নিয়ে গবেষণা করার আগে ফার্মা কোম্পানিগুলো আগে মার্কেটের চাহিদা বুঝে নেয়, তারপর তার জন্য অর্থ বরাদ্দ করে। সেদিক থেকেও ডেঙ্গু অ্যান্টি-ভাইরাল গবেষণা একটা অসুবিধাজনক অবস্থানে আছে। ডেঙ্গু ভাইরেমিয়া অর্থাৎ রক্তে এর অবস্থান খুবই সংক্ষিপ্ত, ৪ থেকে ৫ দিন।

এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সাইফ উল্লাহ মুন্সি বলেন, ধরুন একটা ভালো অ্যান্টি ভাইরাল ওষুধ পাওয়া গেল। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এ ওষুধ যখন রোগীকে দেওয়া হবে তখন তার রক্তে ভাইরাস নাও থাকতে পারে। কারণ ততক্ষণে শরীরের ইমিউন সিস্টেম ভাইরাসকে দমন করা শুরু করাতে রক্তে ভাইরাস কমে যায়।

অন্যদিকে ভাইরাস অন্য কোষ, টিস্যু বা শারীরিক গহ্বরে বিস্তার লাভ করতে পারে। যেখানে ডেঙ্গু ভাইরাসের অ্যান্টি ভাইরাল ওষুধ নাও পৌঁছতে পারে। ডেঙ্গু সংক্রমণের প্রাথমিক পর্যায়ে ভাইরাস কমাতে পারে এমন একটি ওষুধ যদি প্রয়োগ করা যায় তবে তা ডেঙ্গু জ্বর কমাবে, রক্তক্ষরণ বা শক-এর মাত্রা ও সম্ভাবনা প্রতিরোধ করবে। তাই ডেঙ্গু রোগের দ্রুত নির্ণয় এবং অ্যান্টি ভাইরাল প্রয়োগ সাফল্যের মূল চাবিকাঠি।

ফার্মাসিস্টদের মতে, একটি নতুন ভ্যাকসিন তৈরি করতে দীর্ঘ সময় লাগে। সাধারণত ১০ থেকে ১৫ বছর। ভ্যাকসিনগুলোর উন্নয়ন বিভিন্ন পর্যায়ে চলে। যেমন গবেষণা, আবিষ্কার, প্রাক-ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা, ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা (যা ৭ বছর পর্যন্ত সময় নিতে পারে) এবং অনুমোদন। একবার ভ্যাকসিন অনুমোদিত হয়ে গেলে (আরো ১ বছর অবধি দীর্ঘতর প্রক্রিয়া) ভ্যাকসিনটি প্রস্তুত করা হয় এবং যেখানে এটি প্রয়োজন সেখানে পাঠানো হয়।

ভ্যাকসিনগুলো কার্যকর এবং নিরাপদ কি না তা পরীক্ষা করার জন্য এবং তদারকির মাধ্যমে ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়, কারণ কখনো কখনো টিকা ব্যবহারের জন্য নিবন্ধিত হওয়ার পরে অপ্রত্যাশিত পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। সম্প্রতি ফিলিপিন্সে ব্যবহূত ডেঙ্গু ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে তাই হয়েছে। কিছু শিশুর মধ্যে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া পাওয়া যাওয়ায় তা বর্তমানে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!