• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ডেঙ্গুর লক্ষণ এখন দুর্বোধ্য


নিজস্ব প্রতিবেদক জুলাই ২৪, ২০১৯, ০৩:১৫ পিএম
ডেঙ্গুর লক্ষণ এখন দুর্বোধ্য

ঢাকা : সময়ের সঙ্গে সঙ্গে লক্ষণ ও আক্রান্তের অসুস্থতার ধরনও পাল্টেছে ডেঙ্গুর। আগে লক্ষণ হিসেবে প্রথম দিন থেকে প্রচণ্ড জ্বর, মাথাব্যথা, চোখের পেছনে ব্যথা, শরীরে ব্যথা, ত্বক লাল হয়ে যাওয়া এবং কিছু ক্ষেত্রে শরীরে র‍্যাশ বা দানা দেখা দিত। এখন অনেকের ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রমও দেখা যাচ্ছে।

প্রথম অবস্থায় খুবই হালকা জ্বর আবার কারো কারো ক্ষেত্রে বমি, তীব্র পেটব্যথা, হার্টের সমস্যা, ব্রেইন এফেক্ট, লিভার বড় হয়ে যাওয়া বা পানি জমে যাওয়া এবং খিঁচুনি নিয়ে হাসপাতালে এসে ডেঙ্গু শনাক্ত হচ্ছে অনেকের।

সরকারি হিসেবে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে এ পর্যন্ত মারা গেছেন ৬ জন। এর মধ্যে হবিগঞ্জ জেলার সিভিল সার্জন ডা. শাহাদাত হোসেনসহ ২ জন চিকিৎসক ও একজন নার্সও রয়েছেন।

সরকারি হিসেবে এ বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে ছয়জন মারা যাবার কথা বলা হলেও গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী মৃতের সংখ্যা আরো বেশি। সরকারি-বেসরকারি ১৭ হাসপাতাল এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মিলিয়ে দেখা গেছে, এ পর্যন্ত অন্তত ২৩ জন মারা গেছে। এদের অধিকাংশই শিশু। মৃতের তালিকায় দুজন চিকিৎসক, একজন নার্স, চিকিৎসকের এক ছেলে এবং শিক্ষকের এক ছেলেও রয়েছে।

ঢাকা শিশু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. সৈয়দ শফী আহমে দিত জ্বর আর মাথাব্যথা। এছাড়া চোখের পেছনে ব্যথা এবং গায়ে র্যাশ দেখা দিত। কিন্তু এবারের লক্ষণগুলো ব্যতিক্রম। এখন ডেঙ্গু আক্রান্ত কারো তীব্র পেটব্যথা হচ্ছে, কারো হার্টের সমস্যা বাড়ছে, কারো ব্রেইনে এফেক্ট করছে আবার কারো লিভার বড় হয়ে যাচ্ছে বা পানি জমে যাচ্ছে।

তিনি বলেন, অন্যান্য বছরের চাইতে এবারে এই জটিলতাগুলো অনেক বেশি। তাই বুঝে ওঠার আগেই অনেক সময় ডেঙ্গু আক্রান্তদের অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে।

ঢাকা শিশু হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, এ পর্যন্ত ২২৬ ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রয়েছে ৬২ শিশু। আর বিশেষ পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে তিন শিশুকে।

অধ্যাপক ডা. সৈয়দ শফী আহমেদ জানান, এখন প্রতিদিনই অসুস্থ অনেক শিশুকে ডেঙ্গু পরীক্ষা করাতে হাসপাতালে আনা হচ্ছে। এসব শিশুর অনেককে বহির্বিভাগে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। আক্রান্ত অবস্থায় অনেক শিশুকে ভর্তিও করা হয়েছে। অন্যান্য বছরের চাইতে লক্ষণগুলো ব্যতিক্রম হওয়ায় অভিভাবকরা বুঝে ওঠার আগেই অনেক সময় ডেঙ্গু আক্রান্ত বাচ্চাদের অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে।

ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ও শিশুর অভিভাবকদের বিচলিত না হয়ে তরল খাবার ও প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ দিতে পরামর্শ দিয়েছেন শিশু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. সৈয়দ শফী আহমেদ। পাশাপাশি চিকিৎসকের কাছে নিয়ে আসারও কথা বলেন তিনি।

শিশু হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া পাইকপাড়ার রুবেল হোসেন (৫)-এর বাবা জয়নাল হোসেন বলেন, শুক্রবার বিকেলে রুবেলের হালকা জ্বর ওঠে। রাতে বমি ও পেট ব্যথা হয়। এছাড়া আর কোনো সমস্যা দেখা যায়নি। শনিবার একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে গেলে পরীক্ষা করে ডাক্তার জানায় তার ডেঙ্গু হয়েছে। অথচ লক্ষণ দেখে বোঝাই যায়নি ছেলের ডেঙ্গু হয়েছে। ৩ দিন সেখানে চিকিৎসা দেওয়ার পরও অবস্থার উন্নতি না হলে গতকাল মঙ্গলবার শিশু হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়।

তাজভীর নামে ৩ বছরের এক রোগীকে শিশু হাসপাতালের পেডিয়াট্রিক ইনসেনটিভ কেয়ার ইউনিটে (পিআইসিইউ) নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। তাকে স্যালাইন দেওয়া হয়েছে।

চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, চব্বিশ ঘণ্টা পর্যবেক্ষণে রাখার পর পরবর্তী করণীয় ঠিক করা হবে। রোগীর স্বজনরা জানায়, ৪ দিন আগে সামান্য জ্বর হয় তাজভীরের। পরে পেট ব্যাথা ও বমি শুরু হয়। সাপোজিটর দেওয়ার পরও ক্রমাগত বমি করতে থাকে। হাসপাতালে নিয়ে টেস্ট করানোর পর ডেঙ্গু ধরা পড়ে। প্রথমে ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে ৪ দিন চিকিৎসাধীন থাকার পরও অবস্থার উন্নতি না দেখে তাকে দ্রুত শিশু হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়।

ওই শিশুর পাশেই চিকিৎসাধীন রয়েছে সাড়ে চার বছরের আরেক শিশু রুম্মান। গত সোমবার হঠাৎ করেই তীব্র জ্বর দেখা দেয় তার। সঙ্গে শুরু হয় তিন-চার মিনিট ধরে খিঁচুনি। দ্রুত গ্রিন রোডের একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিলে টেস্টে ডেঙ্গু ধরা পড়ে। সেখানে ভর্তি করানোর পর অবস্থার উন্নতি না দেখে রুম্মানকে শিশু হাসপাতালে আনা হয়। শিশু হাসপাতালে কথা হয় ডেঙ্গু আক্রান্ত এমন আরো বেশ কিছু শিশুর অভিভাবকের সঙ্গে। তারা জানান, শুরুতে ডেঙ্গুর বিষয়টি বোঝাই যায়নি।

এদিকে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের মেয়র ডেঙ্গু প্রতিরোধে প্রতিদিন মিটিংসহ সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করার ঘোষণা দিয়ে মিডিয়া কাভারেজ নিচ্ছেন কিন্তু বাস্তবে ডেঙ্গু মোকাবেলায় সঠিক কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছেন না বলে অভিযোগ নগরবাসীর।

রাজধানীর আগারগাঁও তালতলার বাসিন্দা ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ১০/১২ দিন ধরে চারদিকে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা যে হারে বাড়ছে বেশ আতঙ্কে আছি। বিশেষ করে আগারগাঁও এলাকায় মশার উপদ্রব এত বেশি, আমাদের অর্থমন্ত্রী নিজেও ২ বার মশার কামড়ে আক্রান্ত হয়েছেন বলে গণমাধ্যম সূত্রে জানতে পেরেছি। তিনি বর্তমানে আগারগাঁও অফিস করা বাদ দিয়ে সচিবালয়ে অফিস করছেন।

কিন্তু আমরা বাসা-বাড়ি ছেড়ে কোথায় যাব?

খিলগাঁওয়ের বাসিন্দা রাশেদুল আলম রিংকু বলেন, আমার ছেলের জ্বর নিয়ে একটি হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে নিয়ে ডেঙ্গু মুক্ত জেনে কিছুটা স্বস্তি মিললেও কোনোভাবেই আতঙ্কমুক্ত হতে পারছি না। যে পরিমাণ মশা, যে কোনো সময় পরিবারের সদস্যদের ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার আতঙ্কে থাকি।

কথা হয় দুই সিটির আরো বেশ কয়েকজন নাগরিকের সঙ্গে। তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, মশার ভয়ে বাসায় দরজা-জানালা বন্দি হয়ে থাকার পাশাপাশি রাতে এবং দিনেও মশারিবন্দি হয়ে থাকতে হচ্ছে। অথচ দুই সিটির মেয়র সচেতনতা নিয়ে ব্যস্ত। টেলিভিশনে প্রতিদিন বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন।

প্রতিদিন বিভিন্ন গণমাধ্যমে সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে জানানো হয় কতগুলো টিম গঠন করা হয়েছে। সে টিম নাকি বাড়ি বাড়ি গিয়ে এডিস মশা নিধন ও ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে সচেতনতা বাড়াবে। কিন্তু এ পর্যন্ত কয়টি বাসায় ডেঙ্গু টিম গেছে তার পরিসংখ্যান দিতে পারবে না সিটি করপোরেশন।

ডিএনসিসি ও ডিএসসিসি সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের তুলনায় এ বছর ডেঙ্গু জ্বরের প্রভাব বেশি। সিটি করপোরেশনও এডিস মশা নিধন ও ডেঙ্গু জ্বর নিয়ন্ত্রণে কোমর বেঁধে মাঠে নেমেছে।

মশক নিধনসহ নগরবাসীকে সচেতন করতে তৈরি করা হয়েছে বিশেষ টিম, যারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাজ করছেন। তবে সিটি করপোরেশনের কথার সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করেছেন অনেকেই।

তাদের অভিযোগ, ডিএনসিসি ও ডিএসসিসির মেয়রদের এসব কথা গণমাধ্যম ও র্যালি পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। কার্যত এসব আশ্বাসের বা বিশেষ টিমের কোনো সুবিধাই পাচ্ছেন না নগরবাসী। সবই লোক দেখানো। রাজধানী ময়লা-আবর্জনায় সয়লাব। আগে নগরী পরিষ্কারের যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল সেটিও এখন মুখ থুবড়ে পড়েছে।

কিন্তু এ বিষয়ে ডিএনসিসির মেয়র আতিকুল ইসলাম ও ডিএসসিসির মেয়র সাঈদ খোকন জোর গলায় বলছেন, তারা চেষ্টা করছেন ডেঙ্গু ও এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে। ইতোমধ্যে ডিএনসিসির বর্জ্য ও মশক নিধন বিভাগের কর্মকর্তাদের ঈদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে এবং ২৫ হাজার বাসায় গিয়ে এডিস মশা মারার সিদ্ধান্তও নিয়েছে ডিএসসিসি।

এদিকে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তের সংখ্যা এরই মধ্যে সাড়ে ৩ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। আগামী মাসে এ পরিস্থিতির আরো অবনতির আশঙ্কা করছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগ।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!