• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ঢাকার ক্যাসিনো গার্লরা আতঙ্কে


সোানালীনিউজ ডেস্ক সেপ্টেম্বর ২১, ২০১৯, ০৯:০০ এএম
ঢাকার ক্যাসিনো গার্লরা আতঙ্কে

ঢাকা : ঢাকার বিভিন্ন ক্যাসিনোয় কাজ করতেন চীন ও নেপালের অন্তত ৪০০ প্রশিক্ষিত তরুণ-তরুণী। তারা মূলত বেতনভোগী। ট্যুরিস্ট ভিসায় আসা এসব তরুণ-তরুণীর প্রত্যেকেই সুশিক্ষিত; চেহারায় রয়েছে আভিজাত্যের ছাপ। বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষায় পারদর্শী।

তাদের কেউ কাজ করতেন রিসেপশনে, কেউ ইলেকট্রনিক জুয়ার বোর্ড অপারেটিংয়ে, কেউ নিয়োজিত ছিলেন ক্যাসিনো থেকে অর্থ পাচার কাজে। ক্যাসিনোয় আসা জুয়াড়িদের মনোরঞ্জনের জন্য আনা সুন্দরী গার্লদের রাখা হতো রাজধানীর গুলশান, নিকেতন, বনানী, ধানম-ি, উত্তরা, পল্টন, ফকিরাপুল, শাহজাহানপুর ছাড়াও বিভিন্ন এলাকার প্রাসাদোপম ভবনে।

তাদের আনা-নেওয়া করা হতো কালো কাচঘেরা প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব গাড়িতে। নিরাপত্তা থেকে শুরু করে এসব গার্লের থাকা-খাওয়া, সাজসজ্জা সব কিছুই বহন করত সংশ্লিষ্ট ক্যাসিনো পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান। রাজধানীর ক্যাসিনোগুলোয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একের পর এক অভিযানে ভিনদেশি এসব ক্যাসিনো গার্ল পড়েছেন বিপাকে।

প্রশাসনের কড়া নজরদারির কারণে অধিকাংশই এখন না যেতে পারছেন নিজ দেশে, ভিসার মেয়াদ না থাকায় থাকতেও পারছেন না বাংলাদেশে। এদিকে যাদের ভরসায় এসেছিলেন, তারাও প্রতিষ্ঠান ছেড়ে পালিয়েছেন। ফলে অজানা আতঙ্ক ভর করেছে তাদের মধ্যে।

ঢাকার ক্যাসিনোয় শুধু ভিনদেশি তরণ-তরুণীই নয়, পেটের দায়ে অথবা বিলাসী জীবন-যাপনের জন্য এই চক্রে জড়িয়ে পড়েছেন শিক্ষিত বাংলাদেশি তরুণ-তরুণীরাও। জুয়ার বোর্ড অপারেটিং ও অর্থ পাচারে ভিনদেশিদের অভিজ্ঞতা নিয়ে তারাও এখন অভিজ্ঞ। গতকাল শুক্রবার ক্যাসিনোয় কাজ করা কয়েকজন তরুণ-তরুণীর সঙ্গে কথা বলে এই তথ্য জানা গেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তদন্তেও ক্যাসিনোর কর্মচারীদের বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উঠে এসেছে।

গত বুধবার বিকালে ফকিরেরপুলের ইয়ংমেন্স ক্লাবের ক্যাসিনোয় অভিযানকালে কর্মরত কয়েকজন চীনা ও নেপালি নাগরিককে আটক করে র‌্যাব। তাদের কারোরই ওয়ার্ক পারমিট নেই। আটকদের মধ্যে ওয়েস্টার্ন ড্রেস পরা দুই তরুণীও ছিলেন। কাপড় পাল্টে থ্রিপিস পরতে চাইলে র‌্যাবের বাগড়ায় তারা বলেন, ‘পেটের তাগিদে জুয়ার বোর্ডে চাকরি করি, স্যার। আমাদের থ্রিপিসটা পরতে দেন। ওয়েস্টার্ন ড্রেস না পরলে চাকরি থাকবে না।’

নিজেদের নিরপরাধ দাবি করে নেপালের এক গার্ল জানান, ইয়ংমেন্স ক্লাবে দেড় মাস ধরে চাকরি করছিলেন। দৈনিক দুই শিফটে ১২ ঘণ্টা অন্তর মোট ১২ জন গার্ল কাজ করেন। ক্যাসিনোয় তাদের ‘ডিলার’ নামে সম্বোধন করা হয়। মাসিক ও দিন হিসেবে কখনো রিসেপশনে, কখনো বোর্ডে কার্ড সরবরাহকারীর দায়িত্ব পালন করেন। রিসেপশনিস্টের বেতন ২১ হাজার আর কার্ড বিতরণকারীকে বেতন দেওয়া হতো ১০ হাজার টাকা।

তাদের স্বামী এ কাজের বিষয়ে জানলেও স্বজনরা জানত না। তিনি আরও জানান, ক্যাসিনোয় সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা এবং রাত ৮টা থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত জুয়া খেলা হয়। জুয়ার বোর্ডগুলো চালু করে চীনা নাগরিকরা। বোর্ড পরিচালনা করে নেপালিরা। দিনের প্রতি শিফটে ৭০-৮০ জন মানুষ খেললেও রাতের বেলায় বেশি মানুষের সমাগম হয়। ক্যাসিনোয় অনেকে ইয়াবাসহ নানা ধরনের মাদক সেবন করে বলেও জানান তিনি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে গতকাল মতিঝিলের এক নেপালি গার্ল জানান, তাদের ক্যাসিনোয় পোকার (জুজু খেলা), কার্ডসøট মেশিনের খেলা ছাড়াও বাক্কারাট (বাজি ধরে তাস খেলা), রুলেট, পন্টুন, ফ্লাশ, বিট, ডিলার, কার্ডসøট, ব্লাকজ্যাক নামের জুয়া খেলা হতো। এ ছাড়া রেমি, কাটাকাটি, নিপুণ, চড়াচড়ি, ডায়েস, ওয়ান-টেন, ওয়ান-এইট, তিন তাস, নয় তাস, ফ্লাশ-জুয়াও চলত।

আয়োজকরা ইয়াবা-মদের আসরের ব্যবস্থাও রেখেছিলেন। বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, কর্মকর্তা থেকে শুরু করে বিত্তশালী পরিবারের তরুণরাও এখানে আসত। বড় জুয়াড়িদের প্রথমে সম্ভাষণ করা হয় মদের গ্লাস দিয়ে। বাহারি খাবারের আয়োজন থাকলেও সবই মেলে বিনাপয়সায়। তিনি আরও জানান, জুয়া পরিচালনার জন্য নেপালসহ পার্শ্ববর্তী বেশ কয়েক দেশের তরুণীরা কাজ করেন। ভিজিট ভিসায় আসা তরুণীদের বেশিরভাগই নেপালি। লাখ টাকার বেশি অগ্রিম দিয়ে তাদের বিদেশ থেকে আনা হয়। বেতন ১০ হাজার থেকে শুরু করে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত।

ঢাকার বিভিন্ন ক্যাসিনোয় কাজ করেন কমপক্ষে ২০০ ক্যাসিনো গার্ল। তাদের মধ্যে ৫০ থেকে ৬০ জন জুয়ার বোর্ড অপারেটিংয়ে পারদর্শী। অন্যদের কেউ কাজ করেন রিসেপশনে। প্রতিদিনই অন্তত ৫ জন ক্যাসিনো গার্ল ও ৫ জন ক্যাসিনো বয় ব্যাগে ১০ থেকে ১৫ হাজার ডলার নিয়ে নেপালে যান। সেখান থেকে সব টাকা একত্রিত করে হুন্ডির মাধ্যমে সিঙ্গাপুরে পাচার করা হয়। এই পাচারকাজে সবচেয়ে বেশি পারদর্শী নেপালি তরুণী সোয়েতা ও কামালা। পুরুষদের মধ্যে বিজে। বাংলাদেশিদের মধ্যে নিশিতা ও আলম সরকার।

ক্যাসিনো বাণিজ্যের মূলহোতা নেপালের বাসিন্দা দিনেশ ও রাজকুমার। ক্যাসিনোগুলোয় চীন থেকে আনা কার্ড সাপ্লাই দেয় মতিঝিলের ভিক্টোরিয়া ক্লাবের হেমন্ত শাহা। তিনিও নেপালি। মিথ্যা ঘোষণায় চীন থেকে বৈদ্যুতিক ক্যাসিনো বোর্ড বাংলাদেশে আনেন আবুল কাশেম ও এমরান। তারা মোহামেডান ক্লাব ও বনানীর গোল্ডেন ঢাকা বাংলাদেশের কর্ণধার। সম্প্রতি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লাগাতার অভিযানে ক্যাসিনোর মালিকরা গা-ঢাকা দিয়েছেন। ফলে কী করব, কোথায় যাব ভেবে পাচ্ছি না। প্রতিনিয়ত গ্রেপ্তার আতঙ্ক কাজ করছে বলেও ওই ক্যাসিনো গার্ল জানান।

অভিন্ন মন্তব্য করে মতিঝিলেরই অন্য এক ক্যাসিনো গার্ল জানান, তাদের ক্যাসিনোর বিশাল হলরুমে প্রায় ২০টি বোর্ড ছিল। বোর্ডের চারপাশ ঘিরে দিন-রাত মাদকের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকতেন জুয়াড়িরা। তাদের পাশ ঘেঁষে ভিনদেশি সুন্দরী তরুণীরা প্রতিনিয়ত খেলায় উৎসাহ দিতেন। কেউ এগিয়ে দেন মদের বোতল। ক্যাসিনোয় ব্ল্যাকজ্যাক, ভিডিও পোকার, ব্রাকরেট, ক্রাপ ও রুলেট নামক খেলাগুলোই গ্রাহকরা বেশি খেলে থাকেন। জুয়াড়িদের অনেকে এক রাতেই রাজা বনে যান, আবার অনেকেই হয়ে যান ফকির। কিছু কিছু খেলায় গ্রাহক সরাসরি পরস্পরের বিপক্ষে বাজি ধরার সুযোগ পায় এবং হাউস এখান থেকে কমিশন নেয়। একে র‌্যাক বলা হয়। এ ছাড়া গ্রাহকদের আগ্রহী করতে ক্যাসিনোর পক্ষ থেকে নানা অফার দেওয়া হয়ে থাকে। ক্যাসিনো গার্লদের অনেক সময় জুয়াড়িদের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কও গড়তে হয়। আমাদের সময়।

সোনালীনিউজ/এএস

Wordbridge School
Link copied!