• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
একরামুলের নিহতের এক বছর

তাহিয়াত ও তাহিয়ানের কান্না থামেনি


নিজস্ব প্রতিবেদক মে ২৯, ২০১৯, ০৯:৩৮ পিএম
তাহিয়াত ও তাহিয়ানের কান্না থামেনি

ঢাকা : ‘আব্বু, তুমি কান্না করতেছো যে?’ এক বছর আগে র‍্যাবের গুলিতে নিহত হওয়ার ক্ষণিক আগ মুহূর্তে টেকনাফের পৌর কাউন্সিলর একরামুল হক ও তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মোবাইলে কথোপকথনের একটি অংশ এটি। বাবা-মেয়ের আলাপের বাক্যটি দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করে। অনেকের চোখের জল ঝরিয়েছে এই কথোপকথন। ফোনের অপর প্রান্তে থাকা কন্যার বাবাকে গুলি করা মুহূর্তের সেই হূদয়বিদারক, লোমহর্ষক ওই অডিও রেকর্ড সারা দেশের মানুষ আবেগঘন হয়ে বারবার শুনেছে। একরামুল হকের দুই মেয়ে তাহিয়াত হক (১৫) ও তাহিয়ান হকের (১২) কান্নায় কেঁদেছে সাধারণ মানুষ।

দেশের বিশিষ্টজনদের অনেকের দাবি—বন্দুকযুদ্ধের নামে চলছে পরিকল্পিত হত্যা। একরামুল হকের এ ঘটনার পর বন্দুকযুদ্ধ নাকি বন্দুকযুদ্ধের নামে পরিকল্পিত হত্যা—এই আলোচনা বেশ গতি পায়। বিচারের দাবি জোরালো হয়ে ওঠে। বিচারের আশ্বাসও মেলে, অথচ এক বছর অতিবাহিত হয়েছে। কিন্তু এখনো কোনো বিচার মেলেনি।  একরামুল হক টেকনাফ পৌরসভার ৩নং ওয়ার্ডের তিনবারের নির্বাচিত কাউন্সিলর এবং টেকনাফ উপজেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতিও ছিলেন।  গত বছর ‘চল যাই যুদ্ধে-মাদকের বিরুদ্ধে’ নামে আলোচিত এক অভিযানে ২৬ মে র‍্যাবের গুলিতে একরামুল হক নিহত হন। র‍্যাব দাবি করেছে, ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন। তিনি একজন মাদক কারবারি ছিলেন। এই ঘটনায় টেকনাফ থানায় একটা মামলাও করেছে র‍্যাব।

ওই সময় সারা দেশে অন্তত একশ মাদক চোরাকারবারি নিহত হয় এবং সে ব্যাপারে কেউ মুখ খোলেনি। একরামুল নিহত হওয়ার আগে মেয়ের সঙ্গে কথোপকথনের অডিও সারা দেশে ছড়িয়ে পড়লে এ রকম হত্যাকাণ্ড নিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিচারের দাবি জোরালো হয়ে ওঠে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বন্দুকযুদ্ধ নিয়ে সাধারণ মানুষও প্রশ্ন তোলে।

একরামুল হক র‍্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হওয়ার পর পরিবারের সদস্যরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সে সুযোগ হয়নি আজও। নিহতের এক বছর পরও শেষ হয়নি ঘটনার তদন্ত। সেই আক্ষেপ আর হতাশা ঝরে পড়েছে একরামের স্ত্রী আয়েশা বেগমের কণ্ঠে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, আমি আজীবন আমার স্বামী হত্যার বিচার চাইব।

আয়েশা বেগম বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে চাই। কোথায় গেলে, কী করলে আমি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে পারব? আমি এখনো প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার আশায় আছি। আমি বিশ্বাস করি, কোনো এক সময় মোবাইলে ফোন করে আমাকে ডাকবেন প্রধানমন্ত্রী। তখন আমি আমার স্বামীর হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে সবকিছু বোঝাতে সক্ষম হব। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা হলে বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি করব। আমার বিশ্বাস, বিচার বিভাগীয় তদন্ত হলে স্বামী হত্যার সঠিক বিচার পাব।

তিনি বলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের আমাকে আশ্বাস দিয়েছিলেন, সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে এ ঘটনার বিচার করবে সরকার। তদন্ত করে দেখা হবে হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি। কিন্তু গত এক বছর পার হলেও কিছুই হয়নি।

তিনি আরো বলেন, আমি আমার স্বামী হত্যার বিচার চেয়ে থানায় মামলা অথবা একটি সাধারণ ডায়েরি করতে চেয়েছিলাম। আমার পরিবারকে মামলা করতে দেয়নি একটি মহল। ইয়াবার কারণে এ ঘটনা ঘটেনি; এটি নাটকীয় ও ষড়যন্ত্রমূলক একটি হত্যাকাণ্ড।

আমাকে বলছিল প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার পর মামলা করতে। কিন্তু এই পর্যন্ত কোনো মামলা তো দূরের কথা, একটু তদন্তও হয়নি। আমি মেয়ে দুটির দিকে তাকিয়ে এখনো টেকনাফে অবস্থান করছি এবং মানবেতর জীবনযাপন করছি। আমি আমার দুই মেয়েকে পড়ালেখা করাতে চাই। এখনো তারা বিজিবি স্কুলে পড়ছে। কর্তৃপক্ষ কোনো ফি ছাড়াই পড়ার সুযোগ করে দিয়েছে।

আমি তার স্ত্রী হিসেবে নই, দেশের নাগরিক হিসেবে জানতে চাই, কেন আমার স্বামী খুন হলো? কেউ আমার দুই মেয়ের খবর রাখেনি। জানি না এটি কেমন সমাজ! আমার কষ্টের জীবন চলছে। একদিকে স্বামী হত্যার বিচার কবে পাব; অন্যদিকে মেয়েদের কান্না আর কতদিন শুনতে হবে। একরামুল হক নিহতের বিষয়ে জানতে চাইলে টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাস বলেন, র্যাবের করা মামলার ভিত্তিতে তদন্ত চলছে। তবে পরিবারের কাছ থেকে কোনো অভিযোগ পাইনি।

প্রদীপ কুমার দাস আরো বলেন, তদন্তের স্বার্থে কিছু বলা যাবে না। তবে যত দ্রুত সম্ভব তদন্ত শেষে চার্জশিট দেওয়া হবে। একটি মামলা থাকা অবস্থায় আরেকটি মামলা হয় না। তারপরেও এই মামলাটি আমরা গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করছি।

বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেন, একরামুল হকের ঘটনাটি ছিল বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। এমন একটি চাঞ্চল্যকর ঘটনার এক বছর পার হয়ে গেলেও তারা তদন্ত শেষ করতে পারেনি বা করেনি।

তিনি বলেন, আমরা চাপ সৃষ্টি করছি। তারা তদন্তের জন্য যে সময় পায়, সেই সময়টা আরো বাড়িয়ে নিচ্ছে। অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে বেশি সময় নেওয়া হচ্ছে। চার্জশিটটা খুব দ্রুত দিতে হবে এবং বাস্তবসম্মত হতে হবে। প্রসঙ্গত, গত বছরের ২৬ মে রাতে টেকনাফের মেরিন ড্রাইভ সড়কে একরামুল হক র্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। তার ছয় দিন পর কক্সবাজার প্রেস ক্লাবে একরামের স্ত্রী আয়েশা বেগম সংবাদ সম্মেলন করার পর বিষয়টি দেশজুড়ে আলোচনায় আসে।

এ ঘটনায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান রিয়াজুল হকসহ র্যাব ও সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ঘটনাটির সুষ্ঠু তদন্তের আশ্বাস দেন একরামের পরিবারকে। কিন্তু সে আশ্বাস পূরণ হয়নি এক বছরেও।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!