• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

তিন বছরে বিদেশে ২৯৪ নারী কর্মীর মৃত্যু!


নিউজ ডেস্ক মে ৩১, ২০১৯, ০৮:০৫ পিএম
তিন বছরে বিদেশে ২৯৪ নারী কর্মীর মৃত্যু!

প্রতীকি ছবি

ঢাকা : পরিবারের সচ্ছলতা ফেরাতে ২০১৮ সালে কাজের উদ্দেশে সৌদি আরব যান শাহনাজ। পরিবারের সুদিন ফেরাতে পারেননি তিনি, তার আগেই বেছে নেন আত্মহননের পথ। গত জানুয়ারিতে দেশে আনা হয় মরদেহ। তার পরিবার জানে না শাহনাজ কী কারণে আত্মহত্যা করেছেন। প্রবাসে এ রকম অনেক নারীকর্মীর আত্মহত্যার সঠিক কারণ জানা যায় না। এমনকি জানার চেষ্টাও করা হয় না।

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রবাসী কল্যাণ ডেস্কের হিসাব অনুযায়ী, বিদেশে কাজ করতে গিয়ে গত তিন বছরে আত্মহত্যা করেছেন ৪৪ জন নারীকর্মী। ডেস্কের কর্মকর্তাদের মতে, প্রবাসে মৃত কর্মীর লাশ সরকার নিজ খরচে দেশে আনে। এছাড়া সরকার দাফনের খরচসহ ক্ষতিপূরণেরও ব্যবস্থা করে থাকে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, অনেক পরিবারের সদস্যরা লাশ ফেরত নিতে চান না, বিদেশ থেকে লাশ আনার জন্য আবেদনও করেন না। ফলে বিদেশে কাজ করতে গিয়ে ঠিক কতজন মারা যায় বা আত্মহত্যা করে তার সঠিক হিসাব জানা যায় না।

এ বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে বিদেশ থেকে নারীকর্মীর লাশ এসেছে ২৩টি। এর মধ্যে আত্মহত্যার কারণে মৃত্যু সাত জনের। এছাড়া গত তিন বছরে ২৯৪ জন নারী কর্মীর মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গেছে। এর মধ্যে ২০১৬ সালে ৫৭ জন, ২০১৭ সালে ১০২ এবং ২০১৮ সালে ১১২ জনের মৃত্যু হয়েছে। মৃত নারীকর্মীদের মধ্যে আত্মহত্যা করেছেন ৪৪ জন।

এছাড়া স্ট্রোকের কারণে মৃত্যু হয়েছে ১১০ জন নারী কর্মীর। ফেরত আসা লাশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি এসেছে সৌদি আরব থেকে যার সংখ্যা ১১২। এছাড়া সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে ২৬, ওমান থেকে ৩৪, লেবানন থেকে ৪২ এবং জর্ডান থেকে ৬২টি নারীকর্মীর লাশ এসেছে দেশে। ২০১৬ থেকে পরিসংখ্যান দেখলে জানা যায়, মধ্যপ্রাচ্যে বিশেষ করে সৌদি আরবে নারীকর্মীদের আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে।

নারীকর্মীদের আত্মহত্যার প্রবণতায় উদ্বিগ্ন সৌদি আরবের বাংলাদেশ দূতাবাস। গত বছর দূতাবাসের সেফহোমে কল্পনা নামের এক নারীকর্মী আত্মহত্যা করেন। প্রাথমিক তদন্তে কল্পনা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলেন বলে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে জানানো হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা  বলেন, কল্পনা কোনও কারণে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিল বলে আমরা জানতে পেরেছি। তবে তার এই অবস্থার (মানসিক ভারসাম্য) কারণ জানা যায়নি, জানা গেলে আত্মহত্যার কারণ জানা যেত।

নাটোরের লালপুর উপজেলার আবদুর রহিমের মেয়ে শাহনাজের পরিবার জানে না কি কারণে আত্মহত্যা করেছেন তিনি। তার ভাই গুলজার বলেন, এক ছেলে ও এক মেয়েকে রেখে শাহনাজ পরিবারের সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনতেই ২০১৮ সালে সৌদি আরব গিয়েছিলেন। কি কারণে সে আত্মহত্যা করলো, কি এমন হয়েছিল তার সঙ্গে আমাদের জানা নেই।

যশোরের অভয়নগরের দুদু কাজীর মেয়ে জেসমিনের সৌদি আরবে খাবার আর ওষুধ নিয়ে সমস্যা হতো বলে জানান তার ছেলে মোতাহার গাজী। তিনি বলেন, মা ফোন করে বলতো খাবারের সমস্যা। এ দেশ থেকে যেগুলো ওষুধ নিয়ে গেল সেগুলো খাইতে দেয় না।

সবশেষ যখন কথা হয় তখন বললাম, আমি নামাজ পড়ে তোমার জন্য দোয়া করবো মা। মা আমারে বলেন, কি দোয়া করিস, আমার কোনও কাজে লাগে না। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দুই দিন আগে সৌদি আরব থেকে একজন ফোন করে আমারে জানায় আমার মা আত্মহত্যা করেছে। কি কারণে আত্মহত্যা করলো এখনও জানি না।

নাসিমা আক্তার (ছদ্মনাম) অনেক স্বপ্ন নিয়ে দালালের মাধ্যমে কাজের আশায় পাড়ি জমিয়েছিলেন সৌদি আরবে। এজন্য দালালকে দিতে হয়েছে ৪০ হাজার টাকা। চুক্তি হয়েছিল ৮০ হাজার টাকার। বাকি টাকা কাজে যোগ দিয়ে মাসিক বেতন এক হাজার রিয়াল থেকে দেওয়া হবে। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র বুঝে নিয়ে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতে গত ফেব্রুয়ারিতে সৌদি আরব যান।

জেদ্দা এয়ারপোর্টে নামার পর রিক্রুটিং এজেন্সির লোক তাকে একটি বাড়িতে রাখে। চারদিক বন্ধ এই বাড়িকে বলা হয় ক্যাম্প। সেখানে তার সঙ্গে আরও কয়েকজন বাংলাদেশি নারী শ্রমিকের দেখা হয়। তাদের কাছে জানতে পারেন পাশবিক নির্যাতনের কথা। পাঁচ দিন পর নাসিমাকে পৌঁছে দেওয়া হয় তার নিয়োগকর্তার বাড়িতে। ছোট পরিবারের কথা বলে তাকে পাঠানো হলেও সেখানে গিয়ে দেখেন ভিন্ন চিত্র। ১১ সদস্যের পরিবারের রান্না, ঘরদোর মোছা, কাপড় ধোয়া থেকে শুরু করে সবই করতে হবে।

কাজ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেলেও বিশ্রামের সুযোগ নেই। কারণ বিশ্রাম করতে গেলেই কফিল (মালিক) লাঠি দিয়ে মারে। দেশে ফিরে এভাবেই সৌদির দিনগুলোর বর্ণনা দেন তিনি। নাসিমা বলেন, কফিলের মুখের ভাষা আমি বুঝি না। এজন্য অনেক সমস্যা হইতো। খাবার দিতো না ঠিক মতো, আবার অসুস্থ হইলে চিকিৎসা করাতো না। সেখান থেকে পালিয়ে গেছিলাম। কিন্তু আমারে রাস্তায় পাইয়া ধইরা নিয়া গেছে দালালের লোক। আমারে ক্যাম্পে আটকায়ে রাখছে সাত দিন। মারছে অনেক, হাত দিয়া মারছে কান বরাবর। সেখান থেকে বাড়িতে ফোন কইরা বাকি টাকার জন্য বলছি। এদিক-সেদিক জোগাড় কইরা টাকা দিছে।

অভিবাসী মহিলা শ্রমিক অ্যাসোসিয়েশনের (বোমসা) নির্বাহী পরিচালক সুমাইয়া ইসলাম মনে করেন, কেউ মরার জন্য সৌদি আরব যায় না। তাদের কোনো না কোনোভাবে মেরে ফেলা হয়। তিনি বলেন, সেখানকার কর্মপরিবেশ এবং নিয়োগকর্তারা বাধ্য করে আত্মহত্যার জন্য।

আজকেও আমি ২৫০ শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলে আসলাম। তাদের দিকে তাকালে বোঝা যায় তারা কেউ আত্মহত্যা করতে যায়নি। তারা প্রত্যেকেই স্বপ্ন নিয়ে গেছে। বেশিরভাগ আত্মহত্যার ঘটনা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে- আসলে কি মেরে ফেলে নাকি এরা আত্মহত্যাই করে।

তিনি আরও বলেন, আত্মহত্যা করার প্রবণতা আছে তবে সেটা কম। যেটা হয় সেটা কর্মপরিবেশ বাধ্য করে। সৌদি আরবে কেউ আত্মহত্যা করতে যায় না। আত্মহত্যা বা স্ট্রোক বলে চালিয়ে দেওয়া হয়। এই ধরনের ঘটনা ঘটার পর সৌদি সরকার ময়নাতদন্তে যাই লিখে দেয় তাই আমাদের বিশ্বাস করতে হয়। এই পর্যন্ত কোনও মৃতদেহের নিরপেক্ষ ময়নাতদন্ত হয়নি। সৌদি সরকার কখনও তাদের নাগরিকের বিপক্ষে অবস্থান নেবে না। আর যদি আত্মহত্যা করেই থাকে সেই শাস্তি নিয়োগকর্তা আর রিক্রুটিং এজেন্সির পাওয়া উচিত। কারণ গ্রামের সহজ সরল মানুষগুলো যাচ্ছে সে দেশে। তাদের তো আত্মহত্যা করার উপায়গুলো জানার কথা না।

এ বিষয়ে ব্র্যাক মাইগ্রেশনের প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, নারীকর্মীদের আত্মহত্যার পেছনে নির্যাতন একটি কারণ হতে পারে। হয়তো এমন কোনও পরিস্থিতিতে তিনি পড়েছিলেন যে তার ধারণা এরপর আর বেঁচে থেকে লাভ নেই। কারণ সেই পরিস্থিতি তিনি মেনে নিতে পারেননি। ৪৪টি মেয়ের আত্মহত্যার ঘটনা খুবই উদ্বেগজনক। গরীব মানুষ কিন্তু খুব সহজে আত্মহত্যা করতে চায় না। চূড়ান্ত পর্যায়ে না গেলে তারা এই পর্যায়ে আসে না।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!