• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

তৃণমূলের চাপে আন্দোলনের কৌশল খুঁজছে বিরোধী জোট


বিশেষ প্রতিনিধি এপ্রিল ১১, ২০১৯, ০৬:৪৭ পিএম
তৃণমূলের চাপে আন্দোলনের কৌশল খুঁজছে বিরোধী জোট

ঢাকা : গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও কারাবন্দি খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে অব্যাহতভাবে তৃণমূলের চাপ বাড়ছে বিরোধী জোট নেতাদের ওপর। পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে শীর্ষ নেতারাও খুঁজছেন আন্দোলনের কৌশল। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ইস্যুতে ২০দলীয় জোটের পাশাপাশি জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনে জোর দিয়েছিল বিএনপি।

দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক অবস্থান থেকে সরে এসে দলটি একাদশ জাতীয় নির্বাচনে গিয়েছিল আন্দোলনের অংশ হিসেবে। বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনের হাতেই দিয়েছিল নেতৃত্বের ব্যাটন। বড় ধরনের ছাড় দিয়ে একাদশ জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিলেও চরম আশাহত হয়েছে দলটি। উল্টো তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার মধ্যদিয়ে নতুন কৌশলে আরেকটি জাতীয় নির্বাচন সম্পন্ন করেছে সরকার। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে সুষ্ঠু নির্বাচন ও কারাবন্দি খালেদা জিয়ার মুক্তির কোনো দাবিই আদায় করতে না পেরে নির্বাচনের পরপরই নতুন করে সবকিছু ভাবতে শুরু করে বিএনপি।

দলের শীর্ষ নেতাদের ওপর ব্যাপক ক্ষোভ-বিক্ষোভ তৈরি হয় তৃণমূল নেতাকর্মীদের।

নির্বাচনের দুই মাস পর জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট আয়োজিত গণশুনানীতে কিছুটা প্রকাশ ঘটে সে ক্ষোভের। তারই ধারাবাহিকতায় পরবর্তী বিভিন্ন সভায় জোরালো হয়ে উঠে আন্দোলনের দাবি। বিশেষ করে কারাগারে খালেদা জিয়ার শারীরিক পরিস্থিতির অবনতি, সবার দাবি অগ্রাহ্য করে তাকে সরকারি হাসপাতালে স্থানান্তর ও কেরানীগঞ্জের কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থানান্তরের গুঞ্জন আন্দোলনের দাবিকে করে তুলেছে জোরালো।

দল, জোট ও ফ্রন্টের সিনিয়র নেতাদের কাছে সরাসরি জবাবদিহি চাইতে শুরু করেছে তৃণমূল নেতারা। এমন পরিস্থিতিতে ফের আন্দোলনের পথে হাঁটার কথা ভাবছে বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম। সম্প্রতি একাধিক সভায় সিনিয়র নেতারাই প্রকাশ করেছেন তাদের আন্দোলনমুখী অবস্থানের কথা।

এদিকে খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল কর্মসূচি পালন করেছে বিএনপি, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দল। ৪ঠা এপ্রিল বাংলাদেশে নিযুক্ত বিদেশী কূটনীতিকদের কাছে খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা নিয়ে ব্রিফ করেছে বিএনপি।

দলটির দায়িত্বশীল কয়েকজন নেতা জানান, নীতিনির্ধারকসহ জোটের শীর্ষ নেতারা উপলব্ধি করছেন সার্বিক পরিস্থিতিতে বিএনপি তথা বিরোধী জোটকে শেষ পর্যন্ত আন্দোলনের পথেই হাঁটতে হবে। দেশবাসীর কাছে গ্রহণযোগ্য সুনির্দিষ্ট কর্মসূচির মাধ্যমে এগিয়ে নেয়া হবে সে আন্দোলন। তাই আপাতত জনসচেতনতা ও জনসমর্থণ সৃষ্টিকারী কর্মসূচি ও কৌশলের কথা ভাবছেন বিএনপিসহ জোট ও ফ্রন্টের নেতারা।

কারাগারে নেয়ার পর অসুস্থ খালেদা জিয়াকে একটি বিশেষায়িত হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়ার দাবি করে আসছে বিএনপি। এ নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর সঙ্গে দুই দফা সাক্ষাতও করেছেন নেতারা। জোট এবং ঐক্যফ্রন্টের মঞ্চ থেকেও এ দাবি তোলা হয়েছে বারবার। কিন্তু প্রতিবারই অগ্রাহ্য করেছে সরকার।

সম্প্রতি কারাগারে তার শারীরিক পরিস্থিতির বড় ধরনের অবনতি হলে তাকে স্থানান্তর করা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে। বিএনপি নেতারা জামিনে মুক্তির দাবি জানালেও সম্প্রতি প্যারোলে মুক্তির বিষয়টি সামনে আসে সরকারি দলের এক নেতার মুখ দিয়ে। সাড়া দেয়নি বিএনপি। দলটির নেতারা বলছেন, খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টি এখন সরকারের ইচ্ছা ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়। তাই আন্দোলনের মাধ্যমে তার মুক্তির দাবিটি আদায় করার কোন বিকল্প নেই।     

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কারামুক্তির দাবিতে রোববার গণঅনশন কর্মসূচি পালন করেছে বিএনপি। গণঅনশনে সভাপতির বক্তব্যে বিএনপি মহাসচিব ও ঐক্যফ্রন্টের মুখপাত্র মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন- ‘ দেশ, গণতন্ত্র, মানুষ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বাঁচাতে হলে খালেদা জিয়াকে বাইরে আনতে হবে। যেকোনো মূল্যে দেশনেত্রী খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে হবে। সেজন্য আমাদের আন্দোলন শুরু করতে হবে। আসুন আমরা সবাই এই লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ হই এবং জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করার মাধ্যমে আন্দোলনের প্রস্তুতি নিই।’ সে কর্মসূচিতে সংহতি প্রকাশ করেছেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সিনিয়র নেতারা। কেবল সংহতি প্রকাশ করেই তারা সীমাবদ্ধ থাকেননি।

গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে আন্দোলন যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে সে আন্দোলনে তারা সক্রিয়ভাবে ভূমিকা রাখার ঘোষণাও দিয়েছেন। কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম বলেন- ‘আমি জানি, এ গণঅনশনে কী হবে। যদি পারেন এক হয়ে রাস্তায় নামেন। রাস্তায় নামলে দু-চারটা মামলা হবে। তাতে কী যায় আসে। দেশটাই তো পরিণত হয়েছে একটি কারাগারে। এখন ধীরে ধীরে অবরোধ শুরু করেন।’

ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম শীর্ষ নেতা জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রব বলেন- ‘ঘরের মধ্যে খালেদা জিয়ার মুক্তি দাবি জানাতে চাই না। এখানে এক হাজার একশ লোক জীবন দিলেও তার মুক্তি হবে না। এখন শুধু স্লোগান দিলে হবে না, সারাদেশে ছড়িয়ে পড়তে হবে। ১৪ মাস হয়ে গেল খালেদা জিয়া কারাগারে। তার মুক্তিতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে মাঠে নামতে হবে। খালেদা জিয়ার মুক্তি মানে গণতন্ত্রের মুক্তি।’

ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম শীর্ষ নেতা নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন- ‘ড. কামাল হোসেন, আসম আবদুর রব, মোস্তফা মহসিন মন্টুসহ আমরা সবাই এক আছি। ভুল বুঝবার কোনো কারণ নেই। আমাদের সাত দফার প্রথম দাবি হলো বেগম জিয়ার মুক্তি। কিন্তু খালেদা জিয়ার মুক্তি পেলে সরকার বাইরে থাকতে পারবে না তাই সহজে তাকে মুক্তি দেবে না। এ অবস্থায় রাজপথের কর্মসূচি দিতে হবে।

খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে এক সঙ্গে লড়বো। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট পাশে থাকবে।’ গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন- ‘পুলিশের অনুমতি নিয়ে নয়, রাস্তায় কীভাবে নামতে হবে সেই চিন্তা করতে হবে। তবে সেটা রাস্তা দখল করে নয়, আমরা ফুটপাত দখল করতে পারি।’

এ সময় তারা খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তির বিরোধীতা করে জামিনে মুক্তির দাবি জানান।

সম্প্রতি জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে কৃষক দল আয়োজিত মানববন্ধন কর্মসূচিতে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেছেন- ‘আন্দোলন করেই সব দাবি আদায় করতে হবে। কিছু আদায় করতে হলে কিছু করতে হবে। আর কিছু করতে গেলে কিছু ত্যাগ করতে হবে, প্রয়োজনবোধে মরতেও হবে।’ এভাবে বিএনপির সিনিয়র নেতাদের অনেকই বিগত দুই সপ্তাহে তাদের দেয়া বক্তব্যে আন্দোলনমুখী মনোভাবের কথা প্রকাশ করেন।  

জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রথম থেকেই প্রশ্ন ছিল বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলের। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের মাধ্যমে ২০ দলকে গুরুত্বহীন করা হচ্ছে এমন একটি অভিযোগ ছিল শরিকদের। বিশেষ করে ২০দলের দ্বিতীয় প্রধান শরিক জামায়াতকে নিয়েই ছিল মূল টানাপড়েন। কিন্তু নির্বাচনে জামায়াতের অংশগ্রহণে আপত্তি করেনি ফ্রন্টের নেতারা। প্রার্থী চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রেও ২০দলের শরিকরাই প্রাধান্য পেয়েছেন। যার প্রেক্ষিতে দূরত্ব কমে এসেছে ২০দল ও ঐক্যফ্রন্টের। নির্বাচনের তিন মাস পর সোমবার রাতে প্রথমবারের মতো বৈঠক করে ২০ দল। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার গুলশান রাজনৈতিক কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত দেড়ঘণ্টাব্যাপী সে বৈঠকেও আলোচনার প্রধান এজেন্ডা ছিল আন্দোলন কৌশল।

বৈঠক শেষে সংবাদ ব্রিফিংয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও জোটের সমন্বয়ক নজরুল ইসলাম খান বলেছেন, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলের মধ্যে কোন বিভেদ নেই। খালেদা জিয়ার মুক্তিকে তারা গণতন্ত্রের মুক্তি হিসেবে বিবেচনা করছেন। তাই গণতন্ত্র রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ২০দল। খালেদা জিয়ার মুক্তিতে ২০দল-ঐক্যফ্রন্ট যুগপৎ আন্দোলন করবে। ২০দল জোটভুক্ত দলগুলো নিজ নিজ দলের হয়ে ও জোটভুক্ত বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করবে। তবে কর্মসূচির ধরন কি হবে তা নিয়ে জোট নেতাদের কাছে মতামত চেয়েছে বিএনপি।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!