• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

‘তোমরা আমাকে খুঁজো না, আমিই তোমাদের খুঁজে নেব’


এস এম মুকুল জুলাই ১৮, ২০১৯, ০৫:২৬ পিএম
‘তোমরা আমাকে খুঁজো না, আমিই তোমাদের খুঁজে নেব’

ঢাকা : ম্যান্ডেলাকে বলা হয় মাস্টার কমিউনিকেটর। কারণ দেহের ভাষা থেকে শুরু করে সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানেও সিদ্ধহস্ত ম্যান্ডেলা কারাবন্দি থেকেও অনুসারীদের সঙ্গে আদর্শগত যোগাযোগ ঠিকই বজায় রেখেছেন।

তিনি এমনই একজন নেতা, যিনি ১৯৬৪ সালে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হওয়ার পর সারা বিশ্বে বর্ণবাদবিরোধী লড়াইয়ের প্রতীক হয়ে ওঠেন। ২৭ বছর কারাগারে অন্তরীণ থেকেও বর্ণবাদ আন্দোলনের প্রাণ হারাতে দেননি। অসীম ধৈর্য আর অপেক্ষায় মুক্তির রূপরেখা এঁকেছেন জেলখানায় বসে।

স্বাধীনতার স্বাদ পেয়ে, ক্ষমতার অধরা শক্তি হাতের মুঠোয় পেয়েও এককালের নির্যাতনকারীদের বিরুদ্ধে গেলেন না। প্রতিশোধ নিলেন না। সবাইকে একসঙ্গে নিয়ে কাজ করলেন। রাষ্ট্র পরিচালনা করলেন দক্ষতার সঙ্গে। দেশটির অর্থনৈতিক আদল পরিবর্তনে ভূমিকা রাখলেন। রাজনীতিবিদদের জন্য ম্যান্ডেলা যে শিক্ষাটি দিয়েছেন তা হলো- দেশকে বিভক্ত রাখা নয়, তাকে ঐক্যবদ্ধ করাই সফল রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রমাণ। তারপর ১৯৯৯ সালে ক্ষমতায় পুনঃপ্রতিষ্ঠার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সরে দাঁড়ালেন। ঘুরে বেড়ালেন, বিশ্বনেতাদের সঙ্গে বিনিময় করলেন তার রাজনৈতিক দর্শন আর আদর্শের মূলমন্ত্র।

এরপর ২০০৪ সালে লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যাওয়ার ঘোষণা দিলেন। আর দুনিয়ার মানুষের উদ্দেশে বললেন— ‘তোমরা আমাকে খুঁজো না, আমিই তোমাদের খুঁজে নেব।’ এই হলো কালো মানুষের নেতা, বঞ্চিত-শোষিত মানুষের নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা। পৃথিবীর সাতশ কোটি মানুষের মধ্যে তিনি একজনই ম্যান্ডেলা।

বৈচিত্র্য, বৈপরীত্যের মধ্যে ঐক্য স্থাপনে অসাধারণ নেতৃত্বের অনুপম উদাহরণ সৃষ্টি করে গেছেন তিনি। রাষ্ট্রক্ষমতার মোহ, জনপ্রিয়তার দাপট এবং দলের নেতৃত্ব থেকে কীভাবে দূরে সরে যেতে হয়, বিশ্ব রাজনীতিবিদদের সে শিক্ষার পথ দেখিয়েছেন তিনি। অসাধারণ্যে সাধারণ, নিপীড়নে স্থিরতা, বাধায় সংযম ও ধৈর্য ধারণের ক্ষেত্রে তিনি অনন্যসাধারণ ব্যক্তিত্ব।

নেতা নন মানুষ, মানুষ নন সেবক— তার এই জীবন-দর্শন আজ বিশ্বে অনুসরণীয়। বহুমাত্রিক গুণের এই অনন্যসাধারণ নেতাকে মহাত্মা গান্ধী, মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র বা আব্রাহাম লিংকনের সঙ্গে তুলনা তো করাই যায়। দক্ষিণ আফ্রিকার শাসকগোষ্ঠীর অত্যাচার নির্যাতনের বিপক্ষে প্রতিবাদের মাধ্যমে আলোচনায় আসেন মাদিবা।

কালো মানুষের সমঅধিকারের পক্ষে, বর্ণবাদের বিপক্ষে ক্রমাগত আন্দোলনের মাধ্যমে প্রতিবাদী কণ্ঠের প্রতীকী নাম পুরুষ নেলসন ম্যান্ডেলা। বর্ণবাদের বিপক্ষে আন্দোলনের কারণে ২৭ বছর কারাগারে বন্দি থেকে দুর্বিষহ জীবন কাটাতে হয় তাকে। তিনি বর্ণবাদ, মানবাধিকার আর নির্যাতনের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর- রোলিহলাহলা, মাদিবা, টাটা, খুলু, নেলসন অথবা ডালিভুঙ্গা যে নামেই ডাকা হোক না কেন, নেলসন ম্যান্ডেলা বিশ্বরাজনীতির শিক্ষাগুরুতে পরিণত হতে পেরেছেন এটাই বড় সার্থকতা।

কেউ কেউ নৈতিক আদর্শের প্রতি তার অটল অবস্থানকে আফ্রিকার সুউচ্চ পর্বত থাবানার চেয়ে দৃঢ়ত্ব হিসেবে তুলনা করেছেন। আবার রাজনৈতিক সংগ্রামে কৌশল গ্রহণের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন কোমলে আর কঠিনে মেশানো একজন অসাধারণ নেতা। তার অদম্যতা তাকে ঐতিহাসিক রিভোনিয়া ট্রায়াল ও রোবেন দ্বীপে ২৭ বছর কারা নির্যাতনের পরও নীতি থেকে সরাতে পারেনি। তাই ক্ষমতাধর আফ্রিকান সাদারা কালো ম্যান্ডেলার অদম্য-অহিংসতার কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। আর সাদাদের এই পরাজয় বর্ণবৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে পৃথিবীকে উপহার দেয় আফ্রিকার রাষ্ট্রনায়ক কালো মানিক ম্যান্ডেলাকে।

মাদিবা খ্যাত নেলসন ম্যান্ডেলা- একটি নাম, একজন মানবীয় নেতা, একজন অনন্য অসাধারণ মানুষ। বিশ্বরাজনীতির নেতৃত্বে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী এই  কালো মানুষের নেতা বঞ্চিত-শোষিত মানুষের অধিকার আদায়ে আজীবন লড়াই করে গেছেন। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ১৮ জুলাইকে ‘ম্যান্ডেলা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। বিশ্বব্যাপী স্বাধীনতার ক্ষেত্রে দক্ষিণ আফ্রিকার মহান নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার অবিস্মরণীয় অবদানের জন্য এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ১৮ জুলাই ম্যান্ডেলার জন্মদিন বলে তার স্মরণে এ দিনটি বেছে নেওয়া হয়েছে।

নেলসন ম্যান্ডেলার জন্ম ১৯১৮ সালের ১৮ জুলাই। বাবা ছিলেন ইস্টার্ন কেপ প্রদেশের থেম্বো রাজকীয় পরিবারের কাউন্সিলর। বাবা নাম রেখেছিলেন রোলিহলাহলা ডালিভুঙ্গা মানডেলা। স্কুলের এক শিক্ষক তার ইংরেজি নাম রাখলেন নেলসন। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকার আপামর মানুষের কাছে তিনি ছিলেন ‘মাদিবা’।

তরুণ বয়সে নেলসন ম্যান্ডেলা চলে আসেন জোহানেসবার্গে, সেখানে তিনি আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের যুব শাখার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে পড়েন দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনে। ম্যান্ডেলা নিজের আদর্শের প্রতি ছিলেন অবিচল আস্থাবান। দূরদর্শিতা, আত্মসংযম, একনিষ্ঠতা আর সংগ্রামের ধারাবাহিকতার মাধ্যমে তিনি নিজের জায়গা ঠিক করতেন। এ কারণে ম্যান্ডেলার নেওয়া জাতিগত সম্প্রীতির আদর্শ এখন অনেকের কাছেই অনুসরণীয় হয়ে থাকবেন। সদা বিনয়ী ম্যান্ডেলা কখনোই প্রশংসার স্রোতে গা ভাসাতেন না। ১৯৬৪ সালে পাতানো বিচার চলার সময় ম্যান্ডেলার সেই উক্তিটি রীতিমতো বাণী হয়ে থাকবে এখনো— ‘আমি শ্বেতাঙ্গদের আধিপত্যের বিরুদ্ধে যেভাবে লড়েছি, কালোদের আধিপত্যের বিরুদ্ধেও একইভাবে লড়েছি।’

তার আত্মজীবনীমূলক ‘লং ওয়াক টু ফ্রিডম’ বইয়ে এই স্বগতোক্তি রয়েছে। এই বইটিতে তিনি বলেছেন, ‘আই অ্যাম ফান্ডামেন্টালি অ্যান অপটিমিস্ট। হোয়েদার দ্যাট কামস ফ্রম নেচার অর নার্চার, আই ক্যান নট সে। পার্ট অব বিয়িং অপটিমিস্টিক ইজ কিপিং ওয়ানস হেড পয়েন্টেড টুয়ার্ড সান, ওয়ানস ফিট মুভিং ফরওয়ার্ড। দেয়ার অয়ার মেনি ডার্ক মোমেন্টস হোয়েন মাই ফেইথ ইন হিউম্যানিটি ওয়াজ সোরলি টেস্টেড, বাট আই উড নট অ্যান্ড কুড নট গিভ মাইসেল্ফ আপ টু ডেসপেয়ার। দ্যাট ওয়ে লেইজ ডিফিট অ্যান্ড ডেথ।’

অর্থাৎ আমি মৌলিকভাবেই আশাবাদী। সেটা প্রকৃতি কিংবা পরিচর্যা থেকে পেয়েছি কিনা বলতে পারব না। আশাবাদী থাকার কারণ সূর্যের পানে মাথা তুলে সামনে পা ফেলে চলেছি। অনেক কালো মুহূর্ত আছে যেখানে মানবতার জন্য আমার বিশ্বাস আঘাতে পরীক্ষিত, কিন্তু কখনোই নিরাশায় হারিয়ে যায়নি। কেননা তাতে পরাজয় ও মৃত্যু অনিবার্য।

রোবেন দ্বীপের কারাগারে বিশ্বনেতা ম্যান্ডেলা ১৮ বছর পার করেছেন নামে নয়— ৪৬৬৬৪ এই কয়েদি নম্বরের পরিচয়ে। সাত ফুট বাই দশ ফুটের গুমোট ঘরটিই ছিল এই মহান নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার ১৮ বছরের ঠিকানা। ঘরটি এতটাই ছোট ছিল যে, সেখানে হাঁটাচলাই ছিল অসম্ভব। মুক্তির পরে কারাগারের স্মৃতিবিজড়িত দিনগুলোর গল্প বলতে গিয়ে নেলসন ম্যান্ডেলা প্রায়ই ঠাট্টা করে বলতেন, ‘কারাগারে আমার ঘরটা এমন ছোট ছিল যে তিন পা যেতে না যেতেই দেয়ালে ধাক্কা খেতে হতো।’

কয়েদি নম্বর ৪৬৬৬৪। ঠিকানা রোবেন দ্বীপ কারাগার। কেপটাউন শহর থেকে নদীপথে ২০ মিনিটের দূরত্ব। সেখানে জগদ্বিখ্যাত বন্দির কয়েদখানা এখন দেশ-বিদেশের পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণীয় ও দর্শনীয় স্থান। সেই কয়েদখানাকে ১৯৯৭ সালে হেরিটেজ সাইট হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। জেলে বন্দি কয়েদিরাই আগত পর্যটকদের জেলখানায় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখান একজন সাবেক প্রেসিডেন্ট নেলসন ম্যান্ডেলার জেলবন্দি জীবনের স্মৃতি। সেই হালকা সবুজ দেয়ালের ছোট্ট খুপরি ঘরটি এখনো আছে সেরকমই।

সেখানে আছে ম্যান্ডেলার ব্যবহার করা কম্বল, কাঠের টুল, বালতি, কাপ আর অ্যালুমিনিয়াম প্লেট। নির্যাতন, আন্দোলন, কারারুদ্ধতা, মুক্তি, ক্ষমতায়ন, সম্প্রীতির দেশ গঠন, ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ানো, জনগণের আড়ালে যাওয়ার মাঝ দিয়ে বিশ্বরাজনীতির প্রবাদ পুরুষ হয়ে ওঠা মানুষটি দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে পরলোকে চলে যান ২০১৩ সালের ৫ ডিসেম্বর। ১০ ডিসেম্বর বিশ্বনেতারা এই মহান শিক্ষাগুরুকে সম্মান জানাতে একত্র হন এবং ১৫ ডিসেম্বর জন্মস্থান কুনু গ্রামে সমাহিত হয়ে ইতিহাসের পাতায় স্থায়ী ঠিকানায় আসীন হন।

ম্যান্ডেলা খাপছাড়া চিন্তা করতেন না। সফল হোক বা না হোক, পরিকল্পনাগুলো লিখে রাখতেন। তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ছিল সুসংগঠিত। দক্ষিণ আফ্রিকার শাসকগোষ্ঠীর অত্যাচার নির্যাতনের বিপক্ষে প্রতিবাদের মাধ্যমে আলোচনায় আসেন মাদিবা খ্যাত ম্যান্ডেলা। কালো মানুষদের সমঅধিকারের পক্ষে, বর্ণবাদের বিপক্ষে ক্রমাগত আন্দোলনের মাধ্যমে প্রতিবাদী কণ্ঠের প্রতীকী নামপুরুষ হয়ে ওঠেন। পরিণতি হিসেবে ২৭ বছর কারাগারে বন্দি থেকে দুর্বিষহ জীবন কাটাতে হয়। ’৬২-তে পাঁচ বছর এবং ’৬৪-তে যাবজ্জীবন।

আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, জেলে গিয়ে স্বপ্নহারা হননি ম্যান্ডেলা। কাজ করেছেন খনিতে। ইউনিভার্সিটি অব কেপটাউনের অর্থনীতিবিদ মারে লিব্র্যান্ডটের বিশ্লেষণ— আফ্রিকায় কালোদের অধিকার প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি চাকরির বাজারে কর্মসংস্থানের সমান সুযোগ তৈরি করার ফলে ১৯৯৩ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত আফ্রিকানদের গড় আয় বেড়েছে ৯৩ শতাংশ। বেড়েছে শিক্ষার সুযোগও। ঠিক একই সময়ে প্রতিবেশীদের জন্য দক্ষিণ আফ্রিকা হয়ে ওঠে বিনিয়োগের একটি সম্ভাবনাময় ভূখণ্ড। দক্ষিণ আফ্রিকায় বিনিয়োগের প্রায় ৭০ শতাংশ হয় আঞ্চলিকভাবে। দক্ষিণ আফ্রিকার ফিনমার্ক ট্রাস্টেও তথ্যে বলা হয়- দেশটিতে থাকা অভিবাসীরা নিজ দেশে বছরে প্রায় ১০০ কোটি ডলার পাঠায়।

১৯৯৭ সাল। মার্চের ২৬ তারিখ। বাংলাদেশের স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী দিবস। বিশ শতকে মানুষের মুক্তির প্রতীক দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রপতি নেলসন ম্যান্ডেলা বাংলাদেশে এসেছিলেন। বাংলাদেশের অনেক সম্ভাবনার কথা বলে গেছেন তিনি। বলে গেছেন, ‘কিছু আন্তরিক উদ্যোগ গ্রহণ করলেই কিন্তু দেশটি পাল্টে যেতে পারে। এ জন্য দরকার স্বচ্ছতার ভিত্তিতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা। নইলে দেশ মুখ থুবড়ে পড়বে। কারণ স্বচ্ছতা না থাকলে দায়বদ্ধতাও থাকবে না।’ তখন দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়বে। তিনি জোর দিয়ে বলেছিলেন শিক্ষা-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের অধিকার নিশ্চিত করার কথাও।

লেখক : বিশ্লেষক ও উন্নয়ন গবেষক
[email protected]

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!