• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

থামছেই না বাসের রেষারেষি, দুর্ভোগের নগর গাড়ি


বিশেষ প্রতিনিধি ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০১৯, ০২:২২ পিএম
থামছেই না বাসের রেষারেষি, দুর্ভোগের নগর গাড়ি

ঢাকা : রাজধানী ঢাকায় কর্মস্থলমুখী মানুষের ভিড়কে পুঁজি করে বছরের পর বছর ধরে চলছে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় আর যাত্রীসেবা নিয়ে নৈরাজ্য। সরকারের সংশ্লিষ্টরা দফায় দফায় উদ্যোগ নিলেও কার্যত কোনো ফল পাওয়া যাচ্ছে না আইন প্রয়োগের অভাবে। গণপরিবহনের এই নৈরাজ্য নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরি করেছেন সোনালীনিউজ-এর পাঠকদের জন্য-

অতিরিক্ত ভাড়া দিতে বাধ্য করা হয় : রাজধানীর বেশিরভাগ গণপরিবহনে যাত্রীদের কাছ থেকে সিটিং বলে ভাড়া আদায় করা হয়। কিন্তু গাড়িতে যাত্রী তোলা হয় লোকালের মতোই। এত বেশি যাত্রী ওঠানো হয় যে, একে অন্যের চাপে চ্যাপটা হয়ে যেতে হয়। এসব সিটিং গাড়িতে উঠলেই রুট অনুযায়ী ন্যূনতম ভাড়া ১০, ১৫ এবং ২০ টাকা পর্যন্ত গুনতে হয়। ফলে সিটিং বলে চালানোয় আগের তুলনায় দুই থেকে তিনগুণ আয় বেশি হচ্ছে এসব বাস মালিকদের।

ফার্মগেট থেকে শিকড় কিংবা খাজাবাবা বাসে মিরপুর ১০ নম্বর পর্যন্ত ভাড়া নেওয়া হয় ১৫ টাকা। ফার্মগেট থেকে উঠে বঙ্গবন্ধু সম্মেলন কেন্দ্র আগারগাঁও কিংবা শেওড়াপাড়া যেখানেই নামা হোক না কেন ১৫ টাকাই ভাড়া দিতে হয়।

খাজাবাবা নামের একটি বাসে উঠে দেখা গেল, এক যাত্রী ফার্মগেট থেকে উঠে বঙ্গবন্ধু সম্মেলন কেন্দ্রে নামলেন। তার কাছ থেকে ১৫ টাকাই ভাড়া নেওয়া হলো। সেখান থেকে ওই সিটে আরেক যাত্রী বসলেন, তিনি যাবেন, মিরপুর-১০ নম্বরে, তার কাছ থেকেও নেওয়া হলো ১০ টাকা। সিটিং বলে ১৫ টাকার সিটটি বিক্রি হলো ২৫ টাকায়।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ওই বাসের কন্ডাক্টর বলেন, এভাবে চলে আসছে, এটা নতুন কিছু নয়। এই গাড়িতে উঠলেই ভাড়া ১০ টাকা। ফার্মগেটের পর আমাদের চেকার আছে। এটা ১৫ টাকার চেক। প্রেস ক্লাবের চেকে ১০ টাকা। ওই চেক চলে ফার্মগেট পর্যন্ত। দেখা গেল একযাত্রী উঠলেন পল্টন থেকে। তিনি নামলেন মৎস্যভবন। তার কাছ থেকে রাখা হলো ১০ টাকা। ওখান থেকে আরো যাত্রী উঠলেন। তাদের একজন বসলেন ওই সিটে। বাকিরা রয়েছেন দাঁড়িয়ে। দাঁড়িয়ে হোক আর বসে হোক ভাড়া সিটিং।

মৎস্যভবন নেমে যাওয়া ওই যাত্রীর সিটে যিনি বসলেন, তিনি নামলেন বাংলামোটর। তার কাছ থেকেও নেওয়া হলো ১০ টাকা। ওখান থেকেও কয়েকজন যাত্রী উঠলেন। তাদের মধ্যে যারা ফার্মগেট নামবেন, তাদেরও দিতে হলো ১০ টাকা। ফলে ১০ টাকার সিটটি বিক্রি হলো ৩০ টাকায়।

এদিকে গুলিস্তান থেকে চিটাগাং রোডগামী বাসে কাজলা পর্যন্ত সচরাচর ১০ টাকা ভাড়া নেওয়া হয়। রায়েরবাগ, শনির আখড়া পর্যন্ত নেওয়া হয় ১৫ টাকা। সাইনবোর্ড পর্যন্তই সরকার নির্ধারিত ভাড়া ১৩ টাকা। কিন্তু বিকালের দিকে শ্রাবণের কিছু বাস সিটিং হয়ে যায়। যেখানে নামেন ভাড়া ২৫ টাকা।

যাত্রাবাড়ী থেকে মালিবাগ পর্যন্ত তুরাগ গাড়িতে ভাড়া ১০ টাকা। আবার কমলাপুর পর্যন্ত ৮ টাকা। শফিক নামের একযাত্রী ১৪ ফেব্রুয়ারি তুরাগ বাসে যাত্রাবাড়ী থেকে কমলাপুর যাচ্ছেন। ৫ টাকা ভাড়া দিলেন। কিন্তু কন্ডাক্টর ৮ টাকা দাবি করলেন। ও

ই যাত্রী বললেন, তাহলে মালিবাগ কেমনে ১০ টাকা হয়। তাহলে তো মালিবাগ ১৫ টাকা ভাড়া হওয়া উচিত। তিনি ৮ টাকার দিকে চাইলেন না। কিন্তু কন্ডাক্টর তার সঙ্গে খুব খারাপ আচরণ করলেন। ফলে ওই যাত্রীকে ৮ টাকাই দিতে হলো। অনাবিলে যাত্রাবাড়ী থেকে মালিবাগে ১৫ টাকা দিতে হয়। আবার কাজলা থেকে যদি এমএম লাভেরিয়া বা লাব্বাইকে ওঠা হয় তাহলে ভাড়া গুনতে হয় ২৫ টাকা। এই গাড়ি ফ্লাইওভারের ওপর দিয়ে যায়।

কাজলা থেকে মোমিতা, ঠিকানা বাসে উঠলেই ২০ টাকা ভাড়া গুনতে হয়। রাজধানী মার্কেট, গুলিস্তান, চানখাঁরপুল, ঢাকা মেডিকেল যেখানেই নামুক না কেন, ভাড়া ২০ টাকা। কাজলা থেকে বেশিরভাগ গাড়িতে গুলিস্তান পর্যন্ত ভাড়া ১০ টাকা। কিন্তু রাজনীগন্ধায় ভাড়া নেওয়া হয় ২০ টাকা। অনেকেই না জেনে উঠে বিপাকে পড়েন। ১০ টাকার ভাড়া ২০ টাকা গুনতে হয়।

এ বিষয়ে কয়েকজন বাস শ্রমিকের সঙ্গে কথা হলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা বলেন, রোডে আমাদের অনেক খরচ আছে। বিভিন্ন স্থানে চাঁদা দিতে হয়। পুলিশে ধরলে তাদের টাকা দিতে হয়। অনেক সময় মামলা দিয়ে দেয়। মামলা যাতে না দেয় সে জন্য দুই-একশ টাকা তাদের হাতে গুঁজে দিই। তাদের এই বক্তব্য আসলে কতটা সঠিক তা জানার চেষ্টা করা হয়। এই প্রতিবেদক যাত্রী হিসেবে বাসে ঘুরতে গিয়ে চোখে পড়ে মৎস্য ভবন ও রামপুরা ব্রিজে দুই/একশ করে টাকা নেওয়ার দৃশ্য।

এদিকে সারা দেশের রাস্তায় চলাচল করা যাত্রীবাহী বাসের মধ্যে ৩৩ শতাংশ বাসের ফিটনেস সার্টিফিকেট নেই বলে গত ৭ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টে প্রতিবেদন দাখিল করেছে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ)।

এসব বিষয়ে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের বক্তব্য জানার চেষ্টা করে সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানের মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। এ ছাড়া ঢাকা মেট্রোপলিটন ট্রাফিক বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলার জন্য মোবাইলে কল করা হলে তিনি ব্যস্ততার কথা বলে ফোন কেটে দেন।

দুই বাসের রেষারেষি : এক বাস আরেক বাসকে চাপ দিচ্ছে। একটি আরেকটিকে উঠতে দিচ্ছে না। পেছনের বাস অতিক্রম করার চেষ্টা করছে। সামনের বাস চাপ দিচ্ছে। বাসের বডিতে ধাক্কা লাগছে। কখনো একটি বাস আরেকটি বাসের গেট আটকিয়ে দাঁড়াচ্ছে, যাতে ওই বাসে যাত্রী উঠতে না পারেন। সব সময় এমন দৃশ্য দেখা যায়। দুই বাসের এমন রেষারেষির কারণে বিভিন্ন স্টপেজ থেকে নামতে-উঠতে ঝুঁকিতে পড়তে হয় যাত্রীদের।

এই রেষারেষির কারণে কারো হাত হারাচ্ছে, কেউ পা হারাচ্ছেন, আবার কারো জীবনও যাচ্ছে। কেন রেষারেষি করেন, জানতে চাইলে কয়েকজন বাস ড্রাইভার জানান- সামনের স্টপেজে যদি আগে যেতে পারেন তাহলে সেখানে অপেক্ষায় থাকা যাত্রীদের তিনি পাবেন। শুধু সামান্য কয়েকটা টাকার জন্য তারা এমন কাজ করেন। গাড়ির কাগজ ঠিক আছে কি-না, নির্দিষ্ট স্থানে দাঁড়াল কি-না- এসব নিয়ে বিভিন্ন সময়ে মামলা হলেও অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়ার ব্যাপারে কোনো মামলা হয় না।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, দুই বাসের রেষারেষি বন্ধ করতে হলে আইনের কঠোরতম প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে কোনোভাবেই বন্ধ করা যাবে না।

এছাড়া বাসে আরো কিছু সমস্যা রয়েছে। যেমন- সিট-গাড়ির গ্লাস ভাঙা। বসতে অসুবিধা হয়। ধুলো আসে। ফ্যান নেই। অনেক গাড়িতে থাকলেও তার বেশিরভাগই নষ্ট। ভাঙা সিট থেকে বেরিয়ে থাকা লোহায় খোঁচা খেতে হয়। অনেকের জামা-কাপড় ছেঁড়ে।

নামেই নারী আসন : রাজধানীর কোনো কোনো গণপরিবহনে নারী, শিশু, বৃদ্ধ ও প্রতিবন্ধীদের জন্য ৯টি আবার কোনো কোনো গাড়িতে ৬টি আসন বরাদ্দ কাগজে-কলমে থাকলেও, বাস্তবে সেসব আসনে নারীদের জায়গা হয় না।

অধিকাংশ বাসে আগে এলে আগে পাবেন এই রীতি প্রচলিত। একজন পুরুষ বসলে আর নির্ধারিত স্থানে না যাওয়া পর্যন্ত ওই আসন ছাড়তে চান না কেউ। ফলে পরে যে নারীরা ওঠেন তাদের কষ্ট করে দাঁড়িয়ে যেতে হয়। অনেক সময় কেউ কেউ আসন ছেড়ে দেন। তবে এ সংখ্যা খুবই কম।

বাসের হেলপার কন্ডাক্টরও বসে থাকা পুরুষদের নারী আসন ছেড়ে দেওয়ার জন্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাগিদ দেন না। দু-একটা বাসে কখনো কখনো তাগিদ দিতে দেখা গেছে।

কয়েকদিন আগে তুরাগ গাড়িতে বাসাবো থেকে দুজন নারী উঠেছেন। তাদের নির্ধারিত আসনে পুরুষ বসে আছে। তারাও আসন ছাড়তে বলছেন না, যারা বসে আছেন তারাও ছাড়ছেন না, আর বাসের হেলপার বা কন্ডাক্টরও বলছেন না। পরে এ প্রতিবেদক কন্ডাক্টরকে বললেও কোনো সুরাহা হয়নি। প্রতিবেদক নির্ধারিত আসন ছেড়ে পেছনের দিকে একটি আসনে বসা ছিলেন, তিনি ডেকে একজনকে বসতে দিলেন। তা দেখে পেছনের আরেকজন আসন ছেড়ে আরেক নারীকে বসতে দিলেন। কিন্তু সামনে থেকে কেউ উঠলেনই না।

অনেক সময় বাসের হেলপার নারী আসন নেই বলে নারীদের বাসে তোলেন না। কিন্তু দেখা যায়, নারী আসনে পুরুষ বসে আছে বলেই নারী যাত্রী তুললেন না।

এ বিষয়েও অনেকে মনে করেন, সচেতনতা বাড়ানো দরকার। দরকার মানসিকতার পরিবর্তন। এ ছাড়া আইনের যথাযথ প্রয়োগ। নারী আসনে পুরুষ বসা থাকলে আর নারী ওই গাড়িতে দাঁড়িয়ে থাকলে, বসে থাকা পুরুষ এবং বাসের হেলপার কন্ডাক্টরের এ ব্যাপারে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।

মানবাধিকার আইনজীবী সালমা আলী বলেন, নারীকে ঘরে, সমাজের, রাজনৈতিকভাবে সব জায়গায় সম্মান করতে হবে। ঘর থেকে শুরু করে রাস্তাঘাটে, কর্মস্থলে সব জায়গা নারীবান্ধব পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। পুরুষদের মানসিকতায় পরিবর্তন আনতে হবে।

পরিবার থেকেই এসবের প্রভাব পড়ে। তিনি মনে করেন, যে পরিবারে নারীকে সম্মান করা হয়। সেই পরিবারের সদস্যরাও নারীদের সম্মান করে। তাই পারিবারিক শিক্ষা, মূল্যবোধ, পরিবারে নারীর অবস্থান, এসব বিষয় পরিবার থেকে দেখে বাইরে তার প্রতিফলন ঘটানো হয়।

তিনি বলেন, যারা নারী আসনে বসেন তারা কোনো না কোনোভাবে নিজেকে প্রভাবশালী মনে করেন। মনে করেন আমি বসব, বসলে কী হবে? বা তিনি দেখে আসছেন, তার পরিবারে নারীকে ওই ভাবেই হেয় করে দেখা হয়। হ্যাঁ, তারা নারীর আসনে বসুক। নারী এলে ছেড়ে দিক। কিন্তু না। তা তো ছাড়ছেন না।

আর বাসের ড্রাইভার-হেলপাররাও কখনো নারীর আসন ছেড়ে দেওয়ার জন্য বার্গেনিং করে না। তারাও নারীদের হয়রানি করে।

বিভিন্ন সময়ে দেখা গেছে, নারীর শ্লীলতাহানির সঙ্গে ড্রাইভার, কন্ডাক্টর, হেলপার জড়িত। এ ছাড়া আমি বলব, সবাইকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। সব দফতরের সমন্বয়ে মনিটরিং এবং শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।

চেকারের দোহাই : দেখা গেছে, আগে দু-একটি বিশেষ পরিবহনে চেকারের সিস্টেম থাকলেও বর্তমানে বাস মালিকরা অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের কৌশল হিসেবে বিভিন্ন স্টপেজে চেকার বসিয়েছেন। এখান থেকে ওখানে এত টাকা বেশির ভাগ গণপরিবহন সিটিং বলে চালানোয় আগের লোকালের তুলনায় দুই থেকে তিনগুণ বেশি আয় করছে।

কোনো গাড়িতেই ভাড়ার কোনো চার্ট নেই। বেশির ভাগ যাত্রীই জানেন না কোথায় কত ভাড়া। যা-ই চাওয়া হয়, তা-ই দিতে বাধ্য করা হয়। সব বাসেই চেকারের দোহাই। দু-একজন যাত্রী প্রতিবাদ করতে গেলেও হতে হয় অপমান। অনেক সময় শিক্ষার্থীদের সঙ্গেও তর্তাতর্কি শুরু হয়।

যখনই শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ করেন, তখন দেখা গেছে কন্ডাক্টর বলেন, এ গাড়ির কোনো হাফ ভাড়া নেই বা চেকার লেখেনি। তাই হাফ ভাড়া হবে না। এখন পুরো ভাড়া দেন পরে যখন উঠবেন, চেকার এলে স্টুডেন্ট বলে হাফ কাটিয়ে নিয়েন।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!