ঢাকা : মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে গৃহযুদ্ধ, ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে কাশ্মীর নিয়ে চলমান রাজনৈতিক উত্তেজনা এবং ইরান সংকট নিয়ে পুরো বিশ্ব বর্তমানে এক কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে সময় পার করছে।
এসব কিছুর মধ্যে যেন নতুন মাত্রা যোগ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের বাণিজ্যযুদ্ধ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সম্ভবত সবচেয়ে বড় বাণিজ্যযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে এই দুই পরাশক্তিধর দেশ। উভয় রাষ্ট্র্র সবকিছুতেই স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার কারণে কেউ কাউকে কোনো ব্যাপারে ছাড় দিতে রাজি নয়।
চীন বিশ্ব বাণিজ্য বাজারে নতুন করে জায়গা ধরার জন্য নানা কৌশল অবলম্বন করছে। কয়েক বছর থেকে দক্ষিণ এশিয়ায় তারা একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করছে প্রতিটি ক্ষেত্রেই। কিন্তু তা যুক্তরাষ্ট্রের চক্ষুশূল হওয়ার কারণে প্রতিনিয়ত নানা ঝামেলার শিকার হতে হচ্ছে। এজন্য যুক্তরাষ্ট্র্র তাদের থামানোর জন্য একের পর এক নিষেধাজ্ঞা দিতে ব্যস্ত।
কিন্তু চীনকে পিছু হটতে দেখা যায়নি। তারাও শক্তি প্রদর্শন করে যাচ্ছে কৌশলগতভাবে, যা দিনে দিনে অত্যন্ত উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য। এর নেতিবাচক প্রভাব এখন পুরো বিশ্ববাজারে পড়তে শুরু করেছে।
বিগত বছরগুলোতে চীনের ধারাবাহিক সাফল্য পশ্চিমা দেশগুলোর জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন তারা চীনকে নিজেদের জন্য হুমকি হিসেবে মনে করছে। তথ্যপ্রযুক্তির পাশাপাশি তারা সামরিক শক্তির দিক দিয়েও অনেক দূর এগিয়েছে। প্রশান্ত মহাসাগরে নিজেদের অবস্থান বাড়িয়েছে চোখে পড়ার মতো। এছাড়া তাদের তৈরি করা নৌ-যুদ্ধজাহাজগুলো অত্যন্ত আধুনিক সমরসজ্জায় সজ্জিত যা অনেকটাই পশ্চিমা যুদ্ধজাহাজগুলোর কাছাকাছি।
এদিকে সি জিন পিং একটা মেগা প্রজেক্ট হাতে নিয়েছেন যা ২০২৫ সালের মধ্যে বাস্তবায়ন করার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। প্রজেক্টটি হচ্ছে মেড ইন চায়না ২০২৫। এই প্রকল্প সফল হলে তারা নিজেদের লক্ষ্য পূরণে আরো কয়েক ধাপ এগিয়ে যাবে। সেইসঙ্গে পিছিয়ে পড়বে এই উপমহাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতির গতিধারা। বারাক ওবামা এই উপমহাদেশের রাজনীতিতে যতটা মনোযোগী ছিলেন ট্রাম্প প্রশাসন ঠিক ততটাই যেন উদাসীন। তবে বর্তমানে তাইওয়ানকে কেন্দ্র করে ট্রাম্প প্রশাসন আবারো যেন তাদের রাজনীতির গতিধারা পরিবর্তন করতে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র্র বুঝে গেছে চীনকে দমন করতে তাইওয়ান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
এজন্য চীনকে দমন করতে যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানকেই সবচেয়ে বেটার অপশন হিসেবে গ্রহণ করছে। তাইওয়ান বহুদিন থেকেই বলে আসছে তারা চীনের সঙ্গে থাকতে চায় না। নিজেরা সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে আত্মপ্রকাশ করতে চায়। চীনও এত সহজে তাইওয়ানকে হাতছাড়া করতে চাইবে না। চীনের মনোযোগটাও তাই এখন এখানেই বেশি হওয়াটা স্বাভাবিক।
কারণ তারাও মনে করে তাদের ভূ-রাজনৈতিক দুর্বলতা একমাত্র তাইওয়ান। আর তাই যুক্তরাষ্ট্র অন্তত তাইওয়ানে যেন অস্ত্র চালানসহ কোনো অপকৌশল প্রয়োগ করতে না পারে, সেজন্য চীন যুক্তরাষ্ট্রের হানিওয়েল ও গালফস্ট্রিম অস্ত্র ব্যবসায়ী কোম্পানি দুটিকে ইতোমধ্যে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে।
এদিকে বিবিসির এক প্রতিবেদনে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বেলফার সেন্টারের অধ্যাপক গ্রাহাম এলিসন বলেছেন, একটি উঠতি শক্তির প্রতিষ্ঠিত কোনো শক্তির জন্য হুমকি হয়ে ওঠার বিষয়টিকে বলা হয় ‘থুকিডাইডিসের ফাঁদ’। থুকিডাইডিস ছিলেন এথেন্স ও স্পার্টার মধ্যে হওয়া পেলোপনেসিয়ান যুদ্ধের সময়কার একজন ইতিহাসবিদ।
তবে সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, দীর্ঘ ৫০০ বছরের ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ১৬ বার এমন ঘটনা ঘটলে ১২ বারই সেটা যুদ্ধে রূপ নিয়েছে সেই প্রতিষ্ঠিত এবং উঠতি রাষ্ট্রের মধ্যে। তাই চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের এই বৈরী মনোভাব শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে থামে তা দেখতে হলে আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। অবশ্য চীন আধুনিক বিশ্বের প্রযুক্তির নেতা হওয়ার দৌড়ে পিছিয়ে নেই, বরং বেশ খানিকটা এগিয়ে আছে অন্যান্য রাষ্ট্রের তুলনায়। সেই প্রমাণ তারা রীতিমতো দিয়ে যাচ্ছে। যার ফলস্বরূপ চীন ও যুক্তরাষ্ট্র— এ দুটি রাষ্ট্র এখন মুখোমুখি অবস্থান করছে।
অনেকেই আশঙ্কা করছেন, এই দুই পরাশক্তির মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধ হতে পারে। তবে বেশকিছু কারণে যুক্তরাষ্ট্র এখন চীনকে অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছে। তার মধ্যে অন্যতম হলো— গত বছরের ডিসেম্বর মাসে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে যে সাইবার হামলা হয়েছিল তার জন্য তারা চীনকে অভিযুক্ত করেছিল।
এছাড়া তাদের টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি নেটওয়ার্ক হুয়াওয়ের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ আবার নতুন করে সবকিছু ভাবাচ্ছে পুরো বিশ্বকে। যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বাস, এই কোম্পানি ইরানের কাছে তাদের সামরিক, বেসামরিক এবং বাণিজ্যবিষয়ক তথ্য পাচার করছে। সে কারণে এটি তাদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি। তাই জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হুয়াওয়ের প্রধান অর্থনৈতিক কর্মকর্তা মেং ওয়াংজু কানাডায় আটক হন। এর ফলে উত্তেজনাও ছড়িয়ে পড়ে। উভয় দেশই বিষয়টি এখন কূটনৈতিকভাবেই সমাধান করার চেষ্টা চালাচ্ছে।
উল্লেখ্য, ২২ মার্চ ২০১৮ ট্রাম্প প্রশাসন চীনের ৫০ বিলিয়ন সমমূল্যের আমদানি পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপ করে। তার পাল্টা জবাব হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা ১২৮টি পণ্যের ওপর ২০% শুল্ক আরোপ করে চীন। ঘটনা এখানেই থেমে থাকেনি। তারপর যুক্তরাষ্ট্র আবার ৫০০০ কোটি ডলার মূল্যের চীনা পণ্যের ওপর ২৫% শুল্ক আরোপ করে।
চীনকে বিভিন্নভাবে দমিয়ে রাখার চেষ্টা অব্যাহত রাখলেও সেটা উপেক্ষা করে চীন এবং আবারো ৫১৫টি যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের ওপর ২৫% শুল্ক আরোপ করে। একের পর এক পাল্টা প্রতিক্রিয়া চলছেই তো চলছে। এখন তাইওয়ানকে কেন্দ্র করে উভয় দেশের মধ্যে আরো ঘোলাটে পরিস্থিতি আবর্তিত হচ্ছে।
ইতিহাস বলে, গত ঊনবিংশ শতাব্দীর একদম শেষ দিকে জার্মানি সরাসরি ব্রিটেনকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিল। ঠিক তেমনি চীনও যেন জার্মানির দেখানো পথেই হাঁটছে। ফলে দিনে দিনে তারা প্রছন্নভাবে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য হুমকি হয়ে উঠছে। এভাবে চলতে থাকলে প্রযুক্তির নেতার আসনে চীনও বড় অংশীদার হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রও তা খুব সহজে মেনে নেবে তা মনে হয় না।
তারাও তাদের সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করে চীনকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করবে, এটাই স্বাভাবিক। প্রয়োজনে তার মিত্র দেশগুলোর সহযোগিতাকে পুঁজি করে চীনের ওপর চাপ অব্যাহত রাখবে। এই সংকটময় পরিস্থিতি উভয় রাষ্ট্র কীভাবে মোকাবিলা করে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের পরিচয় দেয় তা দেখার জন্য আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।
লেখক : শিক্ষার্থী, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর
*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।
আপনার মতামত লিখুন :