• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

দখল ও ঋণ কেলেঙ্কারীতে আলোচনায় ছিল ব্যাংক খাত


শেখ আবু তালেব, জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক জানুয়ারি ১৪, ২০১৮, ০২:৩৫ পিএম
দখল ও ঋণ কেলেঙ্কারীতে আলোচনায় ছিল ব্যাংক খাত

ঢাকা: অর্থনৈতিক উন্নয়নের মহা উৎসবের প্রতীকে পরিণত হয় পদ্মা সেতুর প্রথম স্পান। নদীর বুকে দৃশ্যমান স্পান বলে দেয় উন্নয়নের মহাসড়কে হাঁটছে বাংলাদেশ। কিন্তু সরকারের অর্থনৈতিক উন্নয়নের এ সাফল্যকে অনেকটা ম্লান করে দিয়েছে বিদায়ী বছর ২০১৭ সালে ঘটে যাওয়া ব্যাংক খাতের নিত্য নতুন কেলেঙ্কারী। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিটি কেলেঙ্কারী হয়েছে রাজনৈতিক ইন্ধনের কারণে।

ব্যাংকিং ও অর্থনৈতিক বিষয়ে কোনো প্রকার ধারণা ছাড়াই শুধু রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ দেয়ায় বিদায়ী বছরে ব্যাংক দখল, অস্বাভাবিক ঋণ খেলাপী, এমডি অপসারণ, পরিচালক বাদ দেয়া, পাঁচ তারকা হোটেলে পরিচালনা পরিষদের বিতর্কিত বৈঠক, একটি গ্রুপের হাতে ইসলামী ব্যাংকগুলির নিয়ন্ত্রণ চলে যাওয়া ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিরবতা ছিল সারাবছর জুড়ে আলোচনার শীর্ষে। বছরের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে অর্থমন্ত্রী পর্যন্ত স্বীকার করেছেন ব্যাংক খাত নিয়ন্ত্রণে দুর্বলতা হয়েছে।

পদ্মা সেতু, পায়রা বন্দর, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ, বন্দ থাকা স্থল বন্দও চালুসহ গত কয়েক দশকের মধ্যে অবকাঠামো খাতে বর্তমান সরকারের সবচেয়ে বেশি পরিকল্পনা বস্তাবায়ন হয়েছে। রাজধানী ঢাকার যানজট নিরসনে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার নির্মাণ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। যা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে থাকা মহাজোট সরকারের সাফল্যকে ঈর্শনীয় জায়গায় নিয়ে গিয়েছে। কিন্তু অর্থনৈতিক খাতে বলা যায় ধরাশায়ী হয়েছে সরকারের নেতৃত্ব।

ভালভাবে চললেও বিতর্কিতভাবে ইসলামী ব্যাংকের নেতত্ব বদল হওয়া নিয়ে বছরের শুরুতেই আলোচনার জন্ম হয় ব্যাংক খাতের।

২০১৭ সালেই নতুন প্রজন্মের বেরসকারি খাতের ফার্মাস ব্যাংক, এনআরবি ব্যাংক, পুরনোতে থাকা এবি ব্যাংক ও ন্যাশনাল ব্যাংকে বড় ধরনের কেলেঙ্কারী হয়। এর বাইরে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিরব থাকায় বেশ কয়েকটি বেরসরকারি ব্যাংকের মালিকানা গিয়েছে একটি গ্রুপের হাতে। বাধ্য হয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্বল্প সময়ের ব্যবধানে দুটি ব্যাংকের এমডিকে অপসারণ করে। বর্তমানে ১৩টি ব্যাংকই বহুমুখি সমস্যায় জর্জরিত হয়ে রয়েছে। ভাল নেই রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকগুলিও।

ইসলামী ব্যাংক : গুঞ্জনের মধ্যে হঠাৎ করেই পরিবর্তন এসেছে ব্যাংকটির সর্বোচ্চ পদে। এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ পর্যন্ত। হঠাৎ এক জরুরি সভায় রাজধানীর পাঁচ তারকা হোটেল রেডিসনে ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান, এমডি ও ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান পদে পরিবর্তন আনা হয়।

ব্যাংকটির নতুন চেয়ারম্যান করা হয় সাবেক সচিব ও আরমাডা স্পিনের প্রতিনিধি আরাস্তু খানকে। এর আগে তিনি বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন। ভাইস চেয়ারম্যান আজিজুল হক পদত্যাগ করায় নতুন ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে ইউসিফ আবদুল্লাহ আল-রাজী পুনরায় নির্বাচিত হন ও অধ্যাপক সৈয়দ আহসানুল আলমক নতুন নির্বাচিত হন। এর কিছুদিন পরেই নানা আলোচনার জন্ম দিয়ে ব্যাংক ছাড়েন ক্লিন ইমেজের আহসানুল আলম। ব্যাংকপাড়ায় একথা বেশি প্রচারিত হয়েছে, যে চট্টগ্রামের একটি ব্যবসায়ী গ্রুপ ইসলামী ব্যাংকের শেয়ার কিনে একাধিক পরিচালক দিয়েছেন। তারাই এখন ব্যাংকটির নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে।

এর পরথেকেই লাভজনক ও কর্পোরেট গভর্মেন্সে ভালো করা ব্যাংকটি গ্রাহকদের আস্থা হারাতে শুরু করে। বছর শেষে নগদ টাকার সংকটে ভুগে। মুনাফা কমে যায়। আমানত সংগ্রহের হারও কমে যায়। মূলধনের সংকট মেটাতে আপদকালীন তহবিলে হাত দেয় নতুন নেতৃত্ব। পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত ব্যাংকটি শেয়ারহোল্ডারদের মুনাফাও কম দেয়। ফলে বাজারে কমে যায় উঠতি শেয়ারের দর। এই পরিবর্তনকে ব্যাংক খাতে বিদায়ী বছরের প্রথম রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখে সবাই।

পদ ছাড়েন সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের সাত পরিচালক : বেসরকারিভাবে পরিচালিত সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের(এসআইবিএল) সাত পরিচালক ‘ব্যক্তিগত কারণ’ দেখিয়ে ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। পদত্যাগকারীদের মধ্যে চারজন স্বতন্ত্র এবং তিনজন ব্যাংকটির শেয়ারধারী ছিলেন। একই দিনে ব্যাংকের পরিচালক হিসেবে নয়জনকে নতুন করে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে সাতজন স্বতন্ত্র এবং দুজন শেয়ারধারী।

১৩ নভেম্বর ব্যাংকের এক বোর্ড মিটিংয়ে এমন পরিবর্তন আসে। এর আগে গত ৩০ অক্টোবর এসআইবিএল-এর বোর্ড চেয়ারম্যান মোহাম্মদ রেজাউল হক, নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আনিসুল হক এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক শহীদ হোসেন তঁদের নিজ নিজ পদ থেকে পদত্যাগ করেন। একই দিনে চট্টগ্রাম-ভিত্তিক ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান এস আলম গ্রুপ ব্যাংকটির ৫০ শতাংশের বেশি শেয়ার কিনে নেওয়ায় ব্যাংকটি নতুন করে বোর্ড চেয়ারম্যান, নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালকের নাম ঘোষণা করে। এভাবেই একটি গ্রুপ দখল করে নেয় ব্যাংকটি।

সাত ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ একটি গ্রুপের হাতে : চট্টগ্রামের একটি গ্রুপের হাতে চলে গিয়েছে দেশের সাতটি ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ। নামে-বেনামে ব্যাংকের শেয়ার কিনে বোর্ডে পরিচালক দেয় গ্রুপটি। বিভিন্ন ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে, সেই ঋণের টাকায় কিনছে শেয়ার। নাম সর্বস্ব এসব প্রতিষ্ঠানের কোনো ব্যবসা নেই। কিন্তু শেয়ার কিনে ব্যাংকে পরিচালক দিচ্ছে। পরিচালক দিয়েই নিচ্ছে ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডও ওই গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।

এনিয়ে সরাসরি তিনটি ব্যাংক পুরো নিয়ন্ত্রণের মধ্যে চলে গিয়েছে ওই গ্রুপের কাছে। ব্যাংকপাড়ায় গুঞ্জন রয়েছে, মার্কেন্টাইল ব্যাংকসহ আরও কয়েকটি ব্যাংকে বড় বিনিয়োগ রয়েছে ওই গ্রুপটির। এভাবেই দেশের বেসরকারি খাতের সাতটি ইসলামী ব্যাংকে তাদের প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছে গ্রুপটি।

ফারমার্স ব্যাংক : প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ঋণ কেলেঙ্কারী ও আমানত সংকটে ভুগে সরকারের সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহিউদ্দিন খান আলমগীরের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত ফারমার্স ব্যাংক। এই ব্যাংকের আরেক উদ্যোক্তা হলেন ছাত্রলীগের বিদায়ী কমিটির সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলম। ২০১১ সালের জুলাইয়ে ২৭তম কাউন্সিলের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হন তিনি। এর এক বছর পরই ব্যাংক উদ্যোক্তা বনে যান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্দু বিভাগের ২০০৩-০৪ শিক্ষাবর্ষের এ শিক্ষার্থী।

২০১৩ সালের শুরুর দিকে রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন পাওয়া দ্য ফারমার্স ব্যাংক লিমিটেডের ৩৯ ব্যক্তি উদ্যোক্তার একজনে পরিণত হন।
প্রতিষ্ঠাকালেই ব্যাংকটির ১০ লাখ শেয়ারের মালিক হন জামালপুরের নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার থেকে ঢাকায় আসা সিদ্দিকী নাজমুল আলম। প্রতিটি শেয়ারের অভিহিত মূল্য ১০ টাকা হিসাবে ফারমার্স ব্যাংকের মূলধনে ছাত্রলীগের এ সাবেক সাধারণ সম্পাদক জোগান দিয়েছেন ১ কোটি টাকা।

তার রাজনৈতিক সহকর্মীরা বলছেন, নেতা হওয়ার পর আর্থিকভাবে অস্বাভাবিক উত্থান হয় নাজমুলের। ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক থাকা অবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তন আসে তার আর্থিক জীবনে। দামি গাড়ি, ফ্ল্যাট, শহর ও গ্রামে বহুতল বাড়িসহ বিলাসবহুল জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন তিনি। ছাত্র হয়েও ব্যাংকের উদ্যোক্তা হওয়ায় অর্থনীতিতে আলোচনার জন্ম দিয়েছেন তিনি।

ব্যাংকটির প্রভাবশালী অন্যান্য উদ্যোক্তার মধ্যে আছেন— সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ডের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক মো. মাহবুবুল হক বাবুল চিশতী, পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের মেয়ে নাফিসা কামাল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মুনতাসীর উদ্দিন খান মামুন (মুনতাসীর মামুন), লুসাকা গ্রুপের চেয়ারম্যান হাফিজুর রহমান সরকার, মোহাম্মদ মাসুদ, আজমত রহমান, ড. মোহা. আতাহার উদ্দিন ও অমিকন গ্রুপের প্রধান নির্বাহী মো. মেহেদী হাসান।

ঋণে অনিয়ম, জামানত ছাড়াই ঋণ দেয়া, অযথ অর্থ ব্যয় ও আগ্রাসী ব্যাংকিংয়ে জড়িয়ে পরায় ব্যাংকটির আর্থিক স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে। অনিয়মের জন্য শেষ পর্যন্ত ব্যাংকটির এমডিকে অপসারণ করতে বাধ্য হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বর্তমানে নগদ টাকার সংকটে থাকা ব্যাংকটি থেকে সমালোচনার দায় নিয়ে পদত্যাগ করেন মহিউদ্দিন খান আলমগীর।

ব্যাংকটির বিষয়ে বছরের শেষপ্রান্তে এসে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, ফারমার্স ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতারাই লুটপাট করে ব্যাংকটিকে শেষ করে দিয়েছে। অর্থমন্ত্রী বলেন, ফারমার্স ব্যাংক এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের তত্ত্বাবধানে আছে, সংকট কাটাতে একটু সময় লাগবে। তিনি বলেন, আমাদের দেশে ব্যাংকের পতন হয় না। আমরা হতে দিই না।

এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক : বেনামি শেয়ারহোল্ডার, বহিরাগতদের পর্ষদ সভায় উপস্থিতি, পরিচালকদের স্বাক্ষর জালিয়াতি, তথ্যগোপন করে পরিচালকদের আত্মীয়স্বজনের নামে ঋণ প্রদান ইত্যাদি অভিযোগেরও প্রমাণ মিলেছে এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের বিরুদ্ধে। ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ, নির্বাহী কমিটি ও অডিট কমিটি সভার কার্যবিবরণী পর্যালোচনা এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ পরিদর্শন প্রতিবেদনে এসব অনিয়ম উঠে এসেছে। ফলে চলতি মাসের ৬ ডিসেম্বর অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক দেওয়ান মুজিবর রহমানকে অপসারণ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৬ সালের ডিসেম্বর প্রান্তিকে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ছিল ১৯ কোটি ৩০ লাখ টাকা। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৯৩ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের কারণে বিপুল পরিমাণ অংকের অর্থ প্রভিশন রাখতে হয়েছে। ফলে নিট মুনাফায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ২০১৬ সালের ডিসেম্বর প্রান্তিকে নিট হয়েছিল ৮৬ কোটি ১৪ লাখ টাকা। যা চলতি বছরের জুন ১২ কোটিতে নেমে এসেছে।

নানা অনিয়ম ও ঋণ কেলেঙ্কারীর ঘটনার মধ্য দিয়ে এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের শীর্ষ পদেও বড় ধরণের পরিবর্তন হয় ২০১৭ সালেই। নানামুখি বিতর্কের মধ্যে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক(এমডি)কে সরিয়ে দিতে পদত্যাগ করানো হয়। রোববার(১০ ডিসেম্বর) রাতের বেলা এক বৈঠকে এই শীর্ষ পদে পরিবর্তনের পাশাপাশি ব্যাংকটির অভ্যন্তরীণ সব কমিটির চেয়ারম্যানও পদত্যাগ করেছেন।

সূত্র জানায়, ওই আলোচিত বৈঠকটিও হয় একটি পাঁচ তারকা হোটেলে। রাতে ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয়ে এক জরুরি পর্ষদ সভায় এসব পরিবর্তন হয়। ওই সভাতে পদত্যাগ করা পর্ষদ ও নতুন পর্ষদের বেশির ভাগ সদস্য উপস্থিত ছিলেন।

প্রতিষ্ঠাকালীন চেয়ারম্যান ফরাছত আলীকে সরিয়ে নতুন দায়িত্ব পেয়েছেন ব্যাংকের আরেক পরিচালক তমাল এস এম পারভেজ। ভাইস চেয়ারম্যান তৌফিক রহমান চৌধুরী, নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মনজুরুল ইসলাম, নিরীক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান নুরুন নবী ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কমিটির চেয়ারম্যান সৈয়দ মুনসেফ আলীকেও সরিয়ে দেয়া হয়েছে। এমডি দেওয়ান মুজিবর রহমানকে তিন মাসের ছুটিতে পাঠানো হয়েছে। এ পদে চলতি দায়িত্ব দেয়া হয়েছে ডিএমডি কাজী মো. তালহাকে।
 
সূত্র জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে ২০১৬ সালে এনআরবিসির ৭০১ কোটি টাকা ঋণে গুরুতর অনিয়মের তথ্য বেরিয়ে আসে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংকটিতে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি বছরের ২০ মার্চ ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ও এমডির কাছে পাঠানো পৃথক নোটিশে বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, আমানতকারীদের স্বার্থে ও জনস্বার্থে এনআরবিসি ব্যাংক চালাতে ব্যর্থ হয়েছে ফরাছত আলীর নেতৃত্বাধীন পরিচালনা পর্ষদ। আর এমডি ব্যর্থ হয়েছেন ব্যাংকটিতে যথাযথ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে। এমনকি তাঁরা গুরুতর প্রতারণা ও জালিয়াতি করেছেন, যা ফৌজদারি আইন অনুযায়ী দণ্ডনীয়।

ব্যাংক কোম্পানি আইনের ৪৬ ধারা অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির ব্যাংকটির এমডি দেওয়ান মুজিবর রহমানকে অপসারণ করেন। ব্যাংক কোম্পানি আইনের ৪৬ ধারায় কাউকে অপসারণ করা হলে ওই অপসারিত ব্যক্তির ক্ষতিপূরণ চাওয়ার কোনো অধিকার থাকে না। এমনকি এ ধারার কোনো আদেশের বিষয়ে কোনো আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ কোনো প্রশ্ন তুলতে পারবে না।

তবে এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের কাছে আবেদন করতে পারবেন সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি। যদিও এ আইনকে পাস কাটিয়ে উচ্চ আদালতে যান দেওয়ান মুজিব। তাকে অপসারণের নোটিশটিতে আদালতের মাধ্যমে নিষেধাজ্ঞা আনেন। এরপর থেকেই ব্যাংকপাড়ায় তুমুল আলোচনার জন্ম দেয় ব্যাংকটি। তারপরে ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদের পক্ষ থেকে ব্যাংকটির এমপিকে তিন মাসের ছুটিতে পাঠানো হয়। পরে বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, ব্যাংকটিতে পরিবর্তন আনতে অনানুষ্ঠানিক চাপ তৈরি কে ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেই পরিবর্তন এল হঠাৎ করেই।

বেসিক ব্যাংক : রাষ্ট্রায়ত্ব বেসিক ব্যাংকের সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার ঋণ কেলেঙ্কারীর সঙ্গে জড়িত ব্যাংকটির চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগে বাধ্য হন আব্দুল হাই বাচ্চু। গত চার বছরের আলোচিত ঘটনায় তার বিরুদ্ধে সরকার এমনকি দুদক পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। অবশেষে ঋণ কেলেঙ্কারীরর ঘটনায় আদালতের নির্দেশে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে দুর্নীতি দমন কমিশন(দুদক)। ওই জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হয় বছরের শেষের দিকে। অর্থনীতির কেলেঙ্কারীর মধ্যে এটিই ছিল নেতিবাচক হলেও কিছুটা ভাল খবর।

এরই মধ্যে বাচ্চুর সম্পদের খোঁজ নিতে একজন কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়েছে দুদক। এজন্য অনুসন্ধান চালাতে দুদকের উপ-পরিচালক শামসুল আলমকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। বাচ্চুকে ২০০৯ সালে বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ দেয় সরকার। ঋণ কেলেঙ্কারির অভিযোগ উঠলে ২০১৪ সালে চাপের মুখে তিনি পদত্যাগ করেন। বাচ্চু চেয়ারম্যান থাকাকালেই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংটির ঋণ বিতরণে অনিয়মের ঘটনাগুলো ঘটে, পরে দুদক ৫৬টি মামলা করে। দুই দিনে ৫৬টি মামলার মধ্যে ১৫টির বিষয়ে দুদকের তদন্ত কর্মকর্তারা বাচ্চুকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। প্রথম দিন জিজ্ঞাসাবাদের পর বাচ্চু সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ঋণে অনিয়মের ঘটনায় নিজেকে তিনি দোষী মনে করেন না।

২০০৯ সাল থেকে ২০১২ সালের মধ্যে রাষ্ট্রায়াত্ত বেসিক ব্যাংকের গুলশান, দিলকুশা ও শান্তিনগর শাখা থেকে মোট সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা ঋণ অনিয়মের মাধ্যমে বিতরণের অভিযোগ ওঠার পর তদন্তে নামে দুদক। ঋণপত্র যাচাই না করে জামানত ছাড়া, জাল দলিলে ভুয়া ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দানসহ নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে বিধি বহির্ভূতভাবে ঋণ অনুমোদনের অভিযোগ ওঠে ব্যাংকটির তৎকালীন পরিচালনা পর্ষদের বিরুদ্ধে।

প্রায় চার বছর অনুসন্ধান শেষে এই অনিয়ম ও দুর্নীতির ঘটনায় গত বছর রাজাধানীর তিনটি থানায় ১৫৬ জনকে আসামি করে ৫৬টি মামলা করে দুদক। আসামিদের মধ্যে ২৬ জন ব্যাংক কর্মকর্তা এবং বাকিরা ঋণ গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংক জরিপ প্রতিষ্ঠানে যুক্ত।

বাচ্চুকে আসামি না করার বিষয়ে দুদক তখন যুক্তি দেখিয়েছিল, এই অনিয়মে তার সংশ্লিষ্টতা তারা পায়নি। এরপর সংসদে এক প্রশ্নের উত্তরে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক ও বেসিক ব্যাংকের নিয়োগ করা নিরীক্ষকের প্রতিবেদনে অনিয়মিত ঋণ মঞ্জুর, নিয়োগ ও পদোন্নতিতে পরিচালনা পর্ষদের তৎকালীন চেয়ারম্যান বাচ্চুর সংশ্লিষ্টতা ছিল।
তাকে দায়িত্ব দেয়ার পরই প্রথমবারের মতো দুর্নীতিতে জড়িয়ে লসের খাতে নাম লেখায় রাষ্ট্রায়ত্ব লাভজনক থাকা বেসিক ব্যাংক।

এবি ব্যাংক : অফশোর ব্যাংকিংয়ের নামে দেড় শতাধিক কোটি টাকা পাচার হয় দেশের বেসরকারি খাতের প্রথম এবি ব্যাংক। এছাড়াও বন্ধ হয়ে যাওয়া সিটিসেল মোবাইল কোম্পানিকে বড় অঙ্কের ঋণ ও কয়েকটি ব্যাংকের পক্ষ গ্যারান্টার হয়েছিল এবি ব্যাংক। কিন্তু লোকসানে থাকা মোবাইল কোম্পানিটি শেষ পর্যন্ত ব্যবসা গুটাতে বাধ্য হয় দেনার দায়ে। বকেয়া টাকা পরিশোধ না করায় বিটিআরসি তাদের লাইসেন্স বাতিল করে। এরকম চড়াই-উৎড়াইয়ের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময়েই ব্যাংকটির পরিচালনা পরিষদে পরিবর্তনের গুঞ্জন শোনা যায়। এবারও নাম আসে চট্টগ্রামের ওই গ্রুপটির।

চেয়ারম্যান এম ওয়াহিদুল হকসহ পরিচালনা পর্ষদের তিন সদস্য পদত্যাগের পর আরব বাংলাদেশ (এবি) ব্যাংকের নতুন চেয়ারম্যান হন এম আওয়াল। ভাইস চেয়ারম্যান হয়েছেন ফিরোজ আহমেদ। দুজনেই ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের সদস্য ছিলেন। এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয় রাজধানীর লা মেরিডিয়ান হোটেলে অনুষ্ঠিত ব্যাংকটির বার্ষিক সাধারণ সভায় (এজিএম)। ওই সভায় দায়িত্বে থাকা চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানসহ তিন পরিচালকের পদত্যাগপত্র অনুমোদিত হয়। নতুন পরিচালকরা হলেন- শিরিন শেখ, সাজির আহমেদ ও মোশতাক আহমেদ। লা মেরিডিয়ানে এজিএম অনুষ্ঠানে ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান বিএনপি সরকারের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এম মোরশেদ খান, তার ছেলে ফয়সাল মোরশেদ খানসহ উদ্যোক্তা ও শেয়ারহোল্ডারা উপস্থিত ছিলেন।

নতুন নির্বাচিত পরিচালক নাজির আহমেদ পদত্যাগকারী ভাইস চেয়ারম্যান সেলিম আহমেদের ছেলে। আগে থেকে পর্ষদে থাকা শেখ মঈনুদ্দীন ও মোশতাক আহমেদ হলেন এম মোরশেদ খানের প্রতিনিধি।

টাকা পাচারের ঘটনায় দুদকে হাজির হতে হয় ব্যাংকের ১২ কর্মকর্তাকে। প্রাথমিকভাবে তাদের অপরাধের সত্যতা পাওয়ায় বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে দুদক।

ন্যাশনাল ব্যাংকেও ঋণ খেলাপীদের ভীড় : শীর্ষ খেলাপিদের নিয়ে বিপাকে পড়েছে প্রথম প্রজন্মের ন্যাশনাল ব্যাংক। এসব খেলাপি থেকে ব্যাংকটি অর্থ আদায় করতে পারছে না, কোনো আইনি ব্যবস্থাও নিতে পারছে না। ফলে প্রতিনিয়ত সুদ যুক্ত হয়ে বাড়ছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। আবার, প্রায় ৯ মাস ধরে ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) দিয়ে চলছে ব্যাংকটি। যদিও ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী, ৩ মাসের বেশি ভারপ্রাপ্ত এমডি দিয়ে ব্যাংক পরিচালনার সুযোগ নেই। আইনে বলা আছে, এমন পরিস্থিতিতে প্রশাসক নিয়োগ দিতে পারে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিষয়টি জেনেও রয়েছে নীরব দর্শকের ভূমিকায়।

ন্যাশনাল ব্যাংকের চেয়ারম্যান জয়নুল হক সিকদার। তার পরিবারের ছয় সদস্য ব্যাংকটির পরিচালক। বর্তমান সরকারের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত জয়নুল হক সিকদারের মেডিকেল কলেজ, হাসপাতাল, বিদ্যুৎ প্রকল্প, চা-বাগান, আবাসনসহ নানা ব্যবসায় বিনিয়োগ রয়েছে। ন্যাশনাল ব্যাংকের শীর্ষ পাঁচ খেলাপি গ্রাহক হলো সাফারি ট্রেডার্স, ইপসু ট্রেডিং, কেমব্রিজ ইন্টারন্যাশনাল, ড্রিমওয়ার্ল্ড পার্ক ও মনোয়ারা ট্রেডিং। এসব খেলাপি গ্রাহকের কাছেই ব্যাংকটির পাওনা ৬৮৬ কোটি টাকা।

সব মিলিয়ে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ বেড়ে গত জুনে হয়েছে ২ হাজার ৪৪৩ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের প্রায় ১১ শতাংশ। এর মধ্যে শীর্ষ ২০ খেলাপির কাছেই আটকে আছে ১ হাজার ২৬০ কোটি টাকা। অনিয়মের কারণে ২০১৪ সালের অক্টোবর থেকে ব্যাংকটিতে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তাতেও পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা খেলাপি রয়েছে ব্যাংকটির।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাজনৈতিক বিবেচনায় লাইসেন্স পায় নয় ব্যাংক। শুধু রাজনৈতিক বিবেচনায় ২০১২ সালে অনুমোদন দেয়া হয় চতুর্থ প্রজন্মের নয় নতুন ব্যাংক। ব্যাংকগুলোর মধ্যে প্রবাসী বাংলাদেশিদের উদ্যোগের ব্যাংক রয়েছে তিনটি- এনআরবি, এনআরবি গ্লোবাল ও এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক। বাকি ছয় ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছেন দেশীয় উদ্যোক্তরা। এগুলো হলো- ইউনিয়ন, মেঘনা, মিডল্যান্ড, মধুমতি, দ্য ফারমার্স ও সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র মতে, নতুন নয়টি ব্যাংকের মধ্যে দু-তিনটির অবস্থা খুবই নাজুক।

এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক : ২০১৩ সালের ৯ সেপ্টেম্বর কার্যক্রম শুরু করে ব্যাংকটি। পণ্যের কোনো নতুনত্ব নেই আর্থিক এ প্রতিষ্ঠানের। মানছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়মনীতি। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকটি পাঁচ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে। এর মধ্যে খেলাপি হয়েছে ৫১ কোটি টাকা। আদায় অযোগ্য ঋণের পরিমাণ ৩০ কোটি টাকা। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী কোনো ব্যাংক তার নিট মুনাফার ১০ শতাংশ অর্থ সিএসআরে (সামাজিক দায়বদ্ধতামূলক কাজ) ব্যয় করতে পারে। কিন্তু ২০১৬ সালে এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক ২০৫ শতাংশ পর্যন্ত ব্যয় করেছে। যা নিয়ম বহির্ভূত।

ইউনিয়ন ব্যাংক : ইউনিয়ন ব্যাংকে পর্যাপ্ত জামানত ছাড়াই ঋণ দিয়েছে। বিদায়ী বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকটি নয় হাজার ১৯৮ কোটি ১০ লাখ টাকার ঋণ বিতরণ করেছে। এর মধ্যে খেলাপি হয়েছে ৬১ কোটি ৬১ লাখ টাকা। এছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অমান্য করে সিএসআরে অর্থ ব্যয় করেছে। ২০১৫ সালে ইউনিয়ন ব্যাংক এ খাতে ব্যয় করেছে ৯৯ শতাংশ।

মেঘনা ব্যাংক : বিলাসবহুল ও মাত্রাতিরিক্ত ব্যয় করছে মেঘনা ব্যাংক। কার্যক্রম চালুর দেড় বছরের মধ্যে প্রধান কার্যালয় স্থানান্তর করা হয়েছে। এতে ভাড়া ও অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জার নামে অপ্রয়োজনীয় অর্থ ব্যয় হয়েছে। এসব ব্যয় নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সতর্ক করেছে ব্যাংকটিকে। এছাড়া ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ গত কয়েক মাস ধরে হুহু করে বাড়ছে। চলতি বছরের জুন প্রান্তিকে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ছিল ৫৫ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। তিন মাসের ব্যবধানে ঋণ খেলাপি বেড়েছে প্রায় তিনগুণ। সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ১৫২ কোটি ১৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে আদায় অযোগ্য ঋণের পরিমাণ ৫০ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের কারণে বিপুল পরিমাণ অংকের অর্থ প্রভিশন রাখতে হয়েছে।

এদিকে ব্যাংক পরিচালনায় পর্ষদ সদস্যদের হস্তক্ষেপের কারণে বাড়ছে খেলাপি ঋণ। ফলে পর্ষদের সঙ্গে মনোমালিন্যের জেরে পদত্যাগ করেছেন ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ নূরুল আমিন। তবে পদত্যাগপত্রে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক কারণের কথা উল্লেখ রয়েছে।

মিডল্যান্ড ব্যাংক : রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন পাওয়া মিডল্যান্ড ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ লাগামহীনভাবে বাড়ছে। শুধু তাই নয়, এখন পর্যন্ত ব্যাংকটির যে পরিমাণ ঋণ খেলাপি হয়েছে এর ৮০ শতাংশই আদায় অযোগ্য। ফলে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে ব্যাংকটি।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, চলতি বছরের জুন মাস শেষে মিডল্যান্ড ব্যাংকের ঋণ খেলাপি ছিল ৩২ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। সেপ্টেম্বর শেষে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ তিন মাসের ব্যবধানে ব্যাংকটির ঋণ খেলাপি বেড়েছে ১৩ কোটি টাকা। এছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অমান্য করে সিএসআরে অর্থ ব্যয় করেছে। ২০১৫ সালে ব্যাংকটি এ খাতে ব্যয় করেছে ৯২ শতাংশ।

মধুমতি ব্যাংক : কার্যক্রম শুরুর পর থেকে নানা অনিয়মের অভিযোগ ওঠে মধুমতি ব্যাংকের বিরুদ্ধে। বাড়ছে খেলাপি ঋণের পরিমাণও। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকটি দুই হাজার ৪৪৩ কোটি ৩০ লাখ টাকার ঋণ বিতরণ করেছে। এর মধ্যে খেলাপি হয়েছে ১৪ কোটি ২৮ লাখ টাকা। এর আগে জুন প্রান্তিকে ব্যাংকটির খেলাপি ছিল মাত্র পাঁচ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। তিন মাসের ব্যবধানে ব্যাংকটির ঋণ খেলাপি বেড়েছে ২৬২ শতাংশ অর্থাৎ আট কোটি ৮৩ টাকা। সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক কার্যক্রম শুরুর পর থেকে এ ব্যাংকও নানা অনিয়মে জড়িয়ে পড়ে।

যথাযথ কাগজপত্র ছাড়া ঋণ অনুমোদন, ঋণ প্রদানে নানা অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে ব্যাংক কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। বহিরাগতদের পরিচালক বানিয়ে পর্ষদ সভায় যোগদানসহ নানা অপকর্মেরও অভিযোগ রয়েছে। ঋণ প্রদানে অনিয়মের অভিযোগে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালককে তলবও করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এদিকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ বেড়েছে। সেপ্টেম্বর শেষে সাউথ বাংলার খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ১৫ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। যা জুন প্রান্তিকে ছিল ১০ কোটি টাকা।

আর্থিক অবস্থার অবনতি হওয়া ১৩টি ব্যাংকের মধ্যে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ও বিশেষায়িত ব্যাংকই আটটি। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ কমার্স, ন্যাশনাল, ফারমার্স ও এনআরবি কমার্শিয়ালে পরিস্থিতি কয়েক বছর ধরে খারাপ হচ্ছে। এ ছাড়া এক যুগ আগে বিলুপ্ত হওয়া ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের দুর্নীতির বোঝা এখনো টেনে চলেছে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক। বাকি বেসরকারি ব্যাংকগুলোর বেশির ভাগের অবস্থাও সন্তোষজনক নয়।

বেসরকারি খাতের একাধিক ব্যাংকের মালিকানা বদল নিয়ে নজিরবিহীন ঘটনা ঘটলেও এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপই নেয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক। উল্টো কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাতে সায় দিয়েছে। ফলে ব্যাংক খাতের আমানতকারীসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে একধরনের আতঙ্ক বিরাজ করছে।

এক পরিবারের চার পরিচালক : এদিকে ব্যাংকে একই পরিবারের চারজনকে পরিচালক নিয়োগ এবং একটানা নয় বছর পরিচালক পদে থাকার সুবিধা যুক্ত করে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধনরে প্রস্তাব উঠছে জাতীয় সংসদ। যা আগে ছিল ২ জন এবং ৬ বছর। এই আইনটির মাধ্যমে নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে সবচেয়ে বেশি সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। ব্যাংকাররা বলছেন, এতে একটি ব্যাংকে পারিবারিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হবে। দুর্নীতি বাড়বে। এরই মধ্যে একটি ব্যাংকে এ সমস্যা দেখা দিয়েছে। পারিবারিক কোন্দলের প্রভাব পড়বে ব্যাংকের ব্যবসায়।

সোনালীনিউজ/তালেব/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!