• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

দল ও সরকারকে পৃথকের ধারাবাহিকতায় রাখতে চায় আ.লীগ


বিশেষ প্রতিনিধি এপ্রিল ১০, ২০১৯, ০২:৩৬ পিএম
দল ও সরকারকে পৃথকের ধারাবাহিকতায় রাখতে চায় আ.লীগ

ঢাকা : দীর্ঘদিন থেকেই দল ও সরকারকে আলাদা করার আলোচনা আছে আওয়ামী লীগে। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ দ্বিতীয় মেয়াদে সরকার গঠন করার পর থেকেই এমন আলোচনা শুরু হয়। সে সময় দলের সভাপতি শেখ হাসিনা নিজেই দলীয় ফোরামে এ ধরনের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। এরপর অনুষ্ঠিত হয়েছে দলের দু’টি সম্মেলন। দলও টানা তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করেছে।
তবে এর মধ্যে সুস্পষ্টভাবে দলকে সরকার থেকে পৃথক করা সম্ভব না হলেও কিছু ক্ষেত্রে উভয় প্রতিষ্ঠানকে আলাদা করার ইঙ্গিত দেখা গেছে।

বিশেষ করে এ বছরে গঠিত আওয়ামী লীগের ৫ম ও শেখ হাসিনার চতুর্থ মন্ত্রিসভায় দলের শীর্ষ নেতাদের অনেকেরই স্থান না পাওয়া এই ধারণাকে আরও জোরালো করে তুলেছে। আওয়ামী লীগের দলীয় শীর্ষস্থানীয় নেতাদের অনেকেই বলছেন, এর ধারাবাহিকতা আসন্ন সম্মেলনেও বজায় থাকবে।

তারা বলছেন, মন্ত্রিসভায় স্থান পেয়েছেন এমন অনেককেই সম্মেলনে দলীয় পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হতে পারে। আবার দলীয় পদ থেকে বাদ পড়েছেন কিন্তু দলীয় সভাপতির আস্থায় আছেন এমন অনেককে মন্ত্রিসভায় জায়গা দেওয়া হতে পারে।

এ অবস্থায় হতে যাচ্ছে দলটির আরেকটি সম্মেলন। ক্ষমতাসীন দলের সভাপতিমণ্ডলীদের গত ২৭ মার্চের বৈঠকে আগামী অক্টোবরের মধ্যে সম্মেলনের জন্য দলকে প্রস্তুত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। সেই ধারাবাহিকতায় গত ৩১ মার্চ দলের সম্পাদকমণ্ডলীর বৈঠকে সাংগঠনিক অবস্থা পর্যালোচনা করে এ লক্ষ্যে ৮টি খসড়া কমিটি গঠন করা হয়। এরপর গত শুক্রবার দলের কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে কমিটির মেয়াদ শেষে অক্টোবরের যে কোনও দিন সম্মেলনের তারিখ নির্ধারিত হতে পারে।

সর্বশেষ গত ৭ জানুয়ারি টানা তৃতীয় দফায় সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। ২০১৪-২০১৮ মেয়াদের সঙ্গে তুলনামূলক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, দলের কেন্দ্রীয় কমিটির পদে আছেন এমন নেতাদের এ সরকারের মন্ত্রিসভায় স্থান দেওয়া হয়েছে কম।

২০১৪-২০১৮ মেয়াদে মন্ত্রিসভায় ছিলেন এবং দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে এখনও আছেন এমন অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতা এই মেয়াদে মন্ত্রিসভায় স্থান পাননি। আওয়ামী লীগের বর্তমান সরকারে মন্ত্রিসভার সদস্য আছেন ৪৭ জন। আর দলটির কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ ৮১ সদস্যবিশিষ্ট। বিশ্লেষণে দেখা গেছে, কেন্দ্রীয় কমিটির পদে আছেন মন্ত্রিসভায় এমন সদস্য মাত্র ১০ জন। এদের সিংহভাগই আগের কোনও মেয়াদেই মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেননি। ২০১৪-১৮ মেয়াদে দলের কমিটিতে থাকা মন্ত্রীর সংখ্যা ছিল ১৯ জন।

দলটির দায়িত্বশীল নেতাদের অভিমত, এভাবে দলের কমিটি এবং মন্ত্রিসভায় যোগ-বিয়োগ করে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দল ও সরকারকে আলাদা করার বার্তাই দিয়েছেন বলে মনে করা হয়।

জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক বলেন, দল এবং সরকার দু’টি আলাদা প্রতিষ্ঠান। দুটিকে স্বতন্ত্র রাখতে পারলে বেশি ভালো ফল পাওয়া সম্ভব। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একসময় দলের সাধারণ সম্পাদক পদ বেছে নিয়ে মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দিয়েছিলেন। বর্তমানেও যতটা সম্ভব দল ও সরকারকে আলাদা রাখার উদ্যোগ আছে।

সভাপতিমণ্ডলীর আরেক সদস্য কাজী জাফরুল্লাহ কাছে বিষয়টি আরও স্পষ্ট করে তুলে ধরেন। তিনি বলেন, সরকারের তিনটি মেয়াদেই দল ও সরকারকে স্বতন্ত্র করে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে। দল যাদের প্রয়োজন মনে করেছে, তাদের মন্ত্রিসভায় দায়িত্ব দিয়েছে। আবার অনেককে একইসঙ্গে দল ও সরকার দুই জায়গাতেই রাখা হয়েছে। অনেক সময় মন্ত্রীর দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের দলীয় দায়িত্ব থেকে মুক্ত করে সেখানে তরুণদের আনা হয়েছে। জাফরুল্লাহ বলেন, এটা অব্যাহত প্রক্রিয়া, যা আগামীতেও ধারাবাহিকভাবে চলবে।

আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, এবার দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ থেকে মন্ত্রিত্ব পাওয়া কয়েকজন নেতাকে দলের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে মন্ত্রণালয়ে মনোযোগী হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হতে পারে। বিশেষ করে সাধারণ সম্পাদক পদটি নিয়ে এমন আলোচনা বেশি। এ পদের ক্ষেত্রে মন্ত্রী নন এমন কাউকে বেছে নেওয়া হতে পারে। আর যদি বর্তমান সাধারণ সম্পাদক এ পদে থেকে যান বা মন্ত্রী আছেন এমন কেউ এ পদে আসেন, তাহলে তাকে মন্ত্রিত্ব ত্যাগ করতে হতে পারে। একইভাবে আগেরবার মন্ত্রী হয়ে দলীয় পদ হারিয়েছেন কিন্তু এবার মন্ত্রিসভায় জায়গা পাননি, এমন কাউকে আবার দলের পদে ফিরিয়ে আনা হতে পারে। তবে এসব ব্যাপারে দলীয় সভাপতির মনোভাব অনুযায়ী চ‚ড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে দল।

২০১৪-২০১৮ মেয়াদের মন্ত্রিসভায় স্থান পাওয়ার পর দলের ২০১৭ সালের সম্মেলনে কেন্দ্রীয় কমিটির পদ হারিয়েছিলেন আগের কমিটির সাংস্কৃতিক সম্পাদক আসাদুজ্জামান নূর, অর্থ সম্পাদক আ হ ম মুস্তফা কামাল ওরফে লোটাস কামাল, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক স্থপতি ইয়াফেস ওসমান, সাংগঠনিক সম্পাদক বীর বাহাদুর, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য মির্জা আজম, নসরুল হামিদ বিপু, এমএ মান্নান, মোস্তাফিজার রহমান ফিজার প্রমুখ।

বিপরীতে ২০১৯-এর বর্তমান মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়েছেন দলের প্রভাবশালী নেতা ও উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আবুল মাল আবদুল মুহিত, আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী, মোহাম্মদ নাসিম, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, নুরুল ইসলাম নাহিদ, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম প্রমুখ।

আওয়ামী লীগ থেকে সরাসরি এ সংক্রান্ত কিছু না বলা হলেও নতুন মন্ত্রিসভা গঠনের পর দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের একাধিক বক্তব্যে বলেছিলেন, এসব নেতা যাতে দলে আরও বেশি সময় দিতে পারেন সেজন্যই তাদের মন্ত্রিসভার দায়িত্ব থেকে বিরত রাখা হয়েছে।
যার প্রতিফলন পাওয়া যায় ২০১৪-২০১৮ মেয়াদে মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী এবং দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোহাম্মদ নাসিমের বক্তব্যে।

তিনি বলেন, ‘আমার দায়িত্বের রূপান্তর ঘটেছে। আগে মন্ত্রিসভার দায়িত্ব, দলের দায়িত্ব এবং ১৪ দলের মুখপাত্রের দায়িত্ব একইসঙ্গে সামলেছি। এখন ১৪ দলকে সক্রিয় ও সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করার কাজ করছি। দলের সাংগঠনিক কাজে বেশি সময় দিচ্ছি।’
একই ধরনের মন্তব্য টানা পাঁচবার দলের শ্রম সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করা আওয়ামী লীগের শ্রম ও জনশক্তি বিষয়ক সম্পাদক হাবিবুর রহমান সিরাজের।

তিনি বলেন, ’৬০-এর দশক থেকে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় আছি। প্রায় ১৮ বছর ধরে কেন্দ্রীয় কমিটিতে শ্রম সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছি। শ্রমিক লীগকে সংগঠিত করেছি। দল প্রয়োজন মনে করছে বলেই হয়তো সাংগঠনিক দায়িত্ব দিয়েছে। সরকারে প্রয়োজন মনে করলে সরকারে দেবে। তবে, দলের প্রয়োজনে যে কোনও জায়গাতেই সর্বস্ব উজাড় করে কাজ করতে রাজি আছি।

বিশ্লেষণে দেখা যায়, বর্তমান মন্ত্রিসভায় আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য থেকে মন্ত্রী হয়েছেন মাত্র একজন। তিনি কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক।

দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের বাইরে সম্পাদকমণ্ডলী থেকে মন্ত্রিত্ব পাওয়া সদস্যরা হলেন- শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্বে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা. দীপু মনি, সাংগঠনিক সম্পাদকদের মধ্যে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বে খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, পানিসম্পদ উপমন্ত্রীর দায়িত্বে একেএম এনামুল হক এবং শিক্ষা উপমন্ত্রীর দায়িত্বে ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। অর্থ সম্পাদক টিপু মুনশি পেয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব, প্রচার সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ পেয়েছেন তথ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব, আইনবিষয়ক সম্পাদক শ ম রেজাউল করিম পেয়েছেন পূর্তমন্ত্রীর দায়িত্ব এবং ধর্মবিষয়ক সম্পাদক শেখ আব্দুল্লাহকে করা হয়েছে ধর্ম প্রতিমন্ত্রী। কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্যদের মধ্যে একমাত্র নুরুল মজিদ হুমায়ুন পেয়েছেন শিল্পমন্ত্রীর পদ।

এর বাইরে বেগম মন্নুজান সুফিয়ান ২০০৯ সালের সম্মেলনে দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হন। একই সময়ে তিনি দলের শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করছিলেন। পরে ২০১৪ সালের পরবর্তী সরকারে তিনি মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়েন। ২০১৬ সালের সম্মেলনে আবারও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যপদ হারান তিনি। এবারের মন্ত্রিসভায় আবারও তাকে শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!