• ঢাকা
  • বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ধর্ষণের ভয়ংকর রূপ


নিজস্ব প্রতিবেদক অক্টোবর ৬, ২০২০, ০২:০৭ পিএম
ধর্ষণের ভয়ংকর রূপ

ঢাকা : হঠাৎ করেই দেশে ধর্ষণের ঘটনা ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে। একটির পর একটি ধর্ষণের ঘটনা যেন চাঞ্চল্যকর রূপ নিচ্ছে। বিশেষ করে ধর্ষণের ঘটনা মোবাইলে ধারণ করে সেগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছেড়ে দেওয়ায় নৃশংসতার রূপগুলো প্রকাশ পাচ্ছে।

সিলেটের এমসি কলেজে দলবেঁধে ধর্ষণের ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতে নোয়াখালীর ঘটনা সারা দেশের মানুষের বিবেককে নাড়া দিয়েছে। নোয়াখালীর ঘটনার ভিডিও ফেসবুকে ছাড়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই র্যাব ও পুলিশের অভিযানে পাষণ্ডরা গ্রেপ্তার হয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এর আগের ঘটনাগুলোর বিচার নিশ্চিত করা গেলে এসব অপরাধ কমতো।

সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, নীতি-নৈতিকতার অভাব, মাদকের কুফল, আইনের শাসনের যথাযথ প্রয়োগের অভাব, বিচারহীনতা, রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে এ ধরনের কুৎসিত ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। আর গত প্রায় সাড়ে চার বছরে সাড়ে চার হাজারের মতো ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে।

অতিসম্প্রতি (গত শুক্রবার) সিলেটের এমসি কলেজ ক্যাম্পাসে এক নারীকে গণধর্ষণ করা হয়েছে। তার আগে স্বামীর জন্য রক্ত জোগাড় করতে গিয়ে আরেক নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। আরো কিছুদিন আগে খাগড়াছড়িতে মা-বাবাকে ঘরে বেঁধে রেখে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী এক মেয়েকে ধর্ষণ করেছে দুর্বৃত্তরা। চলতি মাসে দেশব্যাপী চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে এমন কয়েকটি ধর্ষণের ঘটনা রয়েছে।

মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্যমতে, গত সাড়ে চার বছরে প্রায় সাড়ে চার হাজার নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে মোট ৩৪০ জন নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে।

এদের মধ্যে ২০ জন গণধর্ষণসহ ১২৯ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এদের মধ্যে ৭৩ শিশুসহ ১০৯ জন ধর্ষণের শিকার এবং ১০ শিশুসহ ২০ জন গণধর্ষণের শিকার। আগস্ট মাসে সারা দেশে ৮৮৯টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে জানুয়ারি মাসে সারা দেশে হয়েছে ৯৮টি ধর্ষণ। আর জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসে হয়েছে ২৫৭টি। এ ছাড়া এপ্রিল মাসে হয়েছে ৭৬টি, মে মাসে ৯৪টি। জুন মাসে সেই হিসাব বেড়ে হয়েছে ১৭৪টি। জুলাই মাসে ১৪০টি এবং আগস্ট মাসে ১৪৮টি।

আসকের তথ্যমতে, ২০১৬ সালে সারা দেশে ৬৫৯টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে একক ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৪৪৪টি। গণধর্ষণ হয়েছে ১৯৭টি। এর বাইরে ধর্ষণের ধরন জানা যায়নি এমন ঘটনা ঘটেছে আরো ১৮টি। এসব ঘটনায় ৩৭ নারী-শিশুকে হত্যা করা হয়েছে এবং ধর্ষণের অপবাদ সইতে না পেরে ৮টি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। একই বছর ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে আরো ৬৫ নারীকে। বছরজুড়ে দেশের বিভিন্ন থানা ও আদালতে এসব ঘটনায় ৩৯৬টি মামলা দায়ের করা হয়েছে।

২০১৭ সালে সারা দেশে ৮১৮ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে একক ধর্ষণ ৫৯০টি ও ২০৬ জন গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ধর্ষণের ধরন জানা যায়নি এমন আরো ২২টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। ওই বছর ধর্ষণের পরে ৪৭ জনকে হত্যা করা হয়েছে। আত্মহত্যা করেছেন ১১ জন। একই বছর ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে আরো ১০৪ জনকে। এসব ঘটনায় থানায় মামলা দায়ের হয়েছে ৫১৭টি।

২০১৮ সালে সারা দেশে ৭৩২টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে একক ধর্ষণ হয়েছে ৫০২টি। গণধর্ষণ হয়েছে ২০৩টি। আর ধর্ষণের ধরন জানা যায়নি এমন আরো ২৭টি ঘটনা ঘটেছে। একই বছর ১০৩ জনকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। ধর্ষণ-পরবর্তী হত্যা করা হয়েছে ৬৩ জনকে।

এ ছাড়া ধর্ষণের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছেন আরো ৭ জন। এসব ঘটনায় থানায় মামলা হয়েছে ৫০৯টি। তবে ২০১৯ সালে সারা দেশে রেকর্ড ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। ওই বছর সারা দেশে ১ হাজার ৪১৩ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে একক ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ১ হাজার ৬৬টি। ৩২৭টি গণধর্ষণ হয়েছে। ধর্ষণের কারণ জানা যায়নি এমন আরো ২০টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। একই বছর ২২৪ জনকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৭৬ জনকে। আত্মহত্যা করেছেন ১০ জন। এসব ঘটনায় থানায় মামলা হয়েছে ৯৯৯টি।

শুক্রবার সিলেটের এমসি কলেজ ক্যাম্পাসে স্বামীর সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে ছাত্রলীগ কর্মীদের হাতে গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন এক নারী। তার স্বামীকে গাড়িতে আটকে রেখে কলেজ ছাত্রাবাসের ৭ নম্বর ব্লকের একটি কক্ষের সামনে ওই নারীকে গণধর্ষণ করা হয়। কলেজ ক্যাম্পাসে এ ধরনের ঘটনায় সারা দেশে তোলপাড় ও নিন্দার ঝড় বইছে। এ ঘটনায় অভিযুক্ত প্রত্যেককে গ্রেপ্তার করা হয়ছে।

গত ৩ অক্টোবর মুন্সিগঞ্জ সদর এলাকায় ওজু করতে বের হওয়ার সময় ধর্ষণের শিকার হন এক বৃদ্ধা। পরে ধর্ষককে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

২৩ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাত ৩টার দিকে খাগড়াছড়ি জেলা সদরের গোলাবাড়ি ইউনিয়ন এলাকায় ঘরে প্রবেশ করে চাকমা সম্প্রদায়ের এক বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী মেয়েকে গণধর্ষণ করা হয়েছে। মুখে মাস্ক পরে দরজা ভেঙে ঘরে প্রবেশ করে পরিবারের সবাইকে বেঁধে ওই মেয়ের ওপর নির্যাতন চালায় দুর্বৃত্তরা। নয় জন মিলে অসহায় ওই মেয়েকে ধর্ষণের পর তারা বাড়ির নগদ টাকা, স্বর্ণালঙ্কারসহ আরো অনেক কিছু লুটে নিয়ে যায়। ঘটনার পর পুলিশ অভিযান চালিয়ে এ পর্যন্ত চট্টগ্রাম নগরীর বিভিন্ন এলাকা থেকে সাতজনকে গ্রেপ্তার করেছে।

১৬ সেপ্টেম্বর মুমূর্ষু স্বামীকে বাঁচাতে রক্ত আনতে গিয়ে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন এক নারী। সাতক্ষীরা থেকে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে এনে চিকিৎসা করাচ্ছিলেন ওই নারী। মিরপুরের মণিপুরীপাড়ার শিফা ভিলার মাশনু আরা বেগম শিল্পীর বাসায় নিয়ে তাকে মনোয়ার হোসেন সজীব নামের এক ব্যক্তি ধর্ষণ করেছে। পরে ভুক্তভোগীর স্বামীর এমন অভিযোগের ভিত্তিতে সজীবকে ও ধর্ষণে সহযোগিতা করার অভিযোগে এক নারীকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

৭ সেপ্টেম্বর রাতে কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার কাদিরজঙ্গল ইউনিয়নের সাঁতারপুর গ্রামের এক রিকশা চালকের ছয় বছরের শিশুকন্যাকে মা-বাবার সঙ্গে ঘুমন্ত অবস্থায় ঘরে সিঁদ কেটে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করেছে এক দুর্বৃত্ত। ধর্ষণের পরে শিশুটিকে তার বাড়ির পাশের একটি ধানক্ষেতে ফেলে যায় ধর্ষক।

করোনাকালেও দেশব্যাপী চাঞ্চল্যকর ধর্ষণের ঘটনায় মানবাধিকার সংগঠনগুলো উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

সংগঠনগুলো জানিয়েছে, দেশে ধর্ষণের বিরুদ্ধে কঠোর আইন থাকলেও তার প্রয়োগ নেই। ধর্ষণের ঘটনায় মামলা থেকে শুরু করে তদন্ত, বিচার সবখানেই নারীকে প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে পড়তে হয়। ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে অনেক সময় ভুক্তভোগী বাদীকে বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়তে হয়।

অন্যদিকে ধর্ষক যদি প্রভাবশালী হয়, তাহলে ভুক্তভোগীকে উল্টো নানান চাপের মধ্যে থাকতে হয়। ফলে একসময় বাধ্য হয়ে বাদী বিবাদীর সঙ্গে আপস করে মামলা তুলে নেয়।

পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, পুলিশের হাইকমান্ড থেকে ধর্ষণ মামলার তদন্ত গুরুত্বসহকারে দ্রুত সময়ে শেষ করার তাগিদ রয়েছে। কিন্তু মামলার তদন্ত শুরু হলে বাদীই একসময় নানা কারণে তদন্তে অসহযোগিতা ও মামলা নিষ্পত্তির সিদ্ধান্ত নেন।

মানবাধিকার কর্মী ও নারীনেত্রী খুশি কবীর বলেন, ‘দেশে ধর্ষণ ও নারীদের প্রতি সহিংসতা দিন দিন উদ্বেগজনক হারে বেড়েই চলেছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে এসব ঘটনার সঙ্গে সরকারদলীয় বিভিন্ন লোকজন সম্পৃক্ত, যে কারণে অনেক ক্ষেত্রেই বিচার হয় না। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুলিশ এসব প্রভাবশালীকে গ্রেপ্তারও করে না বা গ্রেপ্তার হলেও তারা জামিনে মুক্ত হয়ে যায়। সে হিসাবে ধর্ষণ বা নারীদের প্রতি সহিংসতার এসব ঘটনায় আমরা সমাজে খুব ভালো বার্তা দিতে পারছি না। এ কারণে এ ধরনের অপরাধও থামানো যাচ্ছে না। আমার মনে হয়, বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে এই অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে পারলে এসব অপরাধ কমে আসবে।’

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, ‘নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা বৃদ্ধির ঘটনা রোধ করতে হলে প্রশাসন, রাজনীতি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যে সমাজবিরোধী চক্র গড়ে উঠেছে, তাদের প্রতিহত করতে হবে। এই সিন্ডিকেট দূর না হলে অপরাধপ্রবণতা বাড়তে থাকবে। নারীর প্রতি আগ্রাসী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে সর্বস্তরে নারীরা সহিংসতার শিকার হচ্ছে।’

বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হলে নারীর প্রতি সহিংসতার বিচার দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনালে করা, জবানবন্দি নেওয়ার পদ্ধতি বদলানো, ঘটনা অন্য খাতে প্রবাহিত করতে অপরাধী শনাক্তে নাটকীয়তা বন্ধ করারও দাবি জানান তিনি।

মানবাধিকার সংগঠন রয়েল ভিশনের পরিচালক সাবরিনা আক্তার রিতা বলেন, ধর্ষণ একটি সামাজিক ব্যথী, শিশু থেকে বৃদ্ধা কেউই এখন নিরাপদ নয়। সব শ্রেণি-পেশার মানুষ ধর্ষণে জড়িয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে শিক্ষিত মানুষ এই ব্যথীতে বেশি জড়িত। এটা প্রতিরোধ করতে সরকারকে শক্ত আইন প্রয়োগ করতে হবে। সাথে সাথে সামাজিক মূল্যবোধ সৃষ্টির লক্ষ্যে সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভূমিকা পালন করতে হবে। মেয়েদেরকে সচেতন হতে হবে, চোখ কান খোলা রেখে চলতে হবে, ওয়েস্টার্ন মনোভাব পরিবর্তন করতে হবে। সর্বোপরি পুরুষের নারীর প্রতি সম্মান এবং শ্রদ্ধার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে হবে। তাহলে ধর্ষণ থেকে আমাদের সমাজ ও দেশ রক্ষা পেতে পারে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!