• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ধানের শীষের ডজনখানেক প্রার্থী যুদ্ধাপরাধী-জঙ্গি পৃষ্ঠপোষক!


বিশেষ প্রতিনিধি ডিসেম্বর ১৮, ২০১৮, ১০:০৪ পিএম
ধানের শীষের ডজনখানেক প্রার্থী যুদ্ধাপরাধী-জঙ্গি পৃষ্ঠপোষক!

ঢাকা : যুদ্ধাপরাধে দণ্ডিতদের স্বজনদের পাশাপাশি স্বাধীনতার বিরোধিতা ও জঙ্গিবাদে পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ নিয়ে বিএনপির ধানের শীষ প্রতীকে ভোটের লড়াইয়ে আছেন এক ডজনের বেশি প্রার্থী। এসব প্রার্থীদের নাম উল্লেখ করে বিজয়ের মাসে তাদের ভোট না দিতে আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। এছাড়া মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকেও তাদের প্রত্যাখ্যানের আহ্বানন জানানো হয়েছে।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রধান দলগুলোর অন্যতম বিএনপি একাত্তরে স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে জোট করার পর থেকে জোটগতভাবে ভোট করে সংসদে এসেছেন যুদ্ধাপরাধীরা। তবে যুদ্ধাপরাধের বিচারে তাদের অনেকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া এবং জামায়াত নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন হারানোয় এবার বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় এসেছে।

বিষয়টি ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা ড. কামাল হোসেন, মাহমুদুর রহমান মান্না, কাদের সিদ্দিকী ও আ স ম আবদুর রবের দলগুলোও এবার বিএনপির সঙ্গে জোট করে ভোটে অংশ নেওয়ায়। জামায়াতসহ বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হওয়া সব দলের নেতারাই ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করছেন, যা নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে কামাল হোসেনসহ অন্যদের।

মনোনয়ন দেওয়ার সময় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যুদ্ধাপরাধী ও স্বাধীনতাবিরোধিতাকারীদের কাউকে ধানের শীষ না দেওয়ার কথা বললেও অনুসন্ধানে এ ধরনের অভিযোগবিদ্ধ ডজনের বেশি প্রার্থীর খোঁজ পাওয়া গেছে।

বগুড়া-৩ আসনে ধানের শীষের প্রার্থী হয়েছেন মুহিত তালুকদার, তার ভাই আব্দুল মোমিন তালুকদার মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় পলাতক রয়েছেন। তার বিষয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার জ্যেষ্ঠ সমন্বয়ক সানাউল হক বলেন, ‘আব্দুল মোমিন তালুকদারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ গঠনের পর থেকে তিনি পলাতক রয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধে তার ভ‚মিকা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। তিনি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পক্ষে ভ‚মিকা রেখেছিলেন।’

‘যুদ্ধাপরাধীর’ স্বজনকে ভোটে প্রত্যাখ্যানের আহ্বান জানিয়ে বগুড়া জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার রুহুল আমিন বলেন, ‘বাংলাদেশের জনগণ কোনো দিনও যুদ্ধাপরাধে জড়িতদের মেনে নেবে না। আগামী ১৬ ডিসেম্বর থেকে জেলায় বিজয় মঞ্চ করা হবে। সেখানে থেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে নিয়ে আমরা তাদের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলব।’

যুদ্ধাপরাধে আমৃত্যু কারাদণ্ডে দণ্ডিত জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ছেলে শামীম সাঈদী বিএনপির ধানের শীষের প্রার্থী হিসেবে পিরোজপুর-১ আসনে নির্বাচন করছেন। বড় একটি রাজনৈতিক জোট থেকে তার মনোনয়ন নিয়ে পিরোজপুর জেলার সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার গৌতম নারায়ন চৌধুরী বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, শহীদ পরিবারের সন্তানসহ বাংলাদেশের জনগণের দাবি ছিল, কোনো স্বাধীনতাবিরোধী কিংবা তাদের পরিবারের সদস্যরা যেন কোনো রাজনৈতিক দল থেকে মনোনয়ন না পান। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য তাদের অনেকেই বিএনপির ধানের শীষে নির্বাচন করছেন। আমরা সবার কাছে দাবি করছি, লাখো শহীদের রক্তে পাওয়া স্বাধীন দেশের পতাকা যেন কোনো যুদ্ধাপরাধী বা তার পরিবারের কারো গাড়িতে না উড়ে।’

ঠাকুরগাঁও-২ আসনে ধানের শীষের প্রার্থী মাওলানা আব্দুল হাকিম জেলা জামায়াতের অত্যন্ত প্রভাবশালী নেতা বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। একাত্তরে তার ভ‚মিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে জেলার সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বদরুদ্দোজা বদর বলেন, ‘মাওলানা আব্দুল হাকিম জেলা জামায়াতে ইসলামীর এক নম্বর নেতা। তিনি এক সময় ছাত্রসংঘ করতেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধে প্রশ্নবিদ্ধ ভ‚মিকায় ছিলেন।’

তার অভিযোগ অস্বীকার করে হাকিমের ভাই রমজান আলী বলেন, ‘একাত্তরে আমার ভাই পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ালেখা করত। তার মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয় বা বিরোধিতা করার বয়স তখন ছিল না। কেবল একজন মাওলানা বলে তিনি জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। এক মাস আগে নাশকতা ও সহিংসতার মিথ্যা মামলায় আমার ভাইকে বাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সে স্থানীয় শালন্দর আলিয়া মাদ্রাসার অধ্যাপক। অত্যন্ত নিরীহ মানুষ বলে এলাকায় তার জনপ্রিয়তা রয়েছে। আমরা মনে করি, নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে তিনি কারাগারে থেকেই জয়ী হবেন।’

সাতক্ষীরা-৪ আসনে ধানের প্রার্থী হয়েছেন জামায়াত নেতা গাজী নজরুল ইসলাম। এক সময় জাসদ ছাত্রলীগ করলেও এখন তিনি জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতা। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সাতক্ষীরা জেলার আহ্বায়ক আশেক এলাহী বলেন, ‘১৯৭৭ সাল থেকে গাজী নজরুল ইসলাম জেলা জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তারপর থেকেই এলাকায় সহিংসতা, অগ্নিসংযোগসহ বিভিন্ন অপরাধে তিনি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত।’

সহিংসতায় সম্পৃক্ততার অভিযোগ অস্বীকার করে নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আমি কোনো ধরনের অন্যায়, অপরাধের সঙ্গে জড়িত নই। যারা এখন বলছেন, আমি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও নাশকতায় জড়িত, তারা এসব কথা রাজনৈতিক কারণেই বলছেন।’

নিজের রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে তিনি বলেন, ‘এক সময় আমি ছাত্রলীগ করতাম। এরপর জাসদ (রব) করতাম। বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রাম করে কারাগারেও ছিলাম। এরপর ১৯৮৬ সালে জামায়াতে যোগ দিয়েছি। ১৯৯১ থেকে ৯৬ সাল এবং ২০০১ থেকে ২০০৬ সালের এখানে নির্বাচিত সংসদ সদস্য ছিলাম।’

নাশকতার মামলায় কারাবন্দি জামায়াত নেতা আ ন ম শামসুল ইসলামকে চট্টগ্রাম-১৫ আসনে ধানের শীষের প্রার্থী করা হয়েছে। তার বিষয়ে চট্টগ্রাম জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মো. শাহাবুদ্দিন বলেন, ‘তিনি একাত্তরে ছিলেন রাজাকার, পাক সেনাবাহিনীর পক্ষে তিনি সরাসরি অবস্থান নিয়েছিল। তাকে জেলার মুক্তিযোদ্ধারা প্রত্যাখ্যান করেছে। স্বাধীন বাংলাদেশে তাকে যেন কোনোভাবেই কেউ নির্বাচিত না করে সেই আহ্বান জানাচ্ছি।’

এছাড়াও জঙ্গিবাদে পৃষ্ঠপোষকতা এবং ২১ আগস্ট হামলাসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে সাজাপ্রাপ্তদের পরিবারের অনেকেই ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করছেন।

নওগাঁ-৬ থেকে আলমগীর কবির, রাজশাহী-৫ আসনে নাদিম মোস্তফা, নাটোর-১ আসনে রুহুল কুদ্দুস দুলুর স্ত্রী, রাজশাহী-১ আসনে ব্যারিস্টার আমিনুল হক ও রাজশাহী-২ আসনে মিজানুর রহমান মিনু ধানের শীষের প্রার্থী হয়েছেন। এদের সবার বিরুদ্ধে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে ওই এলাকায় ‘বাংলা ভাই’ জেএমবি সদস্যদের মদদ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল সংবাদমাধ্যমে।

এছাড়া টাঙ্গাইল-২ আসনে ধানের শীষের প্রার্থী সুলতান সালাউদ্দিন টুকু ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি সাবেক প্রতিমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টুর ছোট ভাই। তাদের আরেক ভাই মাওলানা তাজউদ্দিনের বিরুদ্ধে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে। চট্টগ্রাম-৪ আসনের ধানের প্রার্থী ইসহাক চৌধুরী বিএনপি নেতা আসলাম চৌধুরীর বড় ভাই। ভারতে বসে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সঙ্গে ‘দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র’ করার অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন আসলাম।

রংপুর-৩ আসনে ধানের শীষের প্রার্থী রিটা রহমান বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতা হত্যায় অভিযুক্ত সাবেক সেনা কর্মকর্তা খায়রুজ্জামানের স্ত্রী।

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় দণ্ডিত সাবেক প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের স্ত্রী তাহমিনা জামান নেত্রকোনা-৪ আসনে ধানের শীষের প্রার্থী।

এই প্রার্থীদের প্রত্যাখ্যানের আহ্বান জানিয়ে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও প্রজন্ম সমন্বয় জাতীয় কমিটির প্রধান সমন্বয়ক মেহেদী হাসান বলেন, ‘একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যেখানেই রাজাকার ও জঙ্গিদের ধানের শীষ প্রতীকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে সেখানেই তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। আমরা চাই না কোনো যুদ্ধাপরাধী ও তাদের স্বজনদের গাড়িতে আবারও জাতীয় পতাকা উড়ুক। তাই সারা দেশে আমরা তাদের প্রত্যাখ্যান করতে জনগণকে আহ্বান জানাচ্ছি।’

সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে যুদ্ধাপরাধীদের পরিবারের সদস্য, যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত এবং তাদের দলের যেসব নেতা এবার ধানের শীষের প্রার্থী হয়েছেন তাদের কয়েকজনের কথা উল্লেখ করেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘খুলনা-৫ এ মানবতাবিরোধী অপরাধী জামায়াত নেতা গোলাম পারওয়ারকে নমিনেশন (বিএনপি) দেওয়া হয়েছে।’

এছাড়া বিএনপির বাইরেও কয়েকজন প্রার্থী নিয়ে সমালোচনা করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘পাবনা-১ এ দেওয়া হয়েছে মতিউর রহমান নিজামীর ছেলে ব্যারিস্টার নজিবুর রহমানকে (স্বতন্ত্র), যেই নিজামীর ফাঁসি হয়েছে মানবতাবিরোধী কাজ করার কারণে। এই বুদ্ধিজীবীদের হত্যার পেছনে তার হাত ছিল সবচেয়ে বেশি, তার ছেলেকে নমিনেশন দেওয়া হয়েছে। কক্সবাজার-২ এ যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধী জামায়াত নেতা এএইচ এম হামিদুর রহমান আযাদকে নমিনেশন দেওয়া হয়েছে (স্বতন্ত্র)।’

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!