• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ, ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

নতুন আতঙ্কের নাম সিলিন্ডার বিস্ফোরণ


বিশেষ প্রতিনিধি নভেম্বর ১৪, ২০১৯, ০৫:০৪ পিএম
নতুন আতঙ্কের নাম সিলিন্ডার বিস্ফোরণ

ঢাকা : গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ এখন দেশের এক নতুন আতঙ্ক। মেয়াদোত্তীর্ণ ও নিম্নমানের সিলিন্ডারগুলো অত্যন্ত শক্তিশালী পরমাণু বোমার সঙ্গে তুলনীয় বলে মনে করা হচ্ছে।

এগুলোর বিস্ফোরণে বোমার মতোই ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় আশপাশের সবকিছু। লন্ডভন্ড করে দেয় মানুষের শরীর। মুহূর্তেই কেড়ে নেয় জীবন। বিস্ফোরণের কবলে পড়ে হয় প্রাণ হারাতে হয়, না হয় দগ্ধ ও অঙ্গ হারিয়ে চিরতরে পঙ্গু হতে হচ্ছে।

দগ্ধদের মধ্যে অধিকাংশই শেষ পর্যন্ত দীর্ঘদিন জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে ধুঁকে ধুঁকে মারা যান। পরিবার পড়ে চরম আর্থিক সংকটে। আর যারা বেঁচে থাকেন, তাদের অধিকাংশই চিরতরে পঙ্গু হয়ে যান। তবে বিস্ফোরণে দগ্ধদের মধ্যে বেঁচে থাকার হার শতকরা ১০-১২ শতাংশ বলে জানান চিকিৎসকরা।

কারিগরি ত্রুটি, অসচেতনতা, অসতর্কতা ও সরকারি সংস্থার যথাযথ নজরদারির অভাবে সিলিন্ডার বিস্ফোরণের দুর্ঘটনা দেশে ভয়াবহ আকারে বাড়ছে। দুর্ঘটনায় অপমৃত্যুর তালিকা ক্রমেই বাড়তে থাকায় জাতীয় উদ্বেগ ও আতঙ্কের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। আতঙ্ক দূর করতে গ্যাস সিলিন্ডারের গুণগত মান নিশ্চিত ও সেগুলোর নিয়মিত পরীক্ষা করার মতো কার্যক্রম নেই সরকারি কোনো সংস্থার।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এলপিজি ও সিএনজিসহ সিলিন্ডার গ্যাসের ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। যথাযথ ব্যবহারের নিয়মনীতি সম্পর্কে সবার সমানভাবে ধারণা না থাকায় এর সঙ্গে বাড়ছে বিস্ফোরণের ঝুঁকি। ঘটছে প্রাণহানির মতো মর্মান্তিক ঘটনা। তাই এখনোই ব্যবস্থা না নিলে অপেক্ষা করছে ভয়ংকর আগামী।

খোঁজ নিলে জানা যায়, দেশে গ্যাস সিলিন্ডার থেকে দুর্ঘটনা নানাভাবে ঘটছে। সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঝুঁকি নিয়ে বিপুলসংখ্যক সিএনজিচালিত যানবাহন সারা দেশের সড়কে প্রায় অবাধে চলাচল করছে। ফলে বিস্ফোরণে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে। সারা দেশে প্রায় পাঁচ লাখ সিএনজিচালিত যানবাহন রয়েছে। এসব যানবাহনের নিরাপত্তার স্বার্থে ব্যবহূত সিলিন্ডার প্রতি পাঁচ বছর পরপর রিটেস্ট (পুনঃপরীক্ষা) করার নিয়ম থাকলেও অনেকেই তা করান না।

বসতবাড়িতেও বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটছে প্রায়ই। এমনকি বেলুন ফোলানোর কাজে ব্যবহূত গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণেও মানুষ হতাহত হওয়ার ঘটনা উদ্বেগ আরো বাড়িয়ে তুলেছে। গত ৩০ অক্টোবর ঢাকার রূপনগর আবাসিক এলাকায় মনিপুর বিদ্যালয়ের পাশে বেলুনের গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে মারা যায় আট শিশু। সিলিন্ডার ভালো হলেও নিম্নমানের রেগুলেটর ব্যবহার করায় আগুন ধরে বিস্ফোরণ ঘটতে পারে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। গ্যাসের চুলা ব্যবহারে যথাযথ সতর্কতা ও সচেতনতার অভাবেও দুর্ঘটনা ঘটছে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অধ্যাপক সুলতানা রাজিয়া এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘সাধারণত বেলুনে হিলিয়াম গ্যাস ব্যবহার করার কথা। এ গ্যাস ব্যবহারে বিপদও কম। আজকাল বেলুন বিক্রেতারা হিলিয়াম গ্যাসের পরিবর্তে হাইড্রোজেন গ্যাস ব্যবহার করছেন। গ্যাস ব্যবহার করার ক্ষেত্রে সিলিন্ডার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সিলিন্ডারের মান ভালো না থাকায় প্রায়ই বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে।’

তিনি বলেন, ‘যে সিলিন্ডারের ভেতরে হাইড্রোজেন গ্যাস থাকে, সেখান থেকে যদি গ্যাস নির্গত হয়, তাহলে বিস্ফোরণের ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়। হিলিয়াম গ্যাস থাকলে বিপদ ততটা থাকে না। রাস্তাঘাটে যেভাবে সিলিন্ডারে গ্যাস ভরে বেলুন বিক্রি করা হচ্ছে, সেদিকে অবশ্যই নজর দিতে হবে। এসব সিলিন্ডার থেকে হাইড্রোজেন গ্যাস লিকেজ হলে বিস্ফোরণ ঘটে।’

সিলিন্ডার বিস্ফোরণে বছরে কতজন হতাহত হন, এ হিসাব সরকারি ও বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে নেই। পরিসংখ্যান বলছে, গত কয়েক বছরের মধ্যে দেশে সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনা বেড়েই চলেছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে এ দুর্ঘটনার হার অত্যন্ত উদ্বেগজনক। প্রতিবেশী দেশ ভারতসহ পাকিস্তানেও সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। পশ্চিমা ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে এ ধরনের ঘটনা খুব একটা ঘটে না। সচেতনতার অভাবেই উপমহাদেশে সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটছে।

দেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুত কমে আসার ফলে সিলিন্ডারে বাজারজাত এলপি গ্যাসের চুলায় রান্নাবান্নার প্রচলন দিন দিন বাড়ছে। নগর ও শহরে বসতবাড়িসহ নানা প্রতিষ্ঠানে গ্যাস সংযোগ না পাওয়ায় রান্নার কাজে সিলিন্ডারের গ্যাস ব্যবহার হচ্ছে। আয় বাড়ায় গ্রামের অনেক পরিবারও খড়ি-কাঠির চুলার পরিবর্তে ও জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করছে সিলিন্ডার গ্যাস। দিন দিন বাড়ছে জ্বালানি তরল পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) ব্যবহার। এক হিসাবে বর্তমানে দেশে এলপিজি সিলিন্ডারের ব্যবহার হচ্ছে প্রায় দেড় কোটি। সিলিন্ডারের চুলা ব্যবহার করলেও দরকারি সতর্কতার অভাবে দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছে মানুষ।

বিশেষজ্ঞদের মতে, গ্যাস সিলিন্ডারের নির্দিষ্ট আয়ু থাকে। প্রতিটি গ্যাস সিলিন্ডারের আয়ু ১০-১৫ বছর হয়ে থাকে। এ সময়ের পর সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঝুঁকি সৃষ্টি হয়। তাই আয়ু শেষ হলে সেগুলো বাতিল করা উচিত। কিন্তু ব্যবহারকারীদের মধ্যে অনেকের এ বিষয়ে যথাযথ জানাশোনা ও সচেতনতা নেই। কত বছর ধরে সিলিন্ডার ব্যবহার করা হচ্ছে, অনেক ব্যবহারকারীর কাছে সেই হিসাবও থাকে না। ফলে ঝুঁকির বিস্ফোরণের মধ্যে ব্যবহারের ফলেই ভয়াল বিস্ফোরণ ঘটে যায়।

বাংলাদেশে পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের ১১ হাজার গ্যাস সিলিন্ডার পরীক্ষা করে বিস্ফোরক পরিদপ্তর তিন বছর আগে। প্রতিষ্ঠানটি দেখতে পায়, আট হাজার সিলিন্ডারই ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে, তাই সেগুলো তখন বাতিল করা হয়। ওই সংখ্যা থেকে অনুমান করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঝুঁকির মাত্রা খুবই ব্যাপক।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!