• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

নতুন কলরেট ও শুভঙ্করের ফাঁকি!


বিশেষ প্রতিনিধি আগস্ট ১৮, ২০১৮, ০৩:৩৩ পিএম
নতুন কলরেট ও শুভঙ্করের ফাঁকি!

ঢাকা: সমতা আনার অজুহাতে মোবাইল ফোনের নতুন কলরেট চালুর ফলে ব্যাপক ক্ষোভ দেখা দিয়েছে গ্রাহকদের মধ্যে। ফলে পরিবারের সদস্য, আত্মীয় বা বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলার খরচ বেড়ে গেছে। এমনকি নারী ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাসহ করপোরেট গ্রাহকদেরও গুনতে হচ্ছে দ্বিগুণ বিল।

গ্রাহক স্বার্থ সংরক্ষেণের পরিবর্তে অপারেটরদের শত শত কোটি টাকা বাড়তি আয়ের সুযোগ করে দেয়ায় টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান বিটিআরসির ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে।

তুন এ কলরেটে সর্বনিম্ন ২৫ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৪৫ পয়সা করা হয়েছে। তবে এখানে শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে বলে মনে করেন এ খাতের অভিজ্ঞরা।

বিটিআরসির নির্দেশনা অনুযায়ী গত সোমবার মধ্যরাত থেকে মোবাইল অপারেটররা নতুন কলরেট চালু করে। নতুন নির্দেশনায় সর্বনিম্ন কলরেট ৪৫ পয়সা নির্ধারণ করা হয়, যা আগে ছিল ২৫ পয়সা। কলরেটের সর্বোচ্চ সীমা ২ টাকা অপরিবর্তিত রাখা হয়। বাতিল করা হয় অননেট ও অফনেট সুবিধা। অননেট হলো একই মোবাইল অপারেটরের নেটওয়ার্কের মধ্যে কল করার পদ্ধতি এবং অফনেট কল হলো এক নেটওয়ার্ক থেকে অন্য নেটওয়ার্কে ফোন করা।

নতুন এ কলরেট নির্ধারণের কারণ সরাসরি উল্লেখ না করলেও মূলত ২টি যুক্তি দেখায় বিটিআরসি। তাদের মতে, দেশের মোবাইল ফোন বাজারের সিংহভাগ একটি অপারেটরের দখলে থাকায় সর্বনিম্ন, অননেট, অফনেট কলরেটের সুবিধাগুলো তাদের পক্ষেই যাচ্ছিল। অন্য অপারেটরা এতে বৈষম্যের শিকার হচ্ছিল। তাই বাজারে সমতা আনতে এমনটি করা। আরেকটি যুক্তি হচ্ছে, একই নম্বর দিয়ে বিভিন্ন অপারেটরের সিম ব্যবহারের পদ্ধতি (এমএনপি) চালু করতে হলেও কলরেটে সমতা আনা প্রয়োজন।

এ প্রসঙ্গে বিটিআরসির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জহুরুল হক জানান, নতুন নিয়ম অনুযায়ী বাজারের শীর্ষে থাকা অপারেটর কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও অপেক্ষাকৃত ছোট অপারেটরদের জন্য প্রতিযোগিতামূলক বাজার নিশ্চিত হবে। উদহারণ দেখিয়ে তিনি বলেন, আগে এক অপারেটরের নম্বর থেকে অন্য অপারেটরে কথা বলার খরচ ছিল ৬০-৭০ পয়সা মিনিট। কিন্তু এখন সব অপারেটরেই ৪৫ পয়সা। অনেক গবেষণা করে এই ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।

তবে এখানে শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে বলে মনে করেন এ খাতের অভিজ্ঞরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি ফোন কোম্পানির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, এ নির্দেশনার ফলে অপারেটররা সব প্যাকেজ তো আর সর্বনিম্ন কলরেটে নামিয়ে আনবে না। বরং যে সব প্যাকেজ ৪৫ পয়সার কমে ছিল তা এক লাফে বাড়িয়ে ৪৫ পয়সা করা হবে।

তিনি বলেন, দেশের সবচেয়ে বড় অপারেটর গ্রামীণফোনের বর্তমান গ্রাহক সংখ্যা ৬ কোটি ৯১ লাখ ৭০ হাজার। এ ছাড়া রবির ৪ কোটি ৪৭ লাখ ২৯ হাজার, বাংলালিংকের ৩ কোটি ৩২ লাখ ৮২ হাজার ও টেলিটকের ৩৭ লাখ ৬৪ হাজার গ্রাহক রয়েছে। হিসেব করে তিনি দেখান, গ্রামীণফোনের ৯০ শতাংশ ও টেলিটকের মাত্র ১০ শতাংশ কল হচ্ছে অননেট। বাকি দুই অপারেটরের প্রায় ৭০ শতাংশ অননেট কল হয়ে থাকে। সে অনুযায়ী গড়ে ৬০ শতাংশ কলই অননেট। আর বাকি ৪০ শতাংশ কল অফনেট। অননেট সর্বনিম্ন ২৫ পয়সা থেকে বেড়ে ৪৫ পয়সা হলে ব্যবধান দাঁড়ায় ২০ পয়সা।

অর্থাৎ মোট কলের ৬০ ভাগের খরচ ২০ পয়সা মিনিট বেড়ে যাবে। অন্যদিকে অফনেটে ৬০ পয়সা থেকে কমে ৪৫ পয়সা করা হলেও মাত্র ৪০ শতাংশ কলের খরচ প্রতি মিনিটে ১৫ পয়সা কমবে। বিটিআরসিকে কাজে লাগিয়ে এভাবে কোম্পানিগুলো শত শত কোটি টাকা বাড়তি আয়ের সুযোগ পেল বলে মন্তব্য করেন তিনি।

বিভিন্ন মোবাইল ফোন অপারেটরের প্যাকেজ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এতদিন নিজ অপারেটরের মধ্যে কথা বলা ছাড়াও পরিবারের সদস্য, বন্ধুবান্ধব, নারী উদ্যোক্তা, এসএমই, করপোরেটসহ বিভিন্ন প্যাকেজে ২৫, ৩০ বা ৪০ পয়সা মিনিটে কথা বলার সুযোগ পেতেন গ্রাহকরা। নতুন এ নিয়ম চালুর ফলে এসব প্যাকেজের গ্রাহকরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

খিলগাঁওয়ের গৃহিণী সুমাইয়া ইসলাম বলেন, আগে বাংলালিংকের একটি ফ্যামিলি প্যাকেজের কারণে কম পয়সায় গ্রামের বাড়িতে মা-বাবার সঙ্গে কথা বলতে পারতাম। এখন দেখি ফোনের বিল দ্বিগুণ হয়ে গেছে।

টেলিটকের অপরাজিতা সিমের গ্রাহক নারী উদ্যোক্ত তাসলিমা আক্তার জানান, আগে ব্যবসায়িক যোগাযোগের ক্ষেত্রে এ সিমের কলরেট বিশেষ সুবিধা দিত। এখন আর সে সুবিধা পাচ্ছি না। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন প্রায় সব গ্রাহকই।

ঢাকা ফাইবার নেটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জিয়াউদ্দিন কায়সার জানান, তার প্রতিষ্ঠানের ৪০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে একটি মোবাইল কোম্পানির করপোরেট সিম দিয়েছিলেন তিনি। তাতে মাত্র ৩০ পয়সা মিনিটে তারা নিজেদের মধ্যে কথা বলতে পারতেন। কিন্তু এখন মাসে তাদের ফোন বিল অনেক বেড়ে যাবে।

কলরেট বেড়ে যাওয়া নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ অপারেটরদের ফেসবুক পেইজে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করতে দেখা যাচ্ছে অনেক গ্রাহককে। গ্রামীণফোনের ভেরিফায়েড পেজে একজন গ্রাহক প্রশ্ন করেন, আমি ১৫ দিনের ফ্লেক্সিপ্ল্যান করেছি ৩০০ মিনিট ১২৮ টাকা দিয়ে। এখন কি তা পারব? উত্তরে গ্রামীণফোন থেকে লেখা হয়, দুঃখিত, সর্বশেষ নির্দেশনা অনুসারে কলরেট, ভয়েস প্যাক, ভয়েস অফার এবং ভয়েস ব্যালেন্সের পরিবর্তন হয়েছে। ৩০০ মিনিট ১৫ দিন এখন ২০৫ দশমিক ৫৭ টাকা (ভ্যাট, এসডি, এসসিসহ)।

এ প্রসঙ্গে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার গত মঙ্গলবার এক অনুষ্ঠানে বলেন, সার্বিক বিচারে আমরা কলরেট বাড়াইনি। অননেটে বাড়লেও অফনেটে কমেছে। আমরা সুস্থ প্রতিযোগিতা চাই। এ ছাড়া আমরা এমএনপি বা নম্বর বহাল রেখে অপারেটর পরিবর্তনের সেবা চালু করতে যাচ্ছি। এ ক্ষেত্রে অফনেট ও অননেট বিভাজন চালু থাকলে সমস্যা হতো।

তিনি বলেন, আগে অফনেটে সর্বনিম্ন কলচার্জ প্রতি মিনিট ৬০ পয়সা থাকলেও গ্রাহককে ৯১ পয়সা থেকে ১ টাকা ৪০ পয়সা দিতে হতো। এখন অননেট গ্রাহকদের ব্যয় কিছুটা বাড়লেও অফনেট কলের ক্ষেত্রে সমস্যা দূর হয়েছে। এতে বেশির ভাগ অপারেটরের গ্রাহকরা উপকৃত হবেন বলে মন্তব্য করেন তিনি।


সোনালীনিউজ/ঢাকা/আকন

Wordbridge School
Link copied!