• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

নতুন সরকার : প্রত্যাশার নতুন দিগন্ত


আফরোজা পারভীন জানুয়ারি ২১, ২০১৯, ০১:৫৩ পিএম
নতুন সরকার : প্রত্যাশার নতুন দিগন্ত

ঢাকা : অনেক শঙ্কা, অনিশ্চয়তা, দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র কাটিয়ে দেশে একটা চমৎকার সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে। ইতোমধ্যে শপথ নিয়েছে নতুন সরকার। অংশগ্রহণমূলক এই নির্বাচন পেয়ে আমরা আনন্দিত। আনন্দিত এজন্য যে, অনেক দল এবার নির্বাচনে অংশ নিয়েছে, ভোটকেন্দ্রে প্রচুর ভোটারের সমাগম হয়েছে।

আমরা নতুন বছরে নতুন সরকার পেলাম। পেলাম পূর্ববর্তী সরকারকে নতুন করে। কাজেই আশা করছি উন্নয়নের ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ন থাকবে। সংযোজন হবে নতুন নতুন উন্নয়ন পরিকল্পনা। আর শুধু উপরিকাঠামোর উন্নয়ন নয়, উন্নত হবে মানবিক কাঠামোরও। মানুষের নিরাপত্তা, ভালোবাসা, আবেগের জায়গাগুলোকে সজীব করার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেবে সরকার। নেবে সচেতনতামূলক পদক্ষেপ। দেশে উন্নয়ন হয়েছে, হচ্ছে কোনো সন্দেহ নেই। নিজ উদ্যোগে নিজ অর্থে পদ্মা সেতু বানানো কোনো কথার কথা নয়। সেটাও আমরা নির্মাণ করে দেখাচ্ছি বিশ্বাবাসীকে। কিন্তু  আজ আমি বলব, একটু ভিন্নরকম মানবিক চাহিদার কথা।

‘জিরো টলারেন্স’ শব্দটি এখন বহুল প্রচলিত। এর একটা চমৎকার বাংলা করা হয়েছে ‘শূন্য সহিষ্ণু নীতি’। কথাটা সরকারপ্রধান  থেকে শুরু করে সরকারের কর্মকর্তারা বলে থাকেন। নির্বাচনের আগে বারবার শোনা গেছে নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের মুখে। শব্দটির সহজ বাংলা করলে দাঁড়ায়, কোনো অবস্থাতেই সহ্য করা বা ছাড় দেওয়া হবে না। জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ, খুন জখম রাহাজানি, আইনশৃঙ্খলার ক্রমাবনতি বা সংখ্যালঘু নির্যাতন প্রসঙ্গে কথাটি প্রায়শই উচ্চারিত হয়। যখন জোরেশোরে উচ্চারিত হয় জনগণ খানিকটা আশ্বস্ত হয়। ভাবে, সরকার সজাগ আছে যখন, তখন বড় রকমের কোনো অঘটন হয়তো ঘটবে না। ধরা পড়ার ভয়ে অপরাধীরা সমঝে চলবে। ধরা পড়লে ভয়ানক সাজা পাবে। এসব চিন্তায় অপরাধপ্রবণতা কমে যাবে।

জঙ্গি, সন্ত্রাসবাদ ও সহিংসতা, চরমপন্থা মোকাবেলায় বাংলাদেশের নীতি ‘জিরো টলারেন্স’। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক কোনো জঙ্গি বা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী যাতে দেশে ঘাঁটি গড়তে না পারে, এজন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের আবহমান সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সব সময়ই সন্ত্রাস ও মৌলবাদের বিপক্ষে। এসব কথাও প্রায়শই উচ্চারিত হয়। আর এর ব্যত্যয়ে বাংলাদেশ ‘জিরো টলারেন্স’ সেটাও আমরা অহরহ শুনি।

কিন্তু বাস্তব চিত্র তা নয় মোটেও। সরকার জিরো টলারেন্সের ঘোষণা দেয়।  সংবাদপত্রের বড় কলাম জুড়ে সে খবর বের হয়।  টেলিভিশনের স্ক্রলে প্রচারিত হতে থাকে। অপরাধী কখনো কখনো গ্রেফতার হয়। আবার জামিনও পায়। দেশত্যাগও করে। ঠিক তখনই কোথাও না কোথাও অপরাধ সংঘটিত হতে থাকে। সে অপরাধের ছবি খবরসহ বের হয়, দুই-চার দিন তার আপডেট পায় মানুষ, উদ্বিগ্ন হয়, বিচার চায়, টকশোর টেবিল তোলপাড় হয়। বড় সড় ঘটনা হলে সভা সমাবেশ, মানববন্ধনও হয় কখনো-সখনো। যেমন সম্প্রতি অরিত্রির আত্মহত্যার ঘটনা, অদূর অতীতে তনু হত্যার ঘটনা। এরপরই নতুন আরেকটি ঘটনা এসে  আগের ঘটনাটিকে বিস্মৃতির গহনে ঠেলে দেয়। যেন ঘটনাটি ঘটেইনি কোনো দিন।

যেমন— নীহার বানু, শারমিন, ছালেহা হত্যার কথা আমরা ভুলে গেছি। সাগর-রুনি,  বিশ্বজিৎ, ত্বকী, নারায়ণগঞ্জের সাত খুন, তনু, মিতু, রিসা, আফসানা, খাদেজার নাম ভুলতে বসেছি। যেন এমন কোনো নাম কোনোদিন ছিলই না। কোনো ঘটনাই কখনো ঘটেনি। মিতু আর তনুর ঘটনা দুটি খুব মনে পড়ে। স্কুল বাসে বাচ্চা তুলে দিতে এসে খুন হলো মিতু। দেশজুড়ে কত তোলপাড়, কত কিছু। তারপর কয়েকটা দিন যেতে না যেতে মিতুকে সবাই ভুলে গেল। বাবুল আকতার দিব্যি চাকরি করছে। অপরাধী যে কে? তাই-ই আজ পর্যন্ত জানতে পারলাম না আমরা। তনুকে নিয়ে কত আন্দোলন, কত বিক্ষোভ, সভা সমাবেশ, বিচার চাওয়া এবং না পাওয়া। তনুর মাকে বারবার পুলিশ অফিসে নিয়ে গিয়ে জেরার নামে হেনস্থা। তিনি তো স্পষ্ট বলেছিলেন কাদের সন্দেহ করেন তিনি।  কিন্তু কেউ যেন শুনেও শুনল না তার কথা। যেন চেষ্টা করাতে লাগল আর কারো নাম বলাবার। ভাবখানা এমন— আমাদের আর কী? তনু রিসা, মিতু নীহারতো আমাদের কেউ না। আর এসব যা ঘটল সবই জিরো টলারেন্সের মধ্যেই।

২০১৩ সালে ঘটে যায় শ’ খানেক জঙ্গি হামলা। অভিজিৎ, দীপন, রাজীব হায়দার, নিলাদ্রী চট্টোপাধ্যায়, অনন্ত বিজয় দাস, আর ওয়াশিকুর রহমান বাবুর হত্যা এখন আমরা ভুলতে বসেছি।  মায়ের পেটে গুলিবিদ্ধ হলো শিশু, এমপি সাহেব মাতাল অবস্থায় গুলি চালালেন ৭ বছরের শিশুর পায়ে, এমপিপুত্র জ্যামের জ্বালায় অস্থির হয়ে গুলি চালালেন রিকশা চালকের গায়ে। আর এক এমপি আত্মীয়স্বজনসহ প্রথম হলেন ইয়াবা, মানবপাচার আর মাদকের ব্যবসায়। হাতেগোনা কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। অনেকে সগর্বে জামিন নিয়ে বেরিয়ে এসেছেন। সাজার রায়ও হয়েছে তাদের কারো কারো বিরুদ্ধে। তবে পদ হারাননি কেউ শপথ থেকে বিচ্যুত হয়েও। আর সবই ঘটছে জিরো টলারেন্সের মধ্যেই।

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা বলি আমরা। নাসিরনগর আর গোবিন্দগঞ্জে ১৫টি মন্দির ভাঙল, শ’খানেক হিন্দুবাড়িতে আগুন দেওয়া হলো। নাসিরনগরের ঘটনায় উৎসাহিত হয়ে প্রতিমা ভাঙচুর হলো ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা, বরিশালের বানারীপাড়া আর নেত্রকোনার কলমাকান্দাসহ আরো বেশ কয়েকটি স্থানে। ২০০১ সালের পর ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে কক্সবাজারের রামুতে, ২০১৩ সালের ২ নভেম্বর পাবনার সাঁথিয়ায়, ২০১৪ সালের ২৮ এপ্রিল কুমিল্লার হোমনায় এবং ৫ জানুয়ারি যশোরের অভয়নগরের মালোপাড়ায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর  নৃশংস হামলা হয়েছে। কিন্তু  যারা করেছে তারা  জানে যে, অন্যায় করে পার পাওয়া যায়। হিন্দু বাড়ি পোড়া শেষ না হতেই আগুন জ্বলে উঠল গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার সাঁওতালপাড়ায়। সাঁওতালরা উচ্ছেদ হলো, জীবন আর সহায় সম্বল হারাল, নিজ জমিতে বোনা ফসল কেটে নিয়ে গেল দেশিবর্গীরা। অনুসন্ধানে যাই-ই পাওয়া যাক না কেন, মামলা দেওয়া হলো দুর্বল সাঁওতালদের নামে। কোমরে দড়ি বেঁধে আর হ্যান্ডকাফ পরা অবস্থায় হাসপাতালে আশ্রয় নিল স্বজন আর সম্পদ হারানো আহত সাঁওতালরা। সাঁওতালদের মামলা অবশ্য নিয়েছিল পুলিশ ১১ দিন পরে।

জিরো টলারেন্স আসলে কী? কাদের স্বার্থ রক্ষায়? এর ভিকটিম কারা? এটা কি শুধুই বলার জন্য বলা একটি কথা? জিরো টলারেন্স কি সাধারণ মানুষের জন্য, যাদের কোনো দল নেই, বল নেই, করার কিছু নেই বা যারা ভিন্ন মতের, স্বভাবতই নাজুক অবস্থানের, তাদের জন্য? প্রশ্নগুলোর উত্তর যাই হোক না কেন, দেশের সার্বিক মানবাধিকার ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কিন্তু মোটেও আশাব্যঞ্জক নয়। যা স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়, দেশে নিরাপদ বলয়ে বাস করা মানুষের সংখ্যা ক্রমেই কমে আসছে। তাই মানুষ ক্রমাগত দেশ ছাড়ছে। ক্ষমতার কাছাকাছি থাকার সুবাদে কিছু মানুষ হয়তো এখনো নিরাপদে আছেন, কিন্তু দেশের সার্বিক নিরাপত্তা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটানো না গেলে প্রত্যেকেরই নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে। আর সেদিন বোধহয় খুব দূরে নয়, যেদিন মিতু তনু বা দীপন হবেন তাদের নিজের ঘরের কেউ!

ঘুষ, দুর্নীতি, রাহাজানি, নিরাপত্তাহীনতা লক্ষণীয়ভাবে বেড়েছে। প্রতিটি অফিসে সিটিজেন চার্টার আছে, অভিযোগ বক্স খোলা হয়েছে, সিসি ক্যামেরা আছে। সরকারের প্রচেষ্টার অন্ত নেই। তারপরও টাকা ছাড়া নড়ে না একটা নথি। একটা কাজের জন্য দিনের পর দিন বছরের পর বছর ধর্ণা দিতে হয়। রাস্তাঘাটে মোবাইল, টাকা-পয়সা, গহনা ছিনতাই হচ্ছে অহরহ। বাস উবার ট্যাক্সি কোনো যানবাহনেই নিরাপদ নয় নারী। দুর্ঘটনা বেড়েছে অবিশ্বাস্যভাবে। জঙ্গিবাদ নির্মূল করা যায়নি। বাতাসের মতো হু হু করে তারা ঢুকছেই। কোন উৎস থেকে তারা আসে সেই উৎসের সন্ধান করা দরকার। যানজট আর রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির কথা আর নাইবা বললাম। প্রয়োজন কার্যকর মোটিভেশনাল কর্মসূচি। অবকাঠামোর উন্নয়ন আর পয়সা থাকলেই যদি দেশ উন্নত হতো, তাহলে সৌদি আরবই হতো বিশ্বের সেরা উন্নত মানবিক দেশ।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারে এসব মানায় না। আমরা জানি তিনি নিজে অসম্ভব রকম সৎ একজন মানুষ। মানুষের মঙ্গল চিন্তাই তার আরাধ্য। তারপরও দেশে এসব অপরাধ অহরহ ঘটছে। একটা গোটা দেশ, একটা বিশাল প্রশাসনযন্ত্র কোনো একক মানুষের পক্ষে সম্ভব না। চারপাশে যে মানুষ আছে তাদেরও সৎ আর দায়িত্বশীল হতে হয়, হতে হয় দেশপ্রেমিক। নিজে যদি কেউ দুর্নীতি না করে, দুর্নীতি করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার অঙ্গীকার করে, তাকে কেন্দ্র করে কোনো দুর্নীতি আবর্তিত হয় না। আর এভাবেই ধীরে ধীরে দুর্নীতিমুক্ত হয় দেশ। আমরা বিদেশে যেতে চাই না, দেশেই শান্তিতে থাকতে চাই।

একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আপনি উপহার দিয়েছেন। দেশ-বিদেশের স্বীকৃতি আপনি পেয়েছেন। আমরা সবাই আনন্দিত। কিন্তু একই সাথে অনুরোধ, অপরাধমুক্ত করুন দেশটাকে। ঝেড়ে ফেলুন আগাছা আর বেইমানদের।

অভিনন্দন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। স্বাগত নতুন সরকার।

লেখক : কথাসাহিত্যিক, সাবেক যুগ্ম সচিব

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!