• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
লাহিড়ীরহাট গণহত্যা দিবস আজ

নামাজ শেষ হতেই শুরু হয় পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞ


ফরহাদুজ্জামান ফারুক, রংপুর ব্যুরো মে ৭, ২০১৮, ১১:৩২ এএম
নামাজ শেষ হতেই শুরু হয় পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞ

রংপুর: মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে রংপুরে এক বেদনাবিধুর দিন একাত্তরের ৭ মে। সেদিন ছিলো শুক্রবার। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী রংপুরের লাহিড়ীরহাট নামক স্থানে এক পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠেছিলো। লাশের নেশায় মত্ত পাকিস্তানী বাহিনীর যঘণ্য তান্ডবে ৩২ জন নিরীহ মানুষের রক্তের ললাটে ভরেছিলো শুকনো মাটি।

রংপুর শহর থেকে প্রায় ১৪ কিলোমিটার দূরে লাহিড়ীরহাট এলাকায় জুম্মার নামাজের পর নিরীহ মানুষজনকে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যাকান্ড চালায় হায়েদার দল। স্বাধীনতার পর থেকে রংপুরের মানুষ বেদনাবিধুর সেই ৭ মে-তে ‘লাহিড়ীরহাট গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালন করে আসছে।

৭ মে শুক্রবার, দিনটি ছিল ১২ রবিউল আউয়াল, পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী। এমন একটি দিনে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী কোনো আক্রমণ করবে না- এমন সরল বিশ্বাসে জুমার নামাজ ও মিলাদ পড়ার উদ্দেশ্যে পালিয়ে যাওয়া অনেক মানুষ নিজ নিজ বাড়িতে ফিরে আসেন। এদিকে পাকিস্তানী সৈন্যরাও এই দিনটিকে সামনে রেখে আক্রমণের পরিকল্পনা করে।

পরিকল্পনা মোতাবেক তারা দেওডোবা ও বড়োবাড়ি থেকে শুরু করে দামোদরপুর পর্যন্ত ঘরে ঘরে তল্লশি করে গ্রাবাসীদের বন্দি করতে শুরু করে। সে সময় বড়োবাড়ি গ্রামের আন্দারু মিয়াজির মসজিদে জুমার নামাজ শেষে মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত হচ্ছিল। অতর্কিতে সেখানে ৪টি ট্রাকে করে পাকিস্তানী সৈন্যরা উপস্থিত হয়। তারা ট্রাক থেকে নেমে মসজিদ ঘেরাও করে এবং কয়েকজন সৈন্য মসজিদে প্রবেশ করে মিলাদ পড়ার জন্য অবস্থানরত ৩২ জন মুসল্লিকে পিঠমোড়া করে বেঁধে বলপূর্বক মসজিদ থেকে ধরে নিয়ে যায়। মসজিদের বাকি মুসল্লিদের অনেক কাকুতি মিনতির পরও তাদের ছেড়ে দেয়া হয়নি। ভয়ার্ত মানুষদের আর্ত চিৎকারে বাতাস ভারী হয়ে ওঠে কিন্তু তাদের কান্না বর্বর পাকিস্তানী সৈন্যদের কর্ণকুহরে পৌঁছেনি।

এদিকে বন্দি ৩২ জন মুসল্লিকে রংপুর শহর থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে লাহিড়ীরহাটের পুকুর পাড়ে আনা হয়। সেখানে তখন হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। পিতা চান ছেলের প্রাণভিা, আর ছেলে চান পিতার প্রাণভিা। কিন্তু নরপশুদের মন তো গলেইনি বরং তারা পিতার সঙ্গে ছেলেকেও হত্যা করে। তারপর গভীর রাতে তারা একে একে গুলি করে ঝাঁজরা করে দেয় সবার বুক। গুলিবিদ্ধ কয়েকজন মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করছিলেন। পাকিস্তানী সৈন্যরা তখন আহতদের মাথায় বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। মসজিদ থেকে জোর করে ধরে আনা কোন মুসল্লিকেই বাঁচতে দেয়নি নরঘাতকরা।

৩২ জন মুসল্লির লাশ পড়ে থাকে লাহিড়ীরহাট বধ্যভূমিতে। সেদিন লাশ দাফন করার মতো এলাকায় ছিল না কোনো মানুষ। মুসল্লিদের লাশের পাশে বসে কোরান তেলাওয়াত করেনি কেউ । কাফনের কাপড় পরানো হয়নি সেই শহীদদের।

লাহিড়ীরহাটের জনগণ জানান, পাকিস্তানী সৈন্যরা পরবর্তী ৭ মাস প্রায় একইভাবে বিভিন্ন গ্রাম থেকে কয়েক হাজার গ্রামবাসীকে ধরে এনে রাতের বেলা লাহিড়ীরহাট বধ্যভূমিতে হত্যা করে মাটিচাপা দিয়ে রেখেছিল। তাদের পরিচয় আজো জানা যায়নি। স্বাধীনতার পর ওই স্থানের বিভিন্ন গর্ত থেকে অসংখ্য মানুষের কঙ্কাল উদ্ধার করে সসম্মানে গণকবরে সমাহিত করা হয়েছে।

৭ মে সংঘটিত নির্মম গণহত্যার সাক্ষী লাহিড়ীরহাটের বধ্যভূমি অযতœ ও অবহেলায় পড়ে আছে। সেখানে স্থানীয় জনগণ দ্বারা নির্মিত একটি স্মৃতিফলক ছাড়া আর কিছুই নেই। বধ্যভূমিতে শহীদদের স্মরণে তাঁদের নাম সংবলিত কোনো স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়নি। ফলে এই বধ্যভূমিতে শহীদ শত শত বাঙালির আত্মার হাহাকার, আর্তনাদ ও কান্নার আওয়াজ আজও গুমরে ওঠে। স্থানীয় জনগণের দাবি এই স্থানে যেন সরকারিভাবে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করে শহীদদের নামফলক স্থাপন করা হয়। ১৯৭১ সালের ৭ মে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর হাতে লাহিড়ীরহাটের পুকুরপাড়ে শহীদ ৩২ জনের মধ্যে ২৪ জন শহীদের নাম সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে।

রংপুরের মুক্তিযোদ্ধারা তৃণমূল পর্যায়ে খোঁজখবর নিয়ে যাদের পরিচয় পেয়েছেন তারা হলেন -আবেদ আলী সরকারের পুত্র মনোয়ার হোসেন বেণু (রংপুরের শহরের রাধাবল্লভ), শমসের আলী পেয়াদার পুত্র নওয়াব আলী বাপাত (সাতগাড়া মিস্ত্রীপাড়া), আব্দুল মজিদের পুত্র আব্দুল করিম (পীরজাবাদ),  শমসের আলী পানাতির পুত্র আজগর আলী (দামোদরপুর), আমীর উল্লাহ শাহের পুত্র শাহ্ সেকেন্দার আলী (দামোদরপুর), সেকেন্দার আলীর পুত্র মিন্টু মিয়া (দামোদরপুর), নয়া মিয়া প্রেসিডেন্টের পুত্র শাহ্ মোঃ নূরল আনাম (দামোদরপুর), খোদাবকস্ মৌলভীর পুত্র মোঃ আজহার আলী (দামোদরপুর), মোঃ আমিন-এর পুত্র মোঃ আজগর আলী (দেওডোবা বড়বাড়ি), মহির উদ্দিনের পুত্র মোঃ মনসুর আলী (দেওডোবা বড়বাড়ি), খট্টু শেখের পুত্র মোঃ আব্দুল জব্বার মিয়া (দেওডোবা বড়বাড়ি), নছির উদ্দিনের পুত্র আব্দুস সাত্তার (ন্যাকাড়টারী বড়বাড়ি), বাতাসু মিয়ার পুত্র মোঃ মোফাজ্জল হোসেন (ন্যাকাড়টারী বড়বাড়ি), আব্দুল মুকিতের পুত্র মোঃ নবানু মিয়া (ন্যাকাড়টারী বড়বাড়ি), মোঃ কান্দুরা মিয়ার পুত্র মোঃ আব্দুল আজিজ (ন্যাকাড়টারী বড়বাড়ি), খোকা মামুদের পুত্র মোঃ এসরাতউল্লাহ (ন্যাকাড়টারী বড়বাড়ি), মোঃ আব্দুল গফুরের পুত্র মোঃ নূরুল ইসলাম (ন্যাকাড়টারী বড়বাড়ি), করিম উদ্দিন মুন্সীর পুত্র মোঃ আব্দুস সোবহান (ন্যাকাড়টারী বড়বাড়ি), মোঃ আলিম উদ্দিনের পুত্র মোঃ ইয়াসিন আলী (ন্যাকাড়টারী বড়বাড়ি), মোঃ আলিম উদ্দিনের পুত্র মোঃ সোলায়মান মিয়া (ন্যাকাড়টারী বড়বাড়ি), হাছেন আলীর পুত্র মোঃ আব্দুর রাজ্জাক (ন্যাকাড়টারী বড়বাড়ি), মিয়াজন মিয়ার পুত্র মোঃ মনসুর আলী (ন্যাকাড়টারী বড়বাড়ি), শহর উদ্দিনের পুত্র মোঃ লুৎফর রহমান (ন্যাকাড়টারী বড়বাড়ি), আব্দুল জব্বারের পুত্র আব্দুর রহিম (ন্যাকাড়টারী বড়বাড়ি)। অন্য শহীদদের পরিচয় জানা সম্ভব হয়নি।

লাহিড়ীরহাট বধ্যভূমি-
লাহিড়ীরহাট বধ্যভূমি রংপুরের প্রধান বধ্যভূমিগুলোর মধ্যে অন্যতম। রংপুর শহর থেকে প্রায় ১৪ কিলোমিটার কিলোমিটার পশ্চিমে রংপুর-বদরগঞ্জ সড়কের পাশে লাহিড়ীরহাট বধ্যভূমির অবস্থান। এই বধ্যভূমিতে শহীদ হওয়া ব্যক্তিদের মতোই চরম অবহেলায় এখনও স্থানীয় কিছু দখলদারদের দখলে রয়েছে এ বধ্যভূমি। সামান্য একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয়েছে লাহিড়ীরহাট-শ্যামপুর রোডের পাশে একটি অংশে।

এ ছাড়া কোনো কিছুরই চিহ্ন নেই সেখানে। স্থানীয়দের দাবি মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের মানুষের ওপর যে গণহত্যা হয়েছে তার স্মারক বধ্যভূমি সংরণ করা গেলে নতুন প্রজন্ম সেই সময়কে মনে রাখবে, শ্রদ্ধা জানাতে পারবে।

এদিকে দিবসটি উপলক্ষ্যে স্থানীয় উপজেলা প্রশাসনসহ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী বিভিন্ন রজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠন নানান কর্মসূচী নিয়েছেন।


সোনালীনিউজ/ঢাকা/আকন

Wordbridge School
Link copied!