ঢাকা : রাজধানীর পুরান ঢাকার নিমতলী ট্র্যাজেডির কথা এখনো ভোলেনি দেশের মানুষ। ২০১০ সালের ৩ জুন রাতের ভয়াবহ আগুনে ১১৯ জন নিহত এবং অন্তত দুইশ মানুষ আহত হয়েছেন। বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার বিস্ফোরিত হয়ে সেখানে আগুনের সূত্রপাত হয়। এ ঘটনার পর ৫ জুন রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করা হয়। আগুন ছড়িয়ে পড়া ভবনের আশপাশের দোকানগুলো রাসায়ানিক দ্রব্যাদি ও দাহ্য পদার্থের সংস্পর্শে আরো দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
এ ছাড়া ঘনবসতিপূর্ণ হওয়ায় সেখানে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে বাধার সম্মুখীন হতে হয় ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের। নিমতলী দুর্ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরাসরি নানা উদ্যোগ নিয়েছিলেন। দুটি মেয়ের বিয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন। তার নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতেই কমিটি গঠন করা হয়েছিল। পুনর্বাসনের ব্যাপারে কমিটির দায়িত্বে থাকা ফায়ার ব্রিগেডের তৎকালীন ডিজি বাড়ির মালিক, ব্যবসায়ী, শ্রমিক সবাইকে নিয়ে বসেছিলেন। তিনি ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত ও নিহতদের পরিবারের প্রতি তার গভীর সমবেদনা জানান। কিন্তু রহস্যজনক কারণে ঘনবসতিপূর্ণ ওই এলাকা থেকে দাহ্য ও রাসায়ানিক পদার্থ সরানো হয়নি।
ভয়াবহ ঘটনাটি না ভুলতেই চলতি বছরের গত ২০ ফেব্রুয়ারি বুধবার রাতে ঘটে চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডি। সেখানে শাহী মসজিদের সামনে ৬৩ নন্দ কুমার দত্ত রোডে হাজী ওয়াহেদ ম্যানসনের সামনে দাঁড়ানো একটি পিকআপের সিলিন্ডার বিস্ফোরণের পর আশপাশের ভবনে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। ভয়াবহ আগুনে ৮১ জন নিহত, শতাধিক আহত ও ৩৬ জন নিখোঁজের খবর মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে।
পিকআপের সিলিন্ডার বিস্ফোরণের পাশে ছিল একাধিক সিএনজি অটোরিকশা। সেসব সিএনজির সিলিন্ডারও তাৎক্ষণিক বিস্ফোরিত হয়। দাঁড়িয়ে থাকা পিকআপ ওয়াহেদ ম্যানসনের দ্বিতীয় তলার একটি গুদাম থেকে বডি স্প্রের কার্টনে ভরা হচ্ছিল। শাহী মসজিদের সামনের সরু তিন রাস্তার মোড়ে ছিল ভয়াবহ যানজট। ফলে মুহূর্তে যানজটে আটকা শতাধিক যাত্রীবাহী রিকশা, প্রাইভেট কার, মোটর সাইকেল এবং পায়ে হাঁটা পথচারীর শরীরে আগুন ধরে যায়। আগুন ছড়িয়ে পড়ে ওয়াহেদ ম্যানসনের দ্বিতীয় তলার স্প্রে গুদামে এবং পাশের ৬৪ নম্বর ভবনের রাজমহল হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টে।
এ সময় হোটেলের সিলিন্ডার এবং গুদামের স্প্রে ক্যানের বিস্ফোরণ ভয়াবহ আগুনের সৃষ্টি করে। পাশের ১৫ নম্বর ভবনের রহমানিয়া হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টে আগুন লেগে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়। এক পর্যায়ে ওয়াহেদ ম্যানশন সংলগ্ন জামাল কমিউনিটি সেন্টার ও রাস্তার উল্টোপাশে থাকা দুটি ভবনসহ রাস্তার দু’পাশের পাশাপাশি ৫টি ভবন তখন দাউদাউ করে জ্বলছিল।
ঘটনাস্থলে থাকা ব্যক্তিদের চোখে এটা এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতি ছিল। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের ৩৭ ইউনিটের কর্মী ও বিমানবাহিনীর দুটি হেলিকপ্টার দিয়ে পানি ছিটিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালায়। কিন্তু গ্যাস সিলিন্ডার ও স্প্রে ক্যানের বিস্ফোরণ মারাত্মক আকার ধারণ করায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হয়েছে। ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা ৮১টি লাশ ও আহতদের উদ্ধার শেষে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করে।
পরদিন শুক্রবার সকালে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স) মেজর একেএম শাকিল নেওয়াজ এক ব্রিফিংয়ে বলেন, ‘আগুন নিভেছে। বিভিন্ন কেমিক্যাল, বডি-স্প্রে, প্লাস্টিক দ্রব্যের কারণে আগুন ছড়িয়েছে। আর সরু রাস্তার কারণে আগুন নেভানোর কাজে সমস্যা হয়েছে।’ খবরে প্রকাশ, প্রথমে সাত তলার ওয়াহেদ ম্যানশনে আগুন লাগে। ভবনটির দ্বিতীয় তলায় কেমিক্যাল গোডাউন এবং প্লাস্টিক তৈরির উপকরণের দোকান রয়েছে। ভবনটির পাশের ওয়াহিদ ম্যানশনে আমানিয়া হোটেল, রাজ হোটেল এবং উল্টা পাশের চারটি বাসায় আগুন ছড়িয়েছে।
ঢাকা ছাড়াও গত কয়েক দিনে চট্টগ্রাম, সিলেট, কুমিল্লাসহ আরো কয়েকটি স্থানে আগুনের ঘটনা ঘটে। বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট ও জনবহুল এলাকায় দাহ্য পদার্থ রাখায় আগুনের ঘটনা অহরহ ঘটেছে। আগুন লাগার পর অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র না থাকায় তাৎক্ষণিক আগুন নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয় না। বারবার বাসাবাড়ি ও কারখানায় সৃষ্ট আগুনে মানুষ প্রাণ হারালেও কারো কোনো মাথাব্যথা দেখা যাচ্ছে না। সবাই দায় এড়ানোর চেষ্টায় সক্রিয় রয়েছে।
দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের চেয়ারম্যান ড. কামাল হোসেন, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতারা চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডিতে আহতদের দেখতে গেছেন। সবাই আহতদের সান্ত্বনা দিয়েছেন। সরকার আহতদের চিকিৎসা ব্যয় ও নিহতদের জন্য ক্ষতিপূরণ দিয়েছে। কিন্তু ক্ষতিপূরণই কি সব? এর মাধ্যমেই কি সব সমস্যার সমাধান সম্ভব? প্রশ্নগুলো এখন নিজেদের বিবেকের কাছে করা জরুরি হয়ে উঠেছে।
রাষ্ট্রের সেবা সংস্থাগুলোর দায়িত্বহীনতার কারণেই প্রাণ দিতে হয়েছে সাধারণ মানুষকে। যারা এর জন্য কোনোভাবেই দায়ী নয়। নিমতলীর ঘটনার পরও রাসায়নিকের মতো বিপজ্জনক দাহ্য পদার্থ নিয়ে শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং সিটি করপোরেশনের অবহেলাই দায়ী বলে অনেকে মন্তব্য করেন। সেবা সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতার কারণে ঢাকার মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে।
নিমতলী ও চুড়িহাট্টা আগুনের মতো ভয়াবহ দুর্ঘটনা এড়াতে রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন নাগরিক সেবা একক প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে আনা দরকার। এতে করে মানুষ নির্মমভাবে মৃত্যু থেকে রেহাই পাওয়া সম্ভব হবে। একে অপরকে দোষারোপ না করে ভয়াবহ আগুনের দুর্ঘটনা রোধে সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এগিয়ে আসতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক
*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।
আপনার মতামত লিখুন :