• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে টিআইবি

নিরাপদ ব্যাংকিং ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় ১০ দফা সুপারিশ


নিজস্ব প্রতিবেদক সেপ্টেম্বর ২২, ২০২০, ০৬:৩৭ পিএম
নিরাপদ ব্যাংকিং ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় ১০ দফা সুপারিশ

ফাইল ছবি

ঢাকা: দেশে গত এক দশকে প্রতি বছরে গড়ে নয় হাজার ৩৮০ কোটি টাকা ঋণ খেলাপি হয়েছে। অর্থাৎ এই সময়কালে খেলাপী ঋণ বৃদ্ধির পরিমাণ প্রায় ৪১৭ শতাংশ। ঋণ খেলাপিদের অনুকূলে বারবার আইন সংশোধন ও নীতি প্রণয়ন ব্যাংকিং খাতকে ঋণ খেলাপি বান্ধব করেছে এবং খেলাপি ঋণকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করেছে যা নিয়মিত ঋণ গ্রহীতাকেও খেলাপি হতে উৎসাহিত করছে বলে মনে করছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।

মঙ্গলবার (২২ সেপ্টম্বর) “ব্যাংকিং খাত তদারকি ও খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ: বাংলাদেশ ব্যাংকের সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়” শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষ্যে এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে এ মন্তব্য করেছে টিআইবি।

সংস্থাটির মতে, সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণ আদায়ে যথাযথ ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় বিপুল পরিমাণের খেলাপি ঋণ ব্যাংকিং খাতে বিশেষত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে চরম মূলধন সংকট তৈরি করেছে। আর এই সংকট কাটাতে প্রতিবছর রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে জনগণের করের টাকা থেকে ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ কিছু মানুষের অনিয়ম-দুর্নীতির বোঝা ক্রমাগতভাবে জনগণের উপর চাপানো হচ্ছে।

সংবাদ সম্মেলনে ঋণ খেলাপি হওয়া এবং তা আদায়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের দূর্বল তদারকি ব্যবস্থার সমালোচনা করে ব্যাংকিং খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করে সুস্থ ও নিরাপদ ব্যাংকিং ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় ১০ দফা সুপারিশ প্রদান করে টিআইবি।

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এবং নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের। গবেষণা প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান। গবেষণা দলের অপর সদস্যরা হলেন এই বিভাগের ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার  মো. জুলকারনাইন ও অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রোগ্রাম ম্যানেজার অমিত সরকার। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক শেখ মনজুর-ই-আলম।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, সার্বিকভাবে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ ও তদারকি কর্মকা-ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সুশাসনের চ্যালেঞ্জসমূহ পর্যালোচনা করে প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে সুপারিশ প্রণয়ন করা এই গবেষণার মূল উদ্দেশ্য। গবেষণার জন্য ২০১০ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সময়  বিবেচনা করে ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২০ সালের মার্চ পর্যন্ত তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে এবং রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহ নিয়ন্ত্রণ বিশেষত ঋণ ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি ভূমিকা সুশাসনের বিভিন্ন সূচকের আলোকে পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বিপুল পরিমাণের খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ, ব্যাংকিং খাতের স্থিতিশীলতা রক্ষা এবং আমানতকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি কার্যক্রমের ক্ষেত্রে প্রধানত দুই ধরনের সুশাসনের চ্যালেঞ্জ রয়েছে। একটি হলো বাহ্যিক প্রভাবÑ যার মধ্যে রয়েছে আইনি সীমাবদ্ধতা, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও ব্যবসায়িক প্রভাব এবং অপরটি হচ্ছে অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জÑ যার মধ্যে রয়েছে তদারকি সক্ষমতায় ঘাটতি, নেতৃত্বের সক্ষমতায় ঘাটতি, বাংলাদেশ ব্যাংকের কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতায় ঘাটতি এবং তদারকি কাজে সংঘটিত অনিয়ম দুর্নীতি।

গবেষণায় দেখা যায়, সরকারি নীতি ও কৌশলসমূহে খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ, ব্যাংকিং খাত সংস্কার ও নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানের অধিকতর সুশাসনের কথা বলা হলেও এগুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছার ঘাটতি রয়েছে। একদিকে ব্যবসায়ীদের ইচ্ছায় সরকার কর্তৃক তাদের অনুকূলে আইন পরিবর্তন এবং রাজনৈতিক বিবেচনায় অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে ব্যাংকিং খাতে ব্যবসায়ীদের অবাধ প্রবেশ ও নিয়ন্ত্রণের সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে নানা আইনী বাধা, সদিচ্ছার ঘাটতি ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বের অভাবে বাংলাদেশ ব্যাংক তার প্রাপ্ত ক্ষমতা চর্চায় ব্যর্থ হচ্ছে। এছাড়া তদারকির সক্ষমতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ঘাটতি ও তদারকি কার্যক্রমে অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে ব্যাংকিং খাতের নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্রমশ অবনমন ঘটেছে এবং প্রতিষ্ঠানটি স্বার্থসংশ্লিষ্টদের আজ্ঞাবাহীতে পরিণত হচ্ছে। পাশাপাশি সরকারের সদিচ্ছার ঘাটতি এবং রাজনৈতিক প্রভাব ও হস্তক্ষেপের কারণে ব্যাংকিং খাতে আইনের লঙ্ঘন ও অনিয়ম-দুর্নীতির মাত্রা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। যার মাধ্যমে সমগ্র ব্যাংকিং খাতে কয়েকটি ব্যবসায়ী গ্রুপের পরিবারতন্ত্র বা গোষ্ঠীতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পেয়েছে এবং সিন্ডিকেটের মাধ্যমে এসব গোষ্ঠী বা পরিবার রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি ব্যাংক থেকে আমানতকারীদের হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ হিসেবে নিজেদের ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানের দখলে নিয়ে যাচ্ছে। খেলাপি ঋণ অনুৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ ও বিদেশে অর্থ পাচার জাতীয় অর্থনীতির বিকাশে ব্যাংকিং খাতের কাক্সিক্ষত ভূমিকাকে ব্যাহত করছে।

গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, বিভিন্ন সময়ে খেলাপি ঋণ হ্রাস এবং ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হলেও তা কার্যকর না করে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক বার বার ঋণ পুনঃতফসিলীকরণ ও পুনর্গঠনের সুযোগ প্রদান করা হয়। সর্বশেষ ২০১৯ সালের মে মাসে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি নির্দেশনায় খেলাপি ঋণের মাত্র দুই শতাংশ ফেরত দিয়ে পুনঃতফসিলীকরণের মাধ্যমে ১০ বছরের মধ্যে ঋণ পরিশোধের সুযোগ প্রদান করা হয়। এভাবে পুনঃতফসিলের মাধ্যমে খেলাপি ঋণ আদায় না করেই সেপ্টেম্বর ২০১৯ হতে প্রায় ২৪ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ কমিয়ে মার্চ ২০২০ পর্যন্ত ৯২ হাজার ৫১০ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ হিসেবে দেখানো হয়। ঋণ খেলাপিদের বিভিন্ন ধরনের সুযোগ সুবিধা প্রদান ও খেলাপি ঋণ কম দেখাতে বিবিধ কৌশল অবলম্বন সত্ত্বেও জুন ২০২০-এ খেলাপি ঋণের পরিমাণ পুনরায় বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৯৬ হাজার ১১৭ কোটি টাকা। অথচ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকসমূহের খেলাপি ঋণের কারণে সৃষ্ট মূলধন ঘাটতি মেটাতে ২০১২-১৩ অর্থ বছর থেকে ২০১৭-১৮ অর্থ বছর পর্যন্ত সরকার কর্তৃক ১২ হাজার ৪৭২ কোটি ৮৭ লক্ষ টাকা ভর্তুকি প্রদান করা হয়।

গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, বিশেষজ্ঞদের মতে প্রয়োজনীয়তা না থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র রাজনৈতিক বিবেচনায় ২০০৯ সালের পর থেকে রাজনতৈকি প্রভাবরে কারণে বাংলাদশে ব্যাংক ১৪টি নতুন ব্যাংকের অনুমোদন প্রদান কর।ে বিভিন্ন ব্যাংকের তদারকি কার্যক্রমেও রাজনৈতিক প্রভাব ও হস্তক্ষেপ লক্ষ্য করা যায়। অনেক সময়ই বাংলাদেশ ব্যাংক যে কোনো ব্যাংকের অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে গেলে শীর্ষ পর্যায়ের বিভিন্ন মন্ত্রী/মন্ত্রণালয় থেকে টেলিফোনে চাপ প্রয়োগ করে ব্যবস্থা গ্রহণে বাধা দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। ব্যাংক উদ্যোক্তাদের অধিকাংশ সরাসরি ক্ষমতাসীন দলের অংশ বা সরকারের ঘনিষ্ঠ হওয়ার ফলে আইন লঙ্ঘন করলেও অনেক ক্ষেত্রে তাদের ছাড় দেওয়া হয়ে থাকে।

গবেষণায় বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীন নিয়ন্ত্রণ ও তদারকি কার্যক্রমে বাহ্যিক প্রভাব বিশ্লেষণ করতে গিয়ে আইন ও নীতি কাঠামোর সীমাবদ্ধতা, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। বিশেষ করে ব্যাংকিং খাত নিয়ন্ত্রণ ও তদারকির জন্য বিদ্যমান আইনী কাঠামোতে বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা প্রত্যক্ষভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতাকে খর্ব করে, নিয়ন্ত্রণ ও তাদরকি কার্যক্রমকে দুর্বল বা সীমিত করে এবং রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের হস্তক্ষেপের সুযোগ সৃষ্টি করে। পাশাপাশি ‘ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি’র সংজ্ঞা এবং উপযুক্তমাত্রায় শাস্তি নির্ধারণ না করায় সরকার কর্তৃক খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধারে ঋণ খেলাপিদের জন্য প্রদত্ত সুবিধাদি ও প্রণোদনাসমূহ সংশ্লিষ্ট সকলের জন্য প্রযোজ্য হওয়ায় ঢালাওভাবে ইচ্ছেকৃত ঋণখেলাপিরাও ভোগ করে থাকে। একক ব্যক্তি বা গ্রুপ একটি ব্যাংক থেকে সর্বোচ্চ কী পরিমান ঋণ গ্রহণ করতে পারবে তা একক বৃহত্তম ঋণসীমা নীতিমালায় নির্ধারিত হলেও সার্বিকভাবে ব্যাংকিং খাতে ব্যক্তি ও গ্রুপের সর্বোচ্চ ঋণসীমা নির্ধারণ উল্লেখ না থাকার সুযোগে ঋণ গ্রহীতারা বিশেষত ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপিরা বিভিন্ন কৌশল ও যোগসাজশের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যাংক হতে ঋণ বের করে নিচ্ছে; যার উল্লেখযোগ্য অংশ পরবর্তিতে খেলাপি হয়ে পড়ছে। আবার আগ্রাসী ব্যাংকিংয়ের কারণে সৃষ্ট তারল্য সংকট কাটাতে বিভিন্ন অজুহাতে এডিআর এর হার বৃদ্ধি, নগদ জমা সংরক্ষণ (সিআরআর) ও রেপো রেট হ্রাসের ঘটনা লক্ষ্য করা যায় এবং সম্প্রতি সময়ে করোনা পরিস্থিতিতে ‘ইন্টার্নাল ক্রেডিট রিস্ক রেটিং’কে শিথিল করে ঋণ খেলাপিদের প্রণোদনা গ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়।

সোনালীনিউজ/এলএ/এমএএইচ

Wordbridge School
Link copied!