• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
মন্তব্য প্রতিবেদন

নির্বাচন, প্রত্যাখ্যান এবং হরতাল


মহিউদ্দিন খান মোহন ফেব্রুয়ারি ৩, ২০২০, ০২:০৭ পিএম
নির্বাচন, প্রত্যাখ্যান এবং হরতাল

ঢাকা : গত পরশু অনুষ্ঠিত ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে এখন চলছে আলোচন-সমালোচনা। এ আলোচনা হয়তো চলবে আরো বেশ কিছুদিন। ভবিষ্যতের রাজনৈতিক আলোচনায় স্থান পাবে উদাহরণ হিসেবে। সে ক্ষেত্রে যে যার দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই কথা বলবেন। কেউ বলবেন নির্বাচন অত্যন্ত সুষ্ঠু, সুন্দর ও নির্বিঘ্ন হয়েছে, ছিল শান্তিপূর্ণও। আবার কেউ হয়তো বলবেন, এটা ছিল ভোট জালিয়াতির নজিরবিহীন নজির। বলা যায়, এ বিতর্ক রেললাইনের মতো সমান্তরালভাবে চলতে থাকবে।

তবে নির্বাচনী ফলাফলে কেউ বিস্মিত হয়েছেন বলে মনে হয় না। এটা ধারণা করা গিয়েছিল যে, শেষ পর্যন্ত ১ ফেব্রুয়ারি সরকারি দলের প্রার্থীরাই জয়ের মালা পরবেন। যদিও নির্বাচনী প্রচারণায় বিএনপির মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীরা পিছিয়ে ছিলেন না। তবে তাদের সাংগঠনিক শক্তি ও দলের শীর্ষ নেতাদের দায়িত্বশীলতার বিষয়টি মাথায় রেখে অনেকেই ভোটের দিন ভোটকেন্দ্রে দলটির নেতাকর্মীদের উপস্থিতির বিষয়ে সন্দিহান ছিলেন। ভোটের দিন টিভি চ্যানেলের সংবাদ ও গতকালের পত্র-পত্রিকার রিপোর্ট  সে আশঙ্কাকে সত্যি প্রমাণ করেছে। নগরীর কোনো কেন্দ্রেই বিএনপি নেতাদের অবস্থান নিতে দেখা যায়নি। এমনকি কোনো এলাকাতেই সাধারণ ভোটারদের কেন্দ্রে নিয়ে আসার কাজে বিএনপির নেতাকর্মীরা তৎপর ছিল না; যেমনটি ছিল আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকরা। তাদেরকে দল বেঁধে ভোটকেন্দ্রের আশপাশে ঘুরতেও দেখা গেছে। বিএনপির এই অনুপস্থিতির ফলে ভোটকেন্দ্রগুলোতে আওয়ামী লীগ একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হয়েছিল। বিএনপি অভিযোগ করেছে সরকারি দলের নেতাকর্মীরা ভোটকেন্দ্র দখলে নিয়ে বুথে গিয়ে নৌকায় ভোট দিয়েছে। তাদের অভিযোগ সর্বাংশে অসত্য তা বলা যাবে না। গণমাধ্যমেও এসব খবর এসেছে। অনেক কেন্দ্রেই আইডেন্টিফিকেশন সম্পন্ন হওয়ার পর ভোটারদের বিদায় করে দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগের লোকেরা ভোটটি দিয়ে দিয়েছে। সে অবস্থায় ভোটারকে অসহায়ের মতো নীরবে চলে আসতে হয়েছে। কেননা ঘটনার কথা বলার মতো লোক তারা কেন্দ্রে খুঁজে পায়নি। বিএনপি যদি ভোটকেন্দ্রে শক্ত অবস্থান নিতে পারত, তাহলে তাদের সমর্থক ভোটারদের এমন অসহায়ত্ব বোধ করতে হতো না। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, নির্বাচনী প্রচারণার সময় বিএনপির বড় বড় নেতা ভোটকেন্দ্র পাহারা দেওয়া ও ‘ভোট জালিয়াতি’ প্রতিহত করার যে দৃঢ় প্রত্যয় ঘোষণা করেছিলেন, তাদের টিকিটিরও সন্ধান মেলেনি ভোটের দিন। তাদের ওইসব কথাবার্তা যে বায়বীয় আস্ফাালন ছাড়া আর কিছুই ছিল না, সেটা এখন প্রমাণিত।

এটা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে, নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হয়েছে। প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষগুলো উপস্থিত না থাকলে এ ধরনের শান্তিপূর্ণ ভোট হওয়াটাই স্বাভাবিক। আর এ ক্ষেত্রে বিএনপির অবদানকে অস্বীকার করা যাবে না। ভোটের আগে যুদ্ধংদেহী মনোভাব দেখানো বিএনপি যুদ্ধের দিন (ভোটের দিন) ময়দানে লাপাত্তা হলো কেন, সে প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাচ্ছে না। এদিকে ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার আধ ঘণ্টা পরই বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘ঢাকা সিটি ভোটে একটি তামাশার নির্বাচন হয়েছে।’ (বাংলাদেশের খবর, ২ ফেব্রুয়ারি)। তিনি বিভিন্ন ভোটকেন্দ্র সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের বুথ দখল, বিএনপি এজেন্টদের বের করে দেওয়া, সাধারণ ভোটারদের ভোট দিতে না দেওয়া ইত্যাদি অভিযোগও করেন। রাতে আরেকটি সংবাদ সম্মেলন করে মির্জা আলমগীর ভোটের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে রোববার (২ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীতে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল কর্মসূচি ঘোষণা করেন।

কিন্তু যারা ভেবেছিলেন দীর্ঘদিন পরে একটি হরতাল দেখবেন তাদেরকে  হতাশ হতে হয়েছে। গতকাল সকালে উঠে ঢাকার রাস্তায় চোখ রাখতেই দেখা গেছে প্রাত্যহিক চিত্র। অন্যান্য কর্মদিবসের মতোই ঢাকা ছিল সরব। সড়কগুলো ছিল যানবাহনে পরিপূর্ণ। মানুষ ছিল কর্মচঞ্চল। হরতালের ছিটেফোঁটা উপস্থিতিও কেউ অনুভব করেননি। টেলিভিশনের পর্দায় নয়াপল্টনের বিএনপি অফিসের সামনে পাঁচ-ছয়জন নারীনেত্রীসহ গুটিকয় কর্মী নিয়ে চেয়ারে বসে রিজভী আহমেদের হরতাল উপভোগ করার দৃশ্য ছিল উপভোগ্য। সমবেত কর্মীরা সেখানে বসে যখন হরতাল সফল করার স্লোগান দিচ্ছিল, তখন নয়াপল্টনের রাস্তায় দেখা গেছে যানবাহনের ভিড়। রিজভী অবশ্য সেখানে সাংবাদিকদের বলেছেন, আন্দোলনকে তারা তীব্র থেকে তীব্রতর করে তুলবেন। আর এ হরতাল সে তীব্র আন্দোলনেরই একটি ধাপ। বলা বাহুল্য, হরতালের যে ‘তীব্রতা’ তারা দেখিয়েছেন, তাতে কল্পিত সে আন্দোলন কী রকম তীব্র হবে তা অনুমান করা কষ্টকর নয়।

কয়েকদিন আগে ক্ষমতাসীন দলের একজন নেতা বলেছেন, বিএনপি একটি ব্যর্থ রাজনৈতিক দল। তিনি অবশ্য এটা হিসেবে রাখেননি যে, বিএনপি সফল হলে তারা এখন যে স্বস্তিতে দিন গুজরান করছেন তা পারতেন না। তবে তার মন্তব্যকে বেঠিক বলার উপায় নেই। আন্দোলন, নির্বাচন, হরতাল কোনো ক্ষেত্রেই এই দলটি তাদের শক্তি-সামর্থ্যের জানান দিতে পারছে না। প্রেস ব্রিফিং কিংবা ঘরোয় সভায় সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলার বায়বীয় আস্ফাালনই যেন এখন তাদের সম্বল হয়ে দাড়িয়েছে। বিএনপি যে কতটা হীনবল হয়ে পড়েছে তা ১ ফেব্রুয়ারির ভোট এবং পরের দিনের হরতালের চিত্র থেকেই স্পষ্ট। বলা নিষ্প্রয়োজন, এসব ঘটনা দলটির নেতাকর্মী-সমর্থকদের হতাশা আরো বাড়িয়ে তুলবে নিঃসন্দেহে। সে হতাশা থেকে বেরিয়ে আসার পথ তারা সহসা খুঁজে পাবে, এমন সম্ভাবনা ক্ষীণ বলেই মনে হচ্ছে।

লেখক: সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!