• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

নির্বাচনে সুবিধা পেতে অতীত বিসর্জন দিলেন সু চি


আর্ন্তজাতিক ডেস্ক ডিসেম্বর ১৫, ২০১৯, ০১:১১ পিএম
নির্বাচনে সুবিধা পেতে অতীত বিসর্জন দিলেন সু চি

ঢাকা : ভবিষ্যতে একটুখানি সুখ পাবে এ আশায় বিসর্জন দিল অতীতের সব অর্জন। বিশ্বের কাছে হয়ে গেল মিথ্যাবাদী। গণতন্ত্রের জন্য বছরের পর বছর গৃহবন্দি থাকা আপসহীন নেতা পরিণত হলো গণহত্যাকারীতে। শান্তির জন্য নোবেল পাওয়া ব্যক্তি হয়ে গেল অশান্তির প্রতীক। এখানে বলা হচ্ছে মিয়ানমারের ডি ফ্যাকটো নেতা অং সান সু চি’র কথা।

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে গণহত্যা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে তেমন উচ্চবাচ্য না করা সু চি সেনাবাহিনীর পক্ষ নিয়ে আইসিজেতে যে মিথ্যাচার করেছে তাতে হতবাক বিশ্ববাসী।

রাখাইনে গণহত্যা নিয়ে গাম্বিয়ার করা মামলার শুনানি গত মঙ্গলবার নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগেতে অবস্থিত ইন্টান্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে শুরু হয়। এ মামলায় মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর পক্ষ সাফাই গাইতে উপস্থিত হন সু চি। শুনানি শুরু হওয়ার সময় আদালতে শান্ত চেহারায় বসে ছিলেন তিনি। চুলে গোঁজা ছিল বরাবরের মতোই তাজা ফুল। সুস্থির চিত্তে শোনেন বাদীপক্ষের অভিযোগ।

বলা হচ্ছিল গণহত্যার কথা, ছোট ছোট শিশুকে আগুনে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারার ও নারীদের গণধর্ষণের ঘটনা। নিপীড়িতের কণ্ঠস্বর উপাধি পাওয়া সু চি এসব অভিযোগ নির্বিকার মুখে শোনার পর বললেন, সব মিথ্যা। নির্যাতনের বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রতীক দাঁড়ালেন নিপীড়কের পক্ষ। যে জান্তা সরকার তাকে গৃহবন্দি করে রাখল ১৫ বছর, তাদের অস্ত্রের ঝনঝনানিতেই আস্থা রাখলেন তিনি।

তার এ ধরনের আচরণ ইকোনমিস্ট, গার্ডিয়ান, বিবিসি, সিএনএন, ফরেন পলিসি, ডিপ্লোম্যাটসহ বিভিন্ন  আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে উঠেছে নিন্দার ঝড়।

বলা হচ্ছে, জান্তা সরকারের বিশ্বাসভাজন হতে এবং ২০২০ সালের জাতীয় নির্বাচনে সুবিধা পেতে সু চি অতীতের সব সুনাম বিসর্জন দিয়েছেন। সুফলও তিনি হাতেনাতে পেয়েছেন। রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগ নাকচ করার সঙ্গে সঙ্গে মিয়ানমারে সু চি’র সমর্থনে মিছিল হয়েছে। বহুত্ববাদী ধারণার গলা টিপে সু চি দেখা দিয়েছেন কট্টর জাতীয়তাবাদী রূপে।

রাখাইনে গণহত্যার অভিযোগকে এককথায় তিনি যেভাবে খারিজ করে দিলেন তা নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে চলছে তুমুল সমালোচনা। বিশ্লেষকরা বলছেন, সু চি’র বক্তব্য প্রমাণ করে যে, রোহিঙ্গাদের জন্য তার কোনো সহানুভূতি নেই। দেশটির সামরিক বাহিনী ও তার চিন্তা-ভাবনায় তফাত নেই বললেই চলে।

অভিযোগের শুনানিতে গাম্বিয়া রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগের বিষয়ে সুস্পষ্ট প্রমাণ দাখিল করেছে। তা সত্ত্বেও সু চি নিজেদের পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে বলেছেন, তার দেশের সেনাসদস্যরা যুদ্ধাপরাধ করে থাকলে তা মিয়ানমারের দেশীয় তদন্ত ও বিচারব্যবস্থায় নিষ্পত্তি করা হবে। এটিকে আন্তর্জাতিকীকরণের সুযোগ নেই।  ১৯৪৮-এর গণহত্যা সনদ এখানে প্রযোজ্য নয় বলেও দাবি করেন তিনি।

ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, গণতন্ত্রের পক্ষে লড়তে গিয়ে যে সু চি ১৫ বছর অন্তরীণ ছিলেন, তিনিই এখন সামরিক বাহিনীর সুরে তাল মেলাচ্ছেন। তার এ রূপান্তর বিস্ময়কর। দ্য হেগে নিজের যাওয়ার বিষয়টি সু চি খুব ভেবেচিন্তেই ফলাও করে প্রচার করেছেন। এর পেছনে আছে মিয়ানমারের স্থানীয় রাজনীতিতে ফায়দা লোটার স্বার্থ। ক্ষমতা পাওয়ার লোভে অন্ধ হয়ে নিজের এত দিনের সম্মানজনক ভাবমূর্তিতে কাদা লেপতেও কার্পণ্য করছেন না।

বিবিসি বলেছে, ২০১৫ সালের নির্বাচনে জিতে সু চি’র নেতৃত্বাধীন বেসামরিক সরকার ক্ষমতায় এলেও,  সামরিক বাহিনীর প্রভাব কমেনি। এখনো মিয়ানমারের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা সে দেশের সামরিক বাহিনী। পার্লামেন্টেও তাদের অংশীদারত্ব আছে। প্রতিরক্ষা, স্বরাষ্ট্র ও সীমান্তসংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণও তাদের হাতে।

সু চি’র সমর্থকরা এতদিন বলে আসছিলেন, ক্ষমতাহীনতার কারণেই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর হওয়া নির্যাতন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছেন না শান্তিতে নোবেলজয়ী এ রাজনীতিক। তবে আইসিজেতে যে ভাষায় তিনি সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন, তারপর আর এ যুক্তি চলে না।  

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বক্তব্যে সামরিক বাহিনীর অবস্থান থেকে নিজেকে পৃথক করার সুযোগ ছিল সু চি’র। এমনকি তা সম্ভব না হলে, বক্তব্য দেওয়া থেকে বিরত থাকার সুযোগও ছিল। কিন্তু তিনি এর কোনোটাই না করে নিজের নৈতিক অবস্থান হারিয়েছেন।

গার্ডিয়ানের সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, গণহত্যার অসংখ্য তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করার পরও সব নাকচ করে দিয়েছেন সু চি। পুরো বক্তব্যে একবারো রোহিঙ্গা শব্দটিও উচ্চারণ করেননি। তার এ অভিব্যক্তিতে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, নিতান্ত অনিচ্ছায় মিয়ানমারের বেসামরিক পুতুল সরকারের নেতা হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করছেন না। রাজনৈতিক স্বার্থ তার আছে।

সু চি’র এখন লক্ষ্য ২০২০ সালের জাতীয় নির্বাচন। নির্বাচনের মাধ্যমে নিজের দলের প্রভাব-প্রতিপত্তি বাড়াতে চান। তাই সংখ্যাগরিষ্ঠ জনতাকে ক্ষুব্ধ করতে চান না। জনগণের চোখে ভালো সাজতে গিয়ে বিবেকের ভালো-মন্দ জলাঞ্জলি দিয়েছেন।

ফরেন পলিসির বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, আইসিজেতে স্পষ্টভাবেই একটি নির্দিষ্ট পক্ষ নিয়েছেন সু চি। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে হওয়া নির্যাতন-নিপীড়নের অভিযোগগুলো মিয়ানমারের স্থানীয় আদালতে, বিশেষ করে সামরিক আদালতে বিচার করার আরজি জানিয়েছেন তিনি। গাম্বিয়ার উপস্থাপন করা তথ্যকে বিভ্রান্তিকর বলে মন্তব্য করেছেন।

বলেছেন, রোহিঙ্গা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে সেনাবাহিনীর সংঘাতের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে কিছু ঘটনা ঘটেছে, তবে তা গণহত্যার সমতুল্য নয়। সেনাবাহিনীর বলপ্রয়োগের প্রয়োজনীয়তারও সাফাই গেয়েছেন। বেসামরিক সরকারের প্রধান হিসেবে তার অবস্থান কোনোভাবেই সামরিক বাহিনীর বক্তব্যের তুলনায় ভিন্ন নয় তা তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন।

দ্য ডিপ্লোম্যাট পত্রিকার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আইসিজেতে সু চি সুচিন্তিত ও পরিকল্পিতভাবে রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতনের সব অভিযোগকে অবহেলা ও উপেক্ষা করেছেন। জাতিসংঘের সাবেক মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার জাইদ রা’দ আল হুসেইন সিএনএনকে বলেছেন, সু চি যেভাবে নিজেদের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন, তা এককথায় হাস্যকর।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!