• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
ব্যাংকিং খাতের অবস্থা আরো খারাপ হতে পারে

নড়বড়ে অবস্থায় ১২ ব্যাংক


নিজস্ব প্রতিবেদক ফেব্রুয়ারি ২২, ২০২০, ০৩:৫৪ পিএম
নড়বড়ে অবস্থায় ১২ ব্যাংক

ঢাকা : ব্যাংকখাত দিন দিন নড়বড়ে হয়ে পড়ছে। ১২টি ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা বেশ খারাপ। এসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণ অনেক বেড়ে গেছে। ফলে ব্যাংকগুলো নির্ধারিত প্রভিশন রাখতে ব্যর্থ হয়েছে।

সুশাসনের অভাবে বেড়েছে ঋণে অনিয়ম, যা নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ কর্তৃপক্ষ। এমনকি কেন্দ্রীয় ব্যাংক তদারকির দায়িত্বে থাকলেও সুশাসন নিশ্চিত করতে পারছে না।

বিশ্লেষকরা বলছেন, সার্বিকভাবে ব্যাংকখাতের ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ ও তদারকি ব্যবস্থা আগের চেয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছে। অপরদিকে প্রভাবশালীদের কাছে জিম্মি ব্যাংকগুলো। ব্যাংকের উদ্যোক্তারা মিলেমিশে নানা অনিয়ম সংঘটিত করছে।

সূত্রগুলো বলছে, ঋণ জালিয়াতির কারণে অধিকাংশ ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা এখন নাজুক। আমানতকারীদের জমা রাখা টাকা থেকে গ্রাহকদের ঋণ দেয় ব্যাংক। বিতরণ করা সেই ঋণ কোনো কারণে খেলাপি হলে সেই খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রয়োজনীয় প্রভিশন (নিরাপত্তা সঞ্চিতি) সংরক্ষণ করতে হয়। এটি আমানতকারীদের আমানতের সুরক্ষা হিসেবে বিবেচিত হয়। কিন্তু সেটিও রাখতে পারছে না অনেক ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রয়োজনীয় প্রভিশন রাখতে ব্যর্থ হয়েছে ১২ ব্যাংক।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, খেলাপি ঋণ বাড়ার কারণেই ব্যাংকিং খাতে বাড়ছে প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ। তারা বলছেন, যেসব ব্যাংক প্রভিশন সংরক্ষণ করতে পারছে না সেইসব ব্যাংকের আমানতকারীরা এখন ঝুঁকিতে রয়েছে।

জানতে চাইলে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, এখন ব্যাংক খাতে চলছে দুষ্ট নীতির বাস্তবায়ন। এর ফলে ঋণ গ্রহীতার আচরণে এক ধরনের পরিবর্তন হয়েছে। ঋণখেলাপিদের প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে। আবার ভালো ঋণকে খারাপ দেখিয়ে সহায়তা নেওয়ারও একটি মনোভাব তৈরি হয়েছে। এটি এক অঙ্ক সুদ বাস্তবায়নে বাধা হবে।

এই অর্থনীতিবিদ বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে গৃহীত নীতির কারণে কিছু হয়তো আদায় হয়েছে। তবে বড় অঙ্কের অর্থ ঝুঁকিতে চলে গেল। এর ফলে ব্যাংকের স্বাস্থ্য সাময়িক ভালো দেখাবে, খেলাপি ঋণ কমবে। কিন্তু কার্যত ব্যাংকের আর্থিক ভিতকে আরো দুর্বল করছে।

বিশ্বব্যাংকের সাবেক এই মুখ্য অর্থনীতিবিদ মনে করেন, ঋণখেলাপির আচরণে পরিবর্তন না এলে এক অঙ্ক সুদে ঋণ কার্যকর করা বড় বাধা। খেলাপিদের জন্য কড়া ব্যবস্থা থাকা দরকার।

কিন্তু সেদিকে কোনো পদক্ষেপ দেখি না, যদিও বলা হয়েছিল শক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ঋণখেলাপিদের সব ধরনের নীতি সহায়তা ও সামাজিক সুবিধা বন্ধ করা গেলে তাদের কাছে একটি বার্তা যেত। তখন এই বিশেষ পলিসির কিছুটা সঠিক ব্যবহার হতো।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের বাধ্য করা উচিত প্রভিশন ঘাটতির সমান টাকার জোগান দিতে। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্ব হলো— প্রভিশন ঘাটতির টাকা জমা না দেওয়া পর্যন্ত ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের সব ধরনের সুযোগ বন্ধ করে দেবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০১৯ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকগুলোতে ঋণের ঝুঁকি বিবেচনায় প্রভিশন সংরক্ষণের প্রয়োজন ছিল ৬১ হাজার ৩১৭ কোটি টাকা। কিন্তু এর বিপরীতে ব্যাংকগুলো প্রভিশন রেখেছে ৫৪ হাজার ৬৬২ কোটি টাকা। এতে ঘাটতি দেখা দিয়েছে ৬ হাজার ৬৫৫ কোটি টাকা।

প্রসঙ্গত, ব্যাংক ব্যবস্থার খেলাপি ঋণের বিপরীতে নির্ধারিত পরিমাণ নিরাপত্তা সঞ্চিতির অর্থ সংরক্ষণের বিধান রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষ এক কর্মকর্তা বলেন, আমানতকারীদের অর্থ যেন কোনো প্রকার ঝুঁকির মুখে না পড়ে সেজন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নানা বিধি-নিষেধ আরোপ করা আছে। এর একটি হলো প্রভিশন সংরক্ষণ।

নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংকের অশ্রেণীকৃত বা নিয়মিত ঋণের বিপরীতে দশমিক ২৫ থেকে পাঁচ শতাংশ হারে প্রভিশন রাখতে হয়।

নিম্নমান বা সাব স্ট্যান্ডার্ড ঋণের বিপরীতে রাখতে হয় ২০ শতাংশ, সন্দেহজনক ঋণের বিপরীতে ৫০ শতাংশ এবং মন্দ বা কুঋণের বিপরীতে ১০০ শতাংশ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। ব্যাংকের আয় খাত থেকে অর্থ এনে এই প্রভিশন সংরক্ষণ করা হয়।

তবে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বাড়লে, ব্যাংকের প্রয়োজনীয় আয় না হলে প্রভিশন ঘাটতি দেখা দেয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ডিসেম্বর প্রান্তিকে মোট শ্রেণীকৃত ঋণের মধ্যে ৮১ হাজার ৮৭৯ কোটি টাকা বা ৮৬ দশমিক ৮০ শতাংশই মন্দ বা ক্ষতিকর ঋণ, যা একবছর আগে ছিল ৮০ হাজার ১১৬ কোটি টাকা বা ৮৫ দশমিক ৯৩ শতাংশ।

ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী, প্রভিশন ঘাটতি থাকলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক শেয়ারহোল্ডারদের জন্য কোনো লভ্যাংশ ঘোষণা করতে পারে না।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সোনালী ব্যাংকের ঘাটতি ২ হাজার ১৫৬ কোটি টাকা। এছাড়াও অগ্রণী ব্যাংকের ১ হাজার ৪৪২ কোটি, বেসিক ব্যাংকের ৩ হাজার ৩৩৪ কোটি, রূপালী ব্যাংকের ৮৭৮ কোটি, এবি ব্যাংকের ৬৩৭ কোটি, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ৫৩৮ কোটি, ঢাকা ব্যাংকের ৪২৫ কোটি, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ২৭৫ কোটি,  ন্যাশনাল ব্যাংকের ৪৮৭ কোটি, এসআইবিএলের ২৯৬ কোটি, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ১৬১ কোটি এবং ট্রাস্ট ব্যাংকের ১৬৪ কোটি টাকা ঘাটতি রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, এক বছরের ব্যবধানে প্রভিশন ঘাটতি বেড়েছে ৪০ কোটি টাকা। বর্তমানে ঘাটতি ৬ হাজার ৬৫৫ কোটি টাকা। ২০১৮ সালের ডিসেম্বর শেষে এই ঘাটতি ছিল ৬ হাজার ৬১৫ কোটি টাকা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকখাতে ঋণ বিতরণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০ লাখ ১১ হাজার ৮২৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯৪ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা, যা ২০১৮ সালের ডিসেম্বর শেষে ছিল ৯৩ হাজার ৯১১ কোটি টাকা। অর্থাৎ বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৪২০ কোটি টাকা।

দেশে সরকারি-বেসরকারি ১০ ব্যাংকের অবস্থা তুলনামূলক খারাপ। ব্যাংকখাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংকের বিচারে এই ১০ ব্যাংককে ‘প্রান্তিক’ মানে চিহ্নিত করা হয়েছে। বিভিন্ন পরিসংখ্যান বলছে, এই ব্যাংকগুলোর মধ্যে কয়েকটির পরিস্থিতি অত্যন্ত খারাপ।

দেশের তফসিলি ব্যাংকগুলোর ক্যামেলস রেটিং বলছে, ১০টি ব্যাংক প্রান্তিক অবস্থায় রয়েছে। আর ৯টি ব্যাংকের অবস্থা ‘মোটামুটি ভালো’। বাকি ৩৮টি ব্যাংকের অবস্থা ‘সন্তোষজনক’। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিচারে দেশে ‘শক্তিশালী’ মানের কোনো ব্যাংক নেই। আবার একেবারেই ‘অসন্তোষজনক’ ক্যাটাগরিতে কোনো ব্যাংক পড়েনি।

ক্যামেলস রেটিং হচ্ছে ব্যাংকের সামগ্রিক স্বাস্থ্য পরিমাপের মানদণ্ড। ব্যাংকের মূলধন পর্যাপ্ততা, সম্পদের মান, ব্যবস্থাপনা, উপার্জন ক্ষমতা, তারল্য প্রবাহ, বাজার ঝুঁকির প্রতি সংবেদনশীলতা- ৬টি সূচকের অবস্থার ভিত্তিতে এই রেটিং নির্ধারিত হয়।

সূচকগুলোর ইংরেজি প্রতিশব্দের আদ্যাক্ষর নিয়ে গঠিত ‘ক্যামেলস’ শব্দটি। এই রেটিংয়ে ৫টি ভাগ করা হয়। রেটিং ১ বা ‘শক্তিশালী’ ভালো মান। রেটিং-২ এর অর্থ ‘সন্তোষজনক’। রেটিং-৩ পাওয়া ব্যাংককে ‘মোটামুটি ভালো’ বলা হয়। রেটিং-৪ প্রাপ্ত ব্যাংককে বলা হয় ‘প্রান্তিক মানের’। অর্থাৎ এগুলোর অবস্থা ভালো নয়। আর সবচেয়ে খারাপ রেটিং হচ্ছে ৫, যাকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে ‘অসন্তোষজনক’।

প্রান্তিক মানে থাকা ব্যাংকগুলোর মধ্যে ৫টি রাষ্ট্রীয় মালিকানার। এগুলো হলো- সোনালী, জনতা, বেসিক, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব)।

বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে রয়েছে এবি ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংক ও আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক। বিদেশি ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান রয়েছে প্রান্তিক তালিকায়।

মোটামুটি ভালো মান বা ক্যামেলস রেটিং-৩ প্রাপ্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে রয়েছে- অগ্রণী ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক, মেঘনা ব্যাংক, এনআরবি ব্যাংক, এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক ও এক্সিম ব্যাংক।

আর সন্তোষজনক মান বা ক্যামেলস রেটিং-২ পেয়েছে দেশের বেসরকারি ৩০ ব্যাংক ও বিদেশি ৮ ব্যাংক। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে রয়েছে- পূবালী, শাহ্জালাল ইসলামী, উত্তরা, দি সিটি ব্যাংক, আইএফআইসি, ইউসিবি, ইস্টার্ন, এনসিসি, প্রাইম, সাউথইস্ট, ঢাকা, ডাচ্-বাংলা, মার্কেন্টাইল, ওয়ান, মিউচুয়াল ট্রাস্ট, প্রিমিয়ার, ব্যাংক এশিয়া, ট্রাস্ট, যমুনা, ব্র্যাক, এনআরবি কমার্শিয়াল, সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স, মিডল্যান্ড, ইউনিয়ন, মধুমতি, সীমান্ত, ইসলামী, আল-আরাফাহ ইসলামী, সোশ্যাল ইসলামী ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক। বিদেশি ব্যাংকগুলোর মধ্যে রয়েছে- ব্যাংক আল ফালাহ, সিটিব্যাংক এনএ, স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া, কমার্শিয়াল ব্যাংক অব সিলন, হাবিব ব্যাংক, এইচএসবিসি, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ও উরি ব্যাংক।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!